অথবা, ‘চর্যাপদ’ ধর্মীয় তত্ত্বপ্রধান রচনা হলেও এর সাহিত্যমূল্য নিতান্ত কম নয়’ – বিশ্লেষণ কর।

অথবা, “উপমা, রূপক, প্রতীকের ব্যবহারে চর্যাপদগুলো অসামান্য সাহিত্যিক মূল্য বহন করছে” – আলোচনা কর।

উত্তর: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন এবং ১৯১৬ সালে তা প্রকাশ করেন। চর্যাপদগুলোর রচনাকাল নির্দিষ্টভাবে নির্ণীত না হলেও নানা আলোচনা হতে বিশেষজ্ঞগণ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তাতে জানা যায় যে, এগুলো দশম হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। চর্যাগীতিকাগুলো বৌদ্ধ সহজিয়াদের পদ্ধতিমূলক গান; এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্ধ্যাভাষায় রূপকের মাধ্যমে সাধকদের গূঢ় ধর্মসাধনার কথা প্রচার করা। সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদের গুরুত্ব কাব্যসৃষ্টি হিসেবে। তবে তার মধ্যে একটি চমৎকার ধর্মকথাও প্রকাশ পেয়েছে। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ তাঁদের ধর্মীয় রাজনীতির নিগূঢ় রহস্য রূপায়ণের সময় সত্যিকারের কবি হয়ে উঠেছিলেন। এ কারণে চর্যাপদে একইসাথে কবিতার এবং ধর্মকথার লক্ষ্মণ প্রকাশ পেয়েছে। এতদসত্ত্বেও চর্যাপদের সাহিত্য মূল্য অপরিসীম।

চর্যাপদের বিষয়-সম্পদ: ঐতিহাসিক পটভূমিকায় চর্যাগীতিগুলো রচিত। সামাজিক বৈষম্য ও পক্ষপাত, উচ্চবর্ণের মধ্যে নানা প্রকার অন্যায় ও ব্যভিচার, নৈতিক অধঃপতনের চিত্র, অন্ত্যজ শ্রেণির জীবনচিত্র ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়। এটি ছিল চর্যাপদ রচনার যুগে সামাজিক অবস্থার স্বরূপ। চর্যাপদে যে সমাজের চিত্র পাওয়া যায় তা একান্তভাবে বাংলা-বাঙালির নয়- সমগ্র পূর্ব ভারতের। চর্যাপদে যাদের চিত্র পাওয়া যায় তারা ধর্মক্ষেত্রে বৌদ্ধ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবহেলিত বিপর্যন্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত। চর্যাপদের ভাষা, বস্তুবাচক শব্দ, উপমান-উপমিত পদ, পেশা, নদী, নৌকা, সাঁকো, ঘাট, পাটনী, মূষিক, তুলো, সোনা-রুপা, মদ, অবৈধ প্রেমকাহিনি, প্রতিবেশ, তৈজসপত্র, ঘরবাড়ি, ব্যবহারসামগ্রী প্রভৃতি সবটাই নিঃস্ব নির্জিত মানুষের বাস্ত ব জীবন-জীবিকা ও সমাজ থেকে গৃহীত। শবর মেয়েরা খোঁপায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জরের মালা পরতো। সে সমাজ তন্ত্র-মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল- ডাকিনী, যোগিনী, কুহকিনী- এমনকি কামরূপ কাম্যাখ্যার নামও উপস্থাপিত হয়েছে চর্যাপদে। তারা সমাজের অভিজাত মানুষ থেকে দূরে বাস করতো গ্রামের প্রান্তে, পর্বত গাত্রে কিংবা টিলায়। ২৮ নং চর্যায় বলা হয়েছে এভাবে-

” উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসং সবরী বালী।

মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী ॥”

