অথবা, চর্যাপদে অন্ত্যজ মানুষের যে কথা আছে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: চর্যাগীতিকাগুলো বৌদ্ধ সহজিয়াদের পদ্ধতিমূলক গান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্ধ্যাভাষায় রূপকের মাধ্যমে সাধকদের গূঢ় ধর্মসাধনার কথা প্রচার করা। ঐতিহাসিক পটভূমিকায় চর্যাগীতিগুলো রচিত। চর্যাপদকর্তাগণ নিজ নিজ অবস্থায় নিজেদের ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তৎকালীন সমাজের বাস্তব জীবনযাত্রার যেসব রূপকল্প ব্যবহার করেছেন তা বিস্ময়ের বটে।
ঐতিহাসিক পটভূমিকায় চর্যাগীতিগুলো রচিত। সামাজিক বৈষম্য ও পক্ষপাত, উচ্চবর্ণের মধ্যে নানা প্রকার অন্যায় ও ব্যভিচার, নৈতিক অধঃপতনের চিত্র, অন্ত্যজ শ্রেণির জীবনচিত্র ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়। এটি ছিল চর্যাপদ রচনার যুগে সামাজিক অবস্থার স্বরূপ। চর্যাপদে যে সমাজের চিত্র পাওয়া যায় তা একান্ত ভাবে বাংলা-বাঙালির নয় সমগ্র পূর্ব ভারতের। চর্যাপদের যাদের চিত্র পাওয়া যায় তারা ধর্মক্ষেত্রে বৌদ্ধ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবহেলিত বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত। চর্যাপদের ভাষা, বস্তুবাচক শব্দ, উপমান-উপমিত পদ, পেশা, নদী, নৌকা, সাঁকো, ঘাট, পাটনী, মুষিক, তুলো, সোনা-রুপা, মদ, অবৈধ প্রেমকাহিনি, প্রতিবেশ, তৈজসপত্র, ঘরবাড়ি, ব্যবহারসামগ্রী প্রভৃতি সবটাই নিঃস্ব নির্জিত মানুষের বাস্তব জীবন-জীবিকা ও সমাজ থেকে গৃহীত।
সমাজের নিচুস্তরের মানুষের কথা চর্যাপদে প্রতিফলিত হয়েছে। শবর মেয়েরা খোঁপায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জরের মালা পরতো। সে-সমাজ তন্ত্র-মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল- ডাকিনী, যোগিনী, কুহকিনী- এমনকি কামরূপ কাম্যাখ্যার নামও উপস্থাপিত হয়েছে চর্যাপদে। তারা সমাজের অভিজাত মানুষ থেকে দূরে বাস করতো। গ্রামের প্রান্তে, পর্বত গাত্রে কিংবা টিলায়। ২৮ নং চর্যায় বলা হয়েছে এভাবে-
“উষ্ণা উষ্ণা পাৰত তহি বসই সবরী বালী।
মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী ।”
চর্যাপদের অন্ত্যজ শ্রেণিচরিত্রগুলোর সম্মানজনক কিংবা অর্থকরী বৃত্তি ছিল না, কাপালী, যোগী, ডোম্বী, চণ্ডালী, শবরী, ব্যাধ, তাঁতী, ধুনরী, গুঁড়ি, মাহুত, নট-নটী, পতিতা প্রভৃতি নিম্নন্ত রের মানুষের কথা চর্যাপদে বর্ণিত আছে। চর্যার ১৩, ১৪, ১৫, ১৮ ইত্যাদি সংখ্যায় চর্যায় নৌকা বাওয়া, গুনটানা, জলসেচন ইত্যাদির যে বিবরণ আছে তাতে মনে হয় নৌকা বাওয়া এসব অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের একটি জনপ্রিয় বৃত্তি ছিল। ডোম্বীদের বৃত্তি ছিল তাঁত বোনা ও চাঙারি তৈরি করা। ১০ চর্যায় নগরের বাইরে ডোম্বি নারীর বসবাসের কথা বলা হয়েছে- ‘নগর বাহিরিরে ডোমি তোহোরি কুড়িআ’- আবার টিলায় বাস করার কথাও বলা হয়েছে। ‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী’। কয়েকটি চর্যায় ব্যাধ বৃত্তির কথাও বলা হয়েছে। ব্যাধকর্তৃক হরিণ শিকারের দৃশ্য ফুটে উঠেছে। ৬ নং চর্যায়। যেমন-
