অথবা, চর্যাপদ অবলম্বনে প্রাচীন বাংলার নিম্নশ্রেণির জীবনযাত্রার পরিচয় দাও।
অথবা, চর্যাপদের পদকর্তারা কাব্যসাধনা ও ধর্মসাধনার সাথে সাথে প্রাচীন বাংলার নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবন যাপন প্রণালির নিখুত চিত্রও এঁকেছেন।- বিশ্লেষণ কর।
উত্তর: চর্যাগীতিকাগুলো বৌদ্ধ সহজিয়াদের পদ্ধতিমূলকগান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্ধ্যাভাষায় রূপকের মাধ্যমে সাধকদের গূঢ় ধর্মসাধনার কথা প্রচার করা। চর্যাপদগুলোর রচনাকাল নির্দিষ্টভাবে নির্ণীত না হলেও নানা আলোচনা হতে বিশেষজ্ঞগণ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তাতে জানা যায় যে, এগুলো দশম হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। ঐতিহাসিক মতে, এ সময়ের মধ্যে বঙ্গদেশে পাল রাজাদের পতন ও সেন রাজাদের রাজত্বকাল। এ সময় চর্যাপদকর্তাগণ নিজ নিজ অবস্থায় নিজেদের ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তৎকালীন সমাজের বাস্তব জীবনযাত্রার যে সমস্ত রূপকল্প ব্যবহার করেছেন তা বিস্ময়ের বটে।
ঐতিহাসিক পটভূমিকায় চর্যাগীতিগুলো রচিত। সামাজিক বৈষম্য ও পক্ষপাত, উচ্চবর্ণের মধ্যে নানা প্রকার অন্যায় ও ব্যভিচার, নৈতিক অধঃপতনের চিত্র, অন্ত্যজ শ্রেণির জীবনচিত্র ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়। এটি ছিল চর্যাপদ রচনার যুগে সামাজিক অবস্থার স্বরূপ। চর্যাপদে যে সমাজের চিত্র পাওয়া যায় তা একান্ত ভাবে বাংলা-বাঙালির নয়- সমগ্র পূর্ব ভারতের। চর্যাপদে যাদের চিত্র পাওয়া যায় তারা ধর্মক্ষেত্রে বৌদ্ধ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবহেলিত বিপর্যন্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত। চর্যাপদের ভাষা, বস্তুবাচক শব্দ, উপমান-উপমিত পদ, পেশা, নদী, নৌকা, সাঁকো, ঘাট, পাটনী, মূষিক, তুলো, সোনা-রুপা, মদ, অবৈধ প্রেমকাহিনি, প্রতিবেশ, তৈজসপত্র, ঘরবাড়ি, ব্যবহারসামগ্রী প্রভৃতি সবটাই নিঃস্ব নির্জিত মানুষের বাস্তব জীবন-জীবিকা ও সমাজ থেকে গৃহীত।
সমাজের নিচু স্তরের মানুষের কথা চর্যাপদে প্রতিফলিত হয়েছে। শবর মেয়েরা খোঁপায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জরের মালা পরতো। সে সমাজ তন্ত্র-মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল- ডাকিনী, যোগিনী, কুহকিনী- এমনকি কামরূপ কাম্যাখ্যার নামও উপস্থাপিত হয়েছে চর্যাপদে। তারা সমাজের অভিজাত মানুষ থেকে দূরে বাস করতো গ্রামের প্রান্তে, পর্বত গাত্রে কিংবা টিলায়। ২৮ নং চর্যায় বলা হয়েছে এভাবে-
“উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালী।
মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী ॥”
১০ চর্যায় নগরের বাইরে ডোম্বি নারীর বসবাসের কথা বলা হয়েছে- ‘নগর বাহিরিরে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ’- আবার টিলায় বাস করার কথাও বলা হয়েছে ‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী’। কাপালিক, যোগী, ডোম্বী, চণ্ডালী, ব্যাধ, শবরী, তাঁতি, ধুনুরী, গুঁড়ি, মাহুত, নট-নটী, পতিতা নানান শ্রেণির কথা চর্যাপদে উঠে এসেছে। কয়েকটি চর্যায় ব্যাধ বৃত্তির কথাও বলা হয়েছে। ব্যাধকর্তৃক হরিণ শিকারের দৃশ্য ফুটে উঠেছে ৬ নং চর্যায়। যেমন-