চর্যাপদে কাপালিক, যোগী, ডোম্বী, চণ্ডালী, ব্যাধ, শবরী, তাঁতি, ধুনুরী, গুঁড়ি, মাহুত, নট-নটী, পতিতা নানান শ্রেণির কথা চর্যাপদে উঠে এসেছে। কয়েকটি চর্যায় ব্যাধ বৃত্তির কথাও বলা হয়েছে। ব্যাধকর্তৃক হরিণ শিকারের দৃশ্য ফুটে উঠেছে ৬ নং চর্যায়। যেমন-

“কাহেরে ঘিনি মেলি আছহু কীস।

বেঢ়িল হাক পড়ই চৌদীস ॥

অপণা মাংসে হরিণা বৈরী।

খনহ না ছাড়ই ভুসুক অহেরী ॥”

হরিণ তার মাংসের জন্য সবার কাছে শত্রু হয়ে ওঠে- তার মাংসের জন্য সকলে তাকে হত্যা করতে চায়। শিকারি সারাক্ষণ তাকে অনুসরণ করে, এক মুহূর্তের জন্যও তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। হরিণ তাই তৃণ-জল পরিত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যেতে চায়। আসলে এটা রূপকও বটে- তৎকালীন সমাজে উচ্চবিত্তদের অত্যাচারে সাধারণ জনগণ যে অন্য কোথাও [টিলা, পর্বত, নগরের বাইরের গ্রাম) শান্তির জন্য আবাস গড়ে তুলেছিল তা এ থেকেই প্রমাণিত হয়। সমাজের খণ্ড চিত্র চর্যায় বিধৃত হয়েছে। তৎকালীন বাঙালির আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতির আভাস চর্যায় সহজেই পাওয়া যায়। একাধিক চর্যায় উল্লেখ থাকায় মনে হয় শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-শালি নিয়ে বাঙালির যৌথপরিবার গড়ে উঠতো। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বিয়ে করতে যাওয়া, নতুন ফসল উঠলে নারী-পুরুষের আমোদ করা, মেয়েদের অলংকার হিসেবে কঙ্কণ-কুণ্ডর-নূপুর-ফুলের ব্যবহার, যৌতুকের লেনদেনের বিষয়ে নিখুঁত চিত্র চর্যাপদে পাওয়া যায়। চর্যাপদ যে সমাজচিত্রের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে তা এক সময় মানুষের সামাজিক অবস্থানকেই প্রকাশ করে। চর্যাপদে যে জীবনধারায় চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে- তাতে উচ্চ জীবনধারার পরিচয় নেই। অধিকাংশ পদে অন্ত জেশ্রেণির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বেদনাবিধুর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। অসমিয়া, মগধ, উড়িষ্যা, বাংলা, কামরূপ- এসব অঞ্চলের বিস্তৃত পটভূমিকায় চর্যাপদের জীবনচিত্র অঙ্কিত হলে- চর্যাপদে নদীমাতৃক বাংলাদেশ এবং বাঙালির চিত্রই প্রতিনিধিত্ব করে।

প্রকাশ ভঙ্গি: চর্যাপদগুলোর প্রকাশ ভঙ্গিতে পরিমিতি বোধ আছে। এই পরিমিতি প্রকাশ ভঙ্গি শ্রেষ্ঠ শিল্পীরই লক্ষণ। চর্যাকারগণ মিতভাষণের মাধ্যমে অতি চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ জিনিসের ছবি তুলে ধরেছেন। যেমন-

“ভবনই গহন গম্ভীর বেগে বাহী।

দু’আন্তে চিখিল মাঝ ন থাহী ॥” [৫ নং চর্যাপদ]

প্রেম ও বেদনার চিত্র: চর্যাপদে প্রেম বেদনা ও রসের কথা আছে, নীরস ধর্মতত্ত্বগুলোকে রসমণ্ডিত করে তোলার জন্য চর্যাকারগণ কাব্যকে আদি রসাত্মক করে তুলেছেন। তাই বহু চর্যাতে শৃঙ্গার রসাত্মক রূপক লক্ষ করা যায়। যেমন-

দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই।

রাতি ভইলে কামরু জাই ।” [২নং চর্যাপদ)

