চর্যাপদ যে সময়ে রচিত, তখন বাংলা ভাষার নিতান্ত অপরিণত অবস্থা। সবেমাত্র সে অপভ্রংশের গর্ত থেকে বহির্গত হয়ে নূতন পথে যাত্রা শুরু করেছে। আজ যে ভাষায় আমরা কথা বলি, মনের ভাব প্রকাশ করি এবং সাহিত্য রচনা করি, সে ভাষার সঙ্গে চর্যাপদের ভাষার এত বিরাট পার্থক্য যে, চর্যার ভাষা বাংলা কিনা তা নিয়ে এককালে পণ্ডিত মহলে বিতর্কের ঝড় বয়ে গেছে। তবে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় দেখলেন, চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন। এর কতকগুলি শব্দ, বাকভঙ্গি, উপমা, রূপক ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিচারে সেগুলি বাঙলার সমাজ জীবনে দীর্ঘকাল ধরে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। তাই চর্যার ভাষাকে বাংলা বলে স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা রইল না। চর্যাপদের সাহিত্যিক গুণ যাই থাক, এর ভাষা বড়ো গুণ। এ ভাষার অনুধাবনের বাধাই চর্যাপদের রস গ্রহণের প্রধান অন্তরায়। তবে চর্যাপদের যে সুগভীর কাব্যরস আছে তা আমাদের মাঝে মাঝে বিস্মিত চমকিত করে, এর প্রতিটি পদে বর্ণনার চিত্রময়তা আমাদের মনকে দোলা দেয় তার কাব্যগুণে।
চর্যাপদে বাস্তব অথচ কাব্যময় নিখুঁত দৃশ্য ছায়াছবির মতো পাঠকের মনের চোখের উপর দিয়ে ভেসে যায়। প্রকৃতি ও মানুষকে কত নিবিড় ভাবে চিনতে এবং ভালোবাসলে এই ছবিগুলি আঁকা যায় তা সহজেই অনুমেয়। “ঐ যে টিলার উপর ঘরটি যেখানে হাঁড়িতে ভাত নেই, নিত্য তবু সেখানে অতিথি ; ঘরের আঙিনায় তেঁতুল গাছটি যার ফলভোগে বৃক্ষস্বামীর অধিকার নেই; নতুন বধুটি যার কানের কানেটটি রাত্রিতে চোরে নিয়ে গেছে শ্বশুর ঘুমোচ্ছেন, জানেন না কি সর্বনাশ হয়ে গেছে; রাত্রিতে সেই বধূর বিষণ্ণ মুখটি ; একতারা বাজিয়ে যে যোগী মনের আনন্দে নেচে চলেছে পথে পথে অব্যক্তভাবে বিভোর হয়ে ; মাদল বাজিয়ে জাক জমক করতে করতে বর চলেছে নতুন সঙ্গিনী আনতে ; যেখানে মেলেনি বাসরঘর নতুন বধূ রমণী পরিবৃত একটি অচেনা রহস্য”—তার ছবিটি কত নিখুঁত ভাবে সামান্য দুটি চারটি কথায় ফুটিয়ে তোলা। এই অজস্র কাব্যময় চিত্র চর্যাপদের ছত্রে ছত্রে। ‘অরণ্যের নিভৃত অন্ধকারে মৃত্যুর মতো ভয়ংকর শিকারীর জাল বিছিয়ে হরিণ ধরা, ভীত সন্ত্রস্ত হরিণের জল গ্রহণ না করা, তৃণ বর্জন করা, শান্ত পাহাড়, পুষ্পিত গাছ, স্রোতময়ী নদী, বিহ্বল জ্যোৎস্না, দীপ্ত মন্দির, অন্ধকার ঘরে চঞ্চল মুষিক, তিন ধাতুর ঘাটে পান মুখে বক্ষলগ্ন বধুর সাহচর্যে মিলন বিধুর প্রেমিক শান্ত সন্ধায় আরতির ঘণ্টা, গোয়ালে গোরু এবং গোরুর দুধ দোয়ানো এবং ফেনময় দুধের উষ্ম সুগন্ধ’ প্রভৃতি দৈনন্দিন জীবনের কাব্য মধুর চিত্রগুলি এ কাব্যের সামগ্রী। বাংলা কাব্যে এই বাস্তবতার প্রথম উদ্বোধন চর্যাপদে। তাই চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য নগণ্য নয়।