“কাহেরে ঘিনি মেলি আছহু কীস।
বেঢ়িল হাক পড়ই চৌদীস ॥
আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।
খনহ না ছাড়ই ভুসুক অহেরী ॥”
হরিণ তার মাংসের জন্য সবার কাছে শত্রু হয়ে ওঠে- তার মাংসের জন্য সকলে তাকে হত্যা করতে চায়। শিকারি সারাক্ষণ তাকে অনুসরণ করে, এক মুহূর্তের জন্যও তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। হরিণ তাই তৃণ-জল পরিত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যেতে চায়। আসলে এটা রূপকও বটে- তৎকালীন সমাজে উচ্চবিত্তদের অত্যাচারে সাধারণ জনগণ যে অন্য কোথাও [টিলা, পর্বত, নগরে বাইরের গ্রাম] শান্তির জন্য আবার গড়ে তুলেছিল তা এ থেকেই প্রমাণিত হয়। যেমন-
“হরিণী বোলই হরিণা সুণ তো।
এ বন ছাড়ী হোহু ভাস্তো ॥”
ডোম্বীদের বৃত্তি ছিল তাঁত বোনা ও চাঙ্গারি তৈরি করা। ‘অন্তি বিকণঅ ডোম্বী অবর না চাঙ্গেড়ে।’ কারো অন্যতম বৃত্তি ছিল মদ চোয়ানো। যেমন ৩৩ নং চর্যায় বলা হয়েছে-
“এক সে শুণ্ডিনী ঘরে সান্ধই।
চীঅণ বাকলত বারুণী বান্ধই ॥”
শান্তি পার ২৬ নং পদে ধুনুরীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে- ‘তুলা ধুণি ধুণি আঁসুরে আসু’। কুঠার দিয়ে গাছ কাটার কথা আছে ৪ ও ৫ নং চর্যাপদে। নটবৃত্তি সেকালের পেশা হিসেবে প্রচলিত ছিল। ১০ নং চর্যায় কাহ্নপাদ বলেছেন-
“এক সো পদমা চউসটঠী পাখুড়ী।
তহি চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি ॥”
চর্যাগীতিগুলোর মধ্যে যে সমাজচিত্র ও বাস্তব জীবনযাত্রার আভাস ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাতে একদিকে সমাজের এ ভেদ- বিভেদ এবং বৈষম্যের চিত্র। অন্যদিকে দুঃখপূর্ণ দরিদ্র জীবনযাত্রার কখনো পূর্ণাঙ্গ কখনো বা খণ্ড বিচ্ছিন্ন উপাদান লক্ষ করা যায়। দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ ও অশান্তির চিত্র চর্যায় প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন-
“টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী ॥
বেঙ্গ সংসার বড়হিল জাঅ।
দুহিলু দুধু কি বেল্টে সামায় ॥”
সেকালের সমাজেও চোর, ডাকাত, দস্যুদের প্রাদুর্ভাব ছিল। আবার যে চোর সেই ক্ষমতাবলে সমাজে সাধু সেজে থাকতো। অন্যদিকে ডাকাত দল বজ্রনৌকায় নদী পার হয়ে বাংলাদেশে লুণ্ঠন করতো। রাতের বেলায় চোরদের উৎপাত বেড়ে যেতো। পদকর্তাদের ভাষায়-
ক. “বাজ ণাব পাড়ী পউআঁ খালে বাহিউ।
অদহ বঙ্গাল দেশ লুড়িউ ॥” [৪৯ নং চর্যাপদ]
খ. “আঙ্গন ঘরপন সুন ভো বিআতী।
কানেট চোরে নিল অধরাতী ॥” [২ নং চর্যাপদ]
সেকালের সমাজেও ধড়িবাজ লোকের অভাব ছিল না- অভাব ছিল সমাজের সঙ্গতি। অত্যাচার-উৎপীড়নের দ্বারা অন্যায়ভাবে জীবনে বহুক্ষেত্রেই দুর্বিষহ করে তোলা হতো; যারা সমাজের উৎপীড়ক ছিল- আবার তারাই সমাজে সম্মান পেতো। পদকর্তার ভাষায়-
‘জো সো সুধী সোহি নিবুধী।
জো সো চোর সোহি সাধী ॥
নিতি নিতি সিআলা সিহে সন জুঝই।” [৩৩ নং চর্যা] সমাজের নৈতিক অধঃপতনের চিত্রও চর্যাপদে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। নাগরালী, কামচণ্ডালী, ছিনালী, পতিতা লম্পট প্রভৃতি রূপক চর্যায় ব্যবহৃত হয়ে সে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করেছে। দিনে বধূ কাকের ভয়ে ভীত- কিন্তু রাতে সে গোপন অভিসারে একাই বের হয়। ২ নং চর্যায় বলা হয়েছে-