যেমন- ‘জে জে আইলা তে তে গলা’-যা কিছু এসেছে সবাইতো গেল কেবল বেদনাই পিছনে পড়ে রইল। ড. অরবিন্দ পোদ্দার বলেন, “চর্যাগীতির মধ্যে ইতস্তত যে খণ্ড ও পরিপূর্ণ চিত্র ছড়ানো রয়েছে তার আলোচনা করলে একটি গভীর শূন্যতা বোধের চিত্র ফুটে উঠে ।

বাস্তবচিত্র ও কাব্যরস: প্রকৃতপক্ষে চর্যাকারগণ বাস্তব উপাদানের সহায়তায় পাঠক ভাবের জগতে নিয়ে গেছেন। বাইরের আড়ম্বরের সীমারেখা ছাড়িয়ে মনের মধ্যে নিরাবয়ব পরম প্রিয়াকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মানব মনের ব্যাকুলতা প্রকাশমান। মহাসুখ পাওয়ার উদ্দেশ্যে সবকিছু ত্যাগ করে সাধনার পথে বিচরণ করা বিভিন্ন উপায়ে সাধনার যে স্বরূপ চর্যাকাররা প্রকাশ করেছেন তাতে তাঁদের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা কাব্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কাব্যময় ভাষায় খচিত সাধকের মনের না পাওয়া বেদনাই প্রকাশ পেয়েছে। তার বস্তুর কাব্যময় পরিবেশনে চর্যাপদের গুরুত্ব কম নয়। চর্যাপদের ভাবে আছে। জীবনবোধ ও ধর্মানুভাব, কিন্তু ভাষা বিন্যাসে আছে শিল্পীর সচেতন প্রয়োগ। বক্তব্যে আছে বাস্তব ও অন্তরঙ্গ জীবন চিত্র কিন্তু প্রকাশভঙ্গিতে আছে কবিতার রূপ প্রকরণ যেখানে বিদ্যমান শব্দ ও অলংকার সজ্জার আভিজাত্যের উজ্জ্বল প্রচ্ছদ। চর্যাকারদের কবিত্ব শক্তি ছিল। তাদের রচনার প্রতীক ও রূপকের সাহায্যে। চিত্র সৃষ্টি, আখ্যানের ইঙ্গিত তাতে মানবাত্মার সুখ, দুঃখ, বিরহ, মিলনের দৈনন্দিন বাস্তব জীবন চিত্র রূপায়িত হয়ে চর্যার দর্শন ও তত্ত্বেও নিষ্প্রাণতাকে কাব্যরসের স্পর্শে সঞ্চারিত করেছে।

“বাক্যং রসাত্মকং কাব্যং” রসবাদীদের এ সংজ্ঞা অনুযায়ী চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্যও কম নয়। রসের মধ্যে আদিরসই শ্রেষ্ঠ। আদি রস ছাড়াও এতে রয়েছে কোমল ও করুণ রসের কাব্যিক আয়োজন। এ ভাব সংবেদ্যরসমণ্ডিত কাব্যস্রোত যদি চর্যাপদের শ্লোকগুলোতে প্রকাশিত না হতো, তবে তা নিছক ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পূজার্চনায় ব্যবহৃত হতো, জীবনরোধ সাহিত্য চর্যায় প্রয়োজন হতো না। সিদ্ধাচার্যরা এ রস সৃষ্টিতে দুর্লভ মমতা প্রকাশ করায়, তা সাহিত্যের মনিকোঠার নিজস্ব সত্তা গড়ে তুলেছে।