শুধু বাস্তববোধই নয়, ভাবের জগতেও পাঠককেও নিয়ে যেতে এর সিদ্ধাচার্যরা ব্যর্থ হননি। এই বাস্তব উপাদানগুলির সাহায্যে সিদ্ধাচার্যরা পাঠককে ভাবের রাজ্যে নিয়ে যেতে। চেয়েছেন, পাঠকের মন ভরিয়ে দেবার জন্য সেই উপাদানগুলি দরকার যাকে ইন্দ্রিয় দিয়ে বোঝা যায় চেনা যায়। তাই যখন বলা হচ্ছে চিত্তজ মোহের কথা—তখন উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে গাছ এবং তার ডাল বা ফল। সেই গাছ তো চিরজীবী নয় একদিন না একদিন তার ধ্বংস হবেই, তেমনি চিত্তজ মোহ নিয়ে মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকতে পারবে না, বাসনা কামনা তাকে পরম সুখ দিতে পারবে না। আবার মিথ্যা ধ্যানে, মিথ্যা মন্ত্র উচ্চারণে, মহামূল্য নৈবেদ্য সাজিয়েই কি মূঢ় হৃদয় সেই পরম সুখের সন্ধান পেতে পারবে ? এই সব বাইরের জিনিস দিয়ে সেই অন্তরতমের সন্ধান পাবে কে? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ঃ “নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে, দেবতা নাই ঘরে।” এই বাইরের আড়ম্বরটাই যে জীবনে বড় নয়, বাইরের রাস্তাটি ভিতরে যাওয়ার প্রবেশ পথ মাত্র, এই তত্ত্বটি সুগভীর কাব্যময় বোধের দ্বারা চর্যাপদে প্রকাশিত। তাই ভাববস্তুর কাব্যময় পরিবেশনে চর্যাপদের স্থান অবহেলার নয়।
কাব্যবিচারে অনেকে অনুভূতির চেয়ে শাস্ত্রকে প্রাধান্য দেন, অলঙ্কার শাস্ত্রানুযায়ী বিচার করবার চেষ্টা করেন এর রূপ, রস রীতি কাব্যময় কিনা? যাঁরা এই ভাবে কাব্য বিচার করে আনন্দ পান চর্যাপদ তাঁদেরকেও নিরাশ করে না। অলঙ্কার মূলত দুই শ্রেণির শব্দ ও অর্থ অলংকার। শব্দালঙ্কারের মধ্যে প্রথম জিনিস অনুপ্রাস। চর্যাপদে এর অভাব নেই—
বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বটিত উইল উছারা।
কিন্তো মন্তে কিন্তো তত্তে কিভোরে ঝাণ বখানে।
এই বৃত্ত্যনুপ্রাস ছাড়া অন্ত্যানুপ্রাস প্রায় প্রতিটি চর্যার ছত্রে ছত্রে নিহিত। এছাড়া
“সোনে ভরিলি করুণা নাবী।
রূপা থোই নাহি কো ঠাবী।।
এখানে সোনা অর্থে–সুবর্ণ ও শূন্যতা ; রূপা অর্থে রৌপ্য এবং রূপের জগৎ হওয়ায় শ্লেষ অলঙ্কার। কাকু বক্রোক্তিরও অভাব নেই—
‘মোকস কি লবভই পানি হাই।
স্নান করলেই কি মোক্ষলাভ করা যায়?