“দিবসহি বহুড়ী কাউ হি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরূ জাই ॥”
সমাজের খণ্ড চিত্র চর্যায় বিধৃত হয়েছে। তৎকালীন বাঙালির আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতির আভাস চর্যায় সহজেই পাওয়া যায়। একাধিক চর্যায় উল্লেখ থাকায় মনে হয় শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-শালি নিয়ে বাঙালির যৌথপরিবার গড়ে উঠতো। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বিয়ে করতে যাওয়া, নতুন ফসল উঠলে নারী-পুরুষের আমোদ করা, মেয়েদের অলংকার হিসেবে কঙ্কণ-কুণ্ডর-নূপুর-ফুলের ব্যবহার, যৌতুকের লেনদেনের বিষয়ে নিখুঁত চিত্র চর্যাপদে পাওয়া যায়। যেমন-
“ভব নিব্বাণে পড়হ মাদলা।
মণ পবণ বেণি করও কশালা ॥
জঅ জঅ দুন্দুহি সাদ উছলিআঁ।
কাহ্ন ডোম্বী বিবাহে চলিআ ॥
ডোম্বী বিবাহিঅ অহারিউ জাম।
জউতুকে কিঅ আণুত্তর ধাম ॥”
চর্যাপদে কাপালিক হওয়ার চিত্র চমৎকারভাবে প্রকাশিত। সংসার, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে, সংসারের সমস্ত বন্ধন ত্যাগ করে কাহ্ন যে কাপালিক হয়েছিল তার পরিচয় আমরা পাই। যেমন-
“মারি সাসু, নন্দ ঘরে সালী।
মাঅ মারি কাহ্ন ভইঅ কবালী ॥”
কাপালিক হয়ে সংসার পরিত্যাগ করেছে এমন স্বামীর স্ত্রী যদি গর্ভিণী থাকে- তবে সে সংসারে আর দুঃখের শেষ থাকে না। একটি চর্যায় এমনি দরিদ্রের সংসারে গর্ভিণী রমণীর হৃদয়-বেদনার চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। কাপালিক স্ত্রী হিসেবে নারীরা যে অসহায় ছিল তা চর্যায় নারীদের কথা স্পষ্ট। আসলে চর্যাগীতির মধ্যে ইতস্ত ত যেসব খণ্ড ও পরিপূর্ণ চিত্র ছড়ানো রয়েছে তার আলোচনা করলে একটা গভীর শূন্যতাবোধ এবং দারিদ্র্যের ছবিই ফুটে ওঠে। যেমন-
“ফিটিলিউ গো মাই অন্তউডি চাহি।
জা এথু চাহম সো এথু নাহি ॥
পহিলে বিআণ মোর বাসন পুড়া।
নাড়ি বিআরন্তে সে বাপুড়া ॥”
চর্যাপদে রাজা ও রাজ্যশাসনের বিষয়ও উঠে এসেছে। সেকালের রাজারা শাসন-পট্ট প্রচার করতেন। একটি চর্যায় দেখা যায় হরিহর ব্রহ্মরাজ দগ্ধ হচ্ছে- দগ্ধ হচ্ছে তাদের শাসন-পট্ট। যেমন-
“দাঢ়ই হরিহর বামহ ভট্টা।
ফীটা হই নবগুণ শাসন পট্টা ॥
পরিশেষে বলা যায় যে, চর্যাপদে যে সমাজচিত্রের ছবি | প্রতিফলিত হয়েছে তা এক সময় মানুষের সামাজিক অবস্থানকেই প্রকাশ করে। চর্যাপদে যে জীবনধারায় চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে- তাতে উচ্চ জীবনধারার পরিচয় নেই। অধিকাংশ পদে অন্ত্যজশ্রেণির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বেদনাবিধুর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ‘ অসমিয়া, মগধ, উড়িষ্যা, বাংলা, কামরূপ- এসব অঞ্চলের বিস্তৃত পটভূমিকায় চর্যাপদের জীবনচিত্র অঙ্কিত হলে- চর্যাপদে নদীমাতৃক বাংলাদেশ এবং বাঙালির চিত্রই প্রতিনিধিত্ব করে। এগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা সেকালের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি লক্ষ করি- আর এখানেই বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদের সার্থকতা।
Leave a comment