কী উদ্দেশ্যে চর্যাপদ রচিত হয়েছিল? আলোচনা কর।

চর্যাপদের ধর্মদর্শন কী?

উত্তর: বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ। এটি বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের সাধনসংগীত। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা তাঁদের ধর্মমত প্রচারের উদ্দেশ্যে চর্যাপদ রচনা করেন। এটি কবিতার আকারে লেখা হলেও আসলে সাধন-ভজন বিষয়ক তত্ত্বগ্রন্থ। চর্যার পদকর্তারা কবিত্বশক্তির অধিকারী হলেও তাঁরা ছিলেন মূলত সাধক। এজন্য তাঁদের রচনায় কবিত্বের ছাপ প্রতীয়মান। সুতরাং চর্যাপদের পদকর্তারা যতই কবিত্ব শক্তির অধিকারী হোক না কেন, ধর্মতত্ত্ব প্রচার করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

চর্যার ধর্মদর্শন: চর্যার পদগুলো একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। রচিত। এগুলো বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের রচিত আধ্যাত্মিক সাধন সংগীত। পদগুলোর জন্ম সাধকদের বিশিষ্ট ধর্ম ও দার্শনিক বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। তাই চর্যাগীতিকে শুধু সাহিত্যতত্ত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে হবে না। এর ধর্মতত্ত্বকে একেবারে বাদ দেওয়া চলবে না। কেননা গানগুলোর সাহিত্য মূল্য খুবই কম, ধর্ম মূল্যই প্রধান। চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক সম্প্রদায়ের গুহ্য সাধক সংকেত বহন করেই আত্মপ্রকাশ করেছিল। ‘চর্যা’ নাম থেকেই বুঝা যায় যে এই পদগুলোতে তত্ত্বের চেয়ে আচরণের দিকটিই বেশি থাকবে। এর কারণ চর্যাকাররা সাধনার বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং সাধনালব্ধ নিগূঢ় উপলব্ধি এ পদগুলোর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। তবে এসব প্রক্রিয়া ও উপলব্ধিগুলো সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে এগুলোর মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মীয় চিন্তাধারায় বিশেষ বিশেষ অভিপ্রায় আর উপলব্ধিই আত্মপ্রকাশ করেছে।

চর্যাপদের ধর্মতত্ত্ব জটিল। এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচুর মতভেদ আছে। কারো মতে চর্যার ধর্মতত্ত্ব প্রধানত দার্শনিক মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। কেউ বা বলেছেন চর্যার ধর্মতত্ত্বে তন্ত্র ও যোগের উল্লেখ রয়েছে। সাধারণ আলোচনায় দেখা যায়, চর্যার গানগুলোর মূল পটভূমিকা হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম। বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক ভাবনা দুটি ভাগে বিভক্ত- একটি হলো মহাযান ও অপরটি হীনযান। বুদ্ধদেব তাঁর নিজের ধর্মোপলব্ধিকে কখনো দার্শনিক ব্যাখ্যার অধীন হতে দেননি। তাঁর মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্মের নেতারা মতভেদ হেতু দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে এবং আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে মহাযান ধর্মমতের উদ্ভব ঘটে। মহাযানীদের ধর্মাচরণের উদ্দেশ্য শুধু নিজের মুক্তি লাভ নয়, ‘সমগ্র জীবের মুক্তিলাভ এবং এঁদের চূড়ান্ত লক্ষ্যও অহত্ত্ব লাভ নয়, বোধিসত্তাবস্থা লাভ। বৌদ্ধ মতবাদ বহুশাখায় পরে বিভক্ত হয়। চর্যাপদের কতকগুলো বিষয় সোজাসুজি আধ্যাত্মিক। তাতে জন্ম- মৃত্যু, উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখের দোলা থেকে মুক্তি লাভের এবং সহজ অবস্থায় রূপ মহাসুখ-নিবাসে পৌঁছার ঠিকানা আছে। পদকর্তাদের ভাষায়-

“তীণি ভূষণ মই বাহিঅ হেলে।

হউ সুতেলী মহাসুহ লীলে ।” [১৮ নং চর্যা]

বৌদ্ধধর্মের আরেকটি শাখা আছে, যাকে বলা হয় কালচক্রযান। এ যানের সাধকেরা কালচক্রেই আদি বৌদ্ধ বা সকল বৌদ্ধের জন্মদাতা মনে করে। নিজেদের কালের প্রবাহের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সাধনাই হচ্ছে কালচক্রযান সাধন পদ্ধতি। তিব্বতে এ-কালচক্রযানের উৎপত্তি এবং পালরাজাদের আমলে বাংলাদেশে এ মতবাদ প্রচারিত হয়। এ প্রসঙ্গে বাঙালি ভুসুকুর কথা বলা যায়-

“আজি ভুসুক বঙ্গালী ভইলী।

ণিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলী ॥” [৪৯ নং চর্যা)

তত্ত্বের সাধনার একটি দিক হচ্ছে, দেহের নাড়িকে সংবৃত করে সাধনার পথে অগ্রসর হওয়া। বাম দিকের ইড়া নাড়ি এবং ডান দিকের পিঙ্গলা নাড়ি যথাক্রমে মুক্তি ও শিবরূপে কল্পিত হয়, এদের মধ্যবর্তী হচ্ছে সুষুম্না। এই ইড়া পিঙ্গলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অপ্রাণ ও প্রাণবায়ুকে যোগসাধনার দ্বারা সুষুম্মা নাড়ি পথে চালিত করে সাধক সিদ্ধি লাভ করেন। সহজিয়া সাধকেরা মহাসুখ লাভের একই প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন। মহাযানী বৌদ্ধদের শূন্যতা ও করুণা সহজযানী বৌদ্ধদের প্রজ্ঞা ও উপায়ে পরিণত হয়েছে। এই প্রজ্ঞা ও উপায়ই ললনা ও রসনা নামে পরবর্তী পর্যায়ে ইড়া পিঙ্গলার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছে এবং বোধিচিত্ত অবধুতিকারূপে শেষ পর্যন্ত অভিন্ন কল্পিত হয়েছে সুষুম্নার সাথে। এই ললনা-রসনা-অবধুতিকা নানা বিচিত্র রূপকে চর্যাপদে আত্মপ্রকাশ করেছে।

সামগ্রিক আলোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, চর্যাকারগণ লৌকিক জগতের বস্তুতে ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে গুহ্য গূঢ়র্থক সংকেত দ্বারা তাঁদের সাধন পদ্ধতির কথা ব্যক্ত করেছেন। চর্যাপদে বিশেষ কোনো মানের সাধন পদ্ধতিকেই বড়ো করে দেখাননি। মহাযান পন্থার বিভিন্ন বিবর্তিত রূপের পরিচয়ে চর্যাগুলো সমৃদ্ধ।