“কাহেরে ঘিনি মেলি আছহু কীস।
বেঢ়িল হাক পড়ই চৌদীস।
আপন মাংসে হরিণা বৈরী।
খনহ না ছাড়ই ভুসুক অহেরী।”
আসলে এটা রূপকও বটে- তৎকালীন সমাজে উচ্চবিত্তদের অত্যাচারে সাধারণ জনগণ যে অন্য কোথাও [টিলা, পর্বত, নগরে বাইরের গ্রাম। শান্তির জন্য আবাস গড়ে তুলেছিল তা এ থেকেই প্রমাণিত হয়। যেমন-
“হরিণী বোলই হরিণা সুণ তো।
এ বন ছাড়ী হোহু ভাস্তো।”
ডোম্বীদের বৃত্তি ছিল তাঁত বোনা ও চাঙ্গারি তৈরি করা। ‘অন্তি বিকণঅ ডোম্বী অবর না চাঙ্গেড়ে।’ কারও অন্যতম বৃত্তি ছিল মদ চোয়ানো। যেমন ৩৩ নং চর্যায় বলা হয়েছে-
“এক সে শুত্তিনী ঘরে সান্ধই।
চীঅণ বাকলত বারুণী বান্ধই।”
শান্তি পার ২৬ নং পদে ধুনুরীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে- ‘তুলা ধুণি ষুণি আঁসুরে আসু’। কুঠার দিয়ে গাছ কাটার কথা আছে ৪ ও ৫ নং চর্যাপদে। নটবৃত্তি সেকালের পেশা হিসেবে প্রচলিত ছিল। ১০ নং চর্যায় কাহ্নপাদ বলেছেন-
“এক সো পদমা চউসটঠী পাখুড়ী।
তহি চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি।”
চর্যাগীতিগুলোর মধ্যে যে সমাজচিত্র ও বাস্তব জীবনযাত্রার আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাতে একদিকে সমাজের এ ভেদ- বিভেদ এবং বৈষম্যের চিত্র। অন্যদিকে দুঃখপূর্ণ দরিদ্র জীবনযাত্রার কখনো পূর্ণাঙ্গ কখনো বা খণ্ড বিচ্ছিন্ন উপাদান লক্ষ করা যায়। দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ ও অশান্তির চিত্র চর্যায় প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন-
“টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।
বেঙ্গ সংসার বড়হিল জাঅ।
দুহিলু দুধু কি বেল্টে সামায় ॥”
অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে ড. আহমদ শরীফ বলেছেন, “চর্যাগীতিতে আমরা ভারতের পূর্বপ্রান্তিক একটি বিরাট অঞ্চলের (বিহার-উড়িয়া-বাংলা-আসাম) অধিবাসীদের মনমতো বিশ্বাস-সংস্কার, রীতি রেওয়াজ, জীবন, জীবিকা ও সমাজ সংস্কৃতির কিছু রূপরেখা পাই।”
চর্যাকারগণ অনেকেই সমাজের উচ্চপদের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চর্যাপদে অন্ত্যজ জাতির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বেদনাবিধুর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। চর্যায় তত্ত্বকথার আড়ালে সাধারণ মানুষের চিত্র ফুটে উঠেছে। সমাজের নৈতিক অবস্থা ছিলও অধঃপতিত। নাগরালি, কামচণ্ডালী, ছিনালী, পতিতা লম্পটদেরও পরিচয় মেলে চর্যাপদে। আর এভাবেই চর্যায় সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণি সুখ-দুঃখ আশা-নিরাশা কাম প্রেমের অনবদ্য দলিল এই চর্যাপদ।
Leave a comment