ছন্দ: চর্যাপদের ছন্দে সংস্কৃত পুজরুটিকা ছন্দের প্রভাব রয়েছে- তাছাড়া চর্যার ছন্দ মূলত মাত্রাপ্রধান ছন্দ। পুজরুটিকা ছন্দের প্রতি চরণে যোল মাত্রার চরণে চার পর্ব। প্রতি পর্বে চার মাত্রা আবার শৌরসেনী প্রকৃত প্রভাবিত মাত্রা প্রধান পাদাকুলক ছন্দের সাথেও চর্যায় ছন্দের মিল রয়েছে। পাদাকুলক ছন্দের চরণ ও ঘোল মাত্রার প্রতি চরণে চার পর্ব। প্রতি পর্বের চার মাত্রা। চর্যাপদের ছন্দ মাত্রাবৃত্ত রীতিতে গঠিত হলেও মাত্রাবৃত্তের বর্তমান সুনির্দিষ্ট গণনা পদ্ধতি এতে মানা হয়নি। চর্যাপদের ছন্দে সাধারণত চরণের শেষ পর্ব দীর্ঘ মাত্রার দুটি অক্ষর হিসেবে বিবেচিত হয়। কোথাও কোথাও শেষ অক্ষরটি পুরা দ্বিমাত্রিক হয়নি। পরবর্তীকালে এগুলো অবলম্বন করেই বাংলা ছন্দের একাবলী, পয়ার ত্রিপদী ছাড়াও জয়দেবের গীতিগোবিন্দ কাব্যেও চর্যাপদের ছন্দের ব্যবহার দেখা যায়। চর্যাপদ থেকে উদাহরণ –

ক. কমল কুলিশ ঘান্টি/ করহু বিআলী= ৮+৬

খ . তরঙ্গেতে হলিনাত/ খুর ন দীসই= ৮+৬

গ. অবণা পবণে কাহ্ন/ বিমণা ভইলা= ৮+৬

চর্যাপদের ভাষা ও অলংকার বিশ্লেষণ: চর্যাপদে ভাষার ক্ষেত্রে অর্থালংকার ও শব্দালংকারের সুষম প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। চর্যার অলংকার ও অনুপ্রাসের ব্যবহার আমরা যত্রতত্র দেখতে পাই। অলংকার শাস্ত্র অনুযায়ী বিচার করলে দেখতে পাই এর রূপরস কাব্যময়। শাস্ত্রানুযায়ী অলংকার দুই শ্রেণির- ক. শব্দ অলংকার ও খ. অর্থালংকার। শব্দালংকারের মধ্যে চর্যাপদে সর্বাধিক অনুপ্রাস অলংকারের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। চর্যাপদে এর অভাব নেই। যেমন-

ক. “ভব নিব্বাণে পড়হ মাদলা।

মণ পৰণ বেণি করও কশালা।

খ. “মারি সাসু, নন্দ ঘরে সালী।

মাঅ মারি কাহ্ন ভইঅ কবালী।”

প্রবাদ প্রবচন ও ধাঁধা: চর্যায় বহু ধাঁধা ও প্রবাদ প্রবচনের উল্লেখ আছে। প্রবাদ প্রবচন ও ধাঁধায় চর্যার সাহিত্যিক মূল্য অসীম।

ক. অপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ [৬ নং চর্যা]

খ. দুহিলা দুধু কি বেল্টে সামাই। [৩৩ নং চর্যা]

গ. উদক চান্দ জিন সচ্চন মিচ্ছা। [২৯ নং চর্যা]

ঘ. নিসিত আন্ধারী মুসার চারা। [২১ নং চর্যা]

উপমা রূপক: চর্যাকারগণ উপমা রূপক সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশের অতিপরিচিত পরিবেশ ও সাধারণ জীবন থেকে। নদী ও নৌকা, তীর ও সাঁকু, ঘাট, পাটনী, সোনা, রুপা, কুটির, থালা-বাসন, গাছ, ফুল, তুলা এসব দ্রব্য চর্যাগীতিতে উপমা রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-

“কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।

চঞ্চল চীএ পইঠা কাল ।” [১ নং চর্যা]

চর্যার বিশ্ব: সমাজ সংস্কার ও লৌকিক ধর্মবোধের পটভূমিতে চর্যার জগৎ কল্পনা করা হলেও এর উত্তরণ হয়েছে আধ্যাত্মিক জগতে। সেখানে ধর্মের নৈরাত্মার দেবীও এ ধরনের কল্পনারই ফল। তবে ধর্মদর্শন, কাব্যদর্শন এবং জীবনদর্শনের একীভূত রূপই চর্যার বিশ্ব পরিকল্পিত।