অথবা
“রাজ সাপ দেখি জো চমকিই খানে কিং তাং বোড়ো খাই।”
রজ্জু সর্প দেখে সে চমকে ওঠে তাকে কি সত্যি সত্যি সাপে কাটে? এতো গেলো শব্দালংকার, অর্থালঙ্কারেরও বিস্তর উদাহরণ চর্যাপদে নিহিত। যেমন—
-
ফিটোলি অধারিরে আকাশ ফুলিআ ( আকাশ কুসুমের মতো অন্ধকার ছুটে পালালো)– উপমা
-
বলদ বিআত্রল গাবিআ ঝাঁঝে- বিরোধ
-
জামে কাম কি কামে জাম—সন্দেহ, ইত্যাদি অলঙ্কারের অস্তিত্ব চর্যাপদের ছত্রে ছত্রে দৃষ্ট হয়।
শুধু বিভিন্ন অলঙ্কার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সিদ্ধাচার্যরা সফল নন, রসসৃষ্টির দিকে তাঁদের বেশ লক্ষ্য ছিল। চর্যাপদে সিদ্ধাচার্যরা যে না পাওয়ার বেদনা প্রকাশ করেছেন বা যাকে অত্তর দিয়ে কামনা করেছেন তাকে অবশেষে না পাওয়ার যে কথা প্রকাশ করেছেন, তা ব্যক্তি জীবনের অর্থাৎ লৌকিক জগতে পাওয়া না পাওয়ার কথা নয়, তা নিখিল মানবের ঘনীভূত শোকের ভাব বা অপার্থিব প্রাপ্তির সুখানুভূতি। রবীন্দ্রনাথের একটি গানে পাই—
“কাছে আছি তবু ও কোনও বাধা আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, মিলনের মাঝখানেও আমি বিরহ কারায় আবদ্ধ।”
এই বেদনার হাহাকার একটি বিরহিণী কে কেন্দ্র করে ব্যক্ত হলেও নিখিলের সমস্ত বিরহিণীর বেদনার অশ্রুজলে সিঞ্চিত এই করুণ আর্ত হাহাকার অনুরূপভাবে চর্যায় সরহপাদে শান্তি পাদ, ভুসুকু এমনকি কাহ্নপাদেরও অনেক চর্যায় এই করুণ রস বিরহ বেদনা ও না পাওয়ার যন্ত্রণাকে অবলম্বন করে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। জানি না, সেই পাওয়া কী ধরনের, কী ধরনের ধর্মাচরণ করলে সেই পাওয়া হৃদয়ে অনুভব করা যাবে—কিন্তু একথা ঠিক, চর্যার ধর্ম ও দর্শনের অনুভূতি পার হয়েও এখানে এই আকুল ক্রন্দন শুনে সমস্ত মনটা গুমরে গুমরে উঠেছে। এই ভাব সংবেদ্য রস মণ্ডিত কাব্যস্রোেত যদি চর্যাপদের শ্লোক গুলিতে প্রকাশিত না হোত, তবে নিশ্চয়ই তার কোনও মূল্য আমাদের কাছে থাকতো না।
শব্দ ব্যবহারের সুকৌশল পদ্ধতির সাহায্যে ভাবানুযায়ী ধ্বনি মাধুর্য সৃষ্টির দিকেও সিদ্ধাচার্যদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল। প্রবল স্রোতে দুরন্ত গতিতে দুর্গম নদীর কথা যখন চটিলপাদ বলছেন তখন নদীর বর্ণনায় যে শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন তার দ্বারাই দুস্তর ভয়াল রূপটি শ্রুতি গ্রাহ্য রূপে ফুটে উঠেছে। যখন বলছেনঃ “ভবনই গহন গম্ভীর বেগে বাহী’ দুআস্তে চিখিল মাঝে না থাহী।” এই বাক্য ও শব্দের ব্যবহারের দ্বারাই নদীর ভয়ংকর রূপটি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। হরিণ শিকারের একটি দৃশ্যে ভুসুকু শিকারের ভয়াল নৃশংস রূপকে নিঃশংসয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার যেখানে বেদনার কথা, হতাশার কথা, ব্যাকুলতার কথা, সেখানেও মিষ্ট ও স্নিগ্ধ ললিত শব্দ ব্যবহারের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়—
“অপনে রচি রচি ভবসিবানী।
মিছে লো’ত্র বান্ধবএ আপক্ষ।”
ছন্দের দিকে এবং চর্যাগুলির আঙ্গিক গড়নের দিকে সব শেষে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মতো। চর্যাপদকেই আমরা বাংলা কাব্যের প্রাচীনতম নিদর্শন বলে ধরে থাকি। বাংলা গীতি কবিতার উৎস নির্ণয়েও চর্যাপদের স্থান তেমনি গুরুত্বপূর্ণ, আরও একটা দিকে চর্যাগুলি বাংলা পদাবলী সাহিত্যের আদর্শ স্থানীয়। কারণ বাংলা ভাষায় রচিত পয়ারের প্রাচীনতম নিদর্শন আমরা চর্যাপদে প্রথম পাই, ছন্দের দীর্ঘপয়ার, লঘুপয়ার, ত্রিপদী দশক্ষরা বা দিগক্ষরা এমনকি চোদ্দটি পংক্তিতে রচিত সম্পূর্ণ কবিতার নিদর্শন চর্যাপদে দেখা যায়। বিশেষ আকর্ষণীয় দশাক্ষরা ছন্দের একটা নমুনা হল—
“নিন্দু নাদ ন হিত্র পইঠা।
অন চাহস্তে আণ-বিনঠা।।
চর্যাপদের সাহিত্