সাহিত্যিক মূল্য হিসেবে চর্যাপদ: চর্যাগীতিকারগণ সংস্কৃত কাব্যের রীতিতে পদ রচনা করেননি। তাঁদের সহজ সরল প্রচেষ্টা ও প্রকাশের ভঙ্গিতে নতুন ছন্দ জন্মনাভ করেছে। যুগযুগান্তরের সীমা পার হয়ে সে ছন্দ ও সুর আজও বাংলার জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে আছে। ভাবের কেতাবী বন্ধনকে ভেঙে কবিরা তাকে লোকায়িত করে তুলেছেন। তাই জয়দেবকে সংস্কৃত রীতিনীতি বর্জন করে সম্পূর্ণ অভিনব কাব্য করতে এবং অলৌকিক বিষয়বস্তু অবলম্বন করে সম্পূর্ণ লৌকিক মনোভাব ব্যক্ত করতে দেখা যায়।

চর্যার গানে বিভিন্ন প্রকার রাগের উল্লেখ রয়েছে। আমরা দ্বাদশ শতাব্দীতে ‘গীতি গোবিন্দ’ ভণিতার প্রয়োগ দেখি। তার পূর্বে কোনো কবি ভণিতার প্রয়োগ করেননি। তাছাড়া চর্যাপদের ন্যায় গীতি গোবিন্দের প্রত্যেক শ্লোকে মিল রয়েছে। সুতরাং একথা সুস্পষ্ট যে ভণিতা ও রীতিতে জয়দেব তাঁর পূর্ববর্তী চর্যাপদ হতে পেয়েছিলেন। ‘গীতি গোবিন্দই’ বৈষ্ণব পদাবলীর আদি উৎস। আবার বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ জয়দেবের কয়েকটি পদের অনুবাদ রয়েছে। তাছাড়া চন্ডীদাসের কাব্যে প্রত্যেক পদের শীর্ষে রাগের উল্লেখ আছে এবং প্রত্যেক পদের শেষে ভণিতা আছে।

চর্যাপদ যে বৈষ্ণব পদাবলীর আদি উৎস তাও লক্ষ করা যেতে পারে চর্যাপদগুলোর গানে। আর এ গানের ধারা বৈষ্ণব পদাবলী হতে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল পর্যন্ত চলে গেছে। চর্যাপদগুলো রূপকের আবরণে কেন্দ্র করে রচিত। আর এ গীতিকাগুলো ভণিতাযুক্ত। পরবর্তীকালে শুধু বৈষ্ণব পদাবলীই নয়, সমসাময়িক সমগ্র বাংলা কাব্যে চরণের শেষে অনুপ্রাস ও পদের শেষে ভণিতা ব্যবহৃত হয়েছে। তদুপরি ভাব, ভাষা, গান প্রভৃতি দিক থেকে পদাবলির সাথে চর্যাপদের নিবিড় সংযোগ রয়েছে।

ভাষা, ছন্দ ও রূপনির্মিতিতে এঁরা যে সুদক্ষ ছিলেন তা অনস্বীকার্য। বুদ্ধিগ্রাহ্য দার্শনিকতা ও রহস্যময় আচার-আচরণকে অনেক স্থলেই এঁরা কাব্যলোকে উন্নীত করেছেন। নির্বাণতত্ত্বকে কোনো কোনো পদকর্তা নিজেকে দয়িতারূপে বর্ণনা করেছেন, তাই নির্বাণ লাভের আকাঙ্ক্ষা কাব্যমন্ত্রে পরিসুদ্ধ হয়ে প্রিয়মঙ্গল কামনায় রক্তিম হয়ে উঠেছে। ভাবের দিক থেকে চর্যাপদে স্থানে স্থানে বাহ্যভাবে শৃঙ্গার রসের পরিচয় পাওয়া যায়। এই অথবা, পদগুলোতে পরমতত্ত্ব শূন্যকে শূন্যতা বা নইরামণি (নৈরাত্মা) অথবা, বলে তাকে যোগিনী (সাধনসঙ্গিনী), দারী, (গণিকা), ডোম্বী, (ডুমনী বা নটী), মেহেরী (মহিলা) রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এতে মূলত আদিরস দৃষ্ট হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে-

ক. ‘জোইনি তঁই বিনু খনহিন জীবমি।

তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমী।’

খ. “আলো ডোম্বি, তোএ সম করিব মো সাঙ্গ।

নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাঙ্গ ॥”

গঠনগত দিক দিয়ে আমরা দেখতে পাই চর্যাপদগুলো গীত। তাতে পটমঞ্জরী, গুঞ্জরী, দেশাক্ষ, কামোদ, ধনসী, রামক্রী, বরাড়ী, মল্লারী, মালশী, বঙ্গাল, শবরী, কাহ্নগুর্জরী প্রভৃতি রাগ আছে। প্রতি পদের শেষে ভণিতা আছে।

‘ভণই লুই আমহে ঝানে দীঠা।

ধমণ চমণ বেণি পীণ্ডি বইঠা।’ (লুইপা)

‘অইসন চর্যা কুকুরী পাত্র গাইল।

কোড়ি মাঝে একু হিঅহি সমাইল।’ (কুকুরীপা)

চর্যাগীতি বাংলাসাহিত্যের উপরে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। আমরা দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেবের গীতিগোবিন্দে এরকম ভণিতার প্রয়োগ দেখি। তাঁর আগে আর কোনো সংস্কৃত কবি ভণিতা ব্যবহার করেননি। যেমন-

শ্রীজয়দেব-ভণিতমিতি গীতম্।

সুখয়তু কেশবপদমুপনীতম্ ॥

‘ভণতি জয়দেব-কবিরাজ রাজে।’ গীতিগোবিন্দের গীতগুলোতে আমরা মালব, গুর্জরী, বসন্ত, রামকিরী, কর্ণাট, বরাড়ী, ভৈরবী, বিভাস প্রভৃতি রাগের প্রয়োগ দেখি।

চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্যর কথা বিবেচনা করে ড. সুকুমার সেন মন্তব্য করেছেন, “চর্যাগীতিগুলো বৈষ্ণব পদাবলির পূর্বরাগ। পদাবলির মতো এতেও রাগরাগিণীর উল্লেখ আছে এবং কবিরও ভণিতা আছে। ভাবের দিক দিয়ে বিচার করলে বৈষ্ণব সহজিয়া সাধকের রাগাত্মিক পদের সাথে চর্যাপদের মিল খুজে পাওয়া যায়। চর্যাপদ জ্ঞানের বিষয় নয়, ভাবের বিষয় এবং তা উপযুক্ত শিল্প মাধ্যম।”

উপরিউক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায়, চর্যাপদে বৌদ্ধদের সাধনতত্ত্বের মর্মকথা বা তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণের যে প্রণালি বর্ণিত হয়েছে তা আবহমান বাংলার বা বাঙালির সামগ্রিক ও সামষ্টিক এবং সাংসারিক জীবন চিত্র ফুটে উঠেছে। যে সাহিত্যে সমাজের সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠে তার সাহিত্যিক মূল্য প্রশ্নাতীত। তাই চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এছাড়া চর্যাপদের সকল সাহিত্যের লক্ষণ বর্তমান। তাই চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম। সর্বোপরি এসব পদগুচ্ছে তৎকালীন সাধারণ (সময়ে সময়ে হীন অন্ত্যজ) বাঙালির প্রতিদিনের ধূলিমলিন জীবনচিত্র, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার টুকরো টুকরো রেখাচিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, দর্শন এবং আদি বাংলা সাহিত্যের সার্থক দৃষ্টান্ত হিসেবে “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” একটি স্মরণীয় গ্রন্থ। এটি আবিষ্কৃত না হলে আদি যুগের বাংলাভাষা অজ্ঞাতই থেকে যেত।

আরো পড়ুনঃ চর্যাপদের কাল নির্ণয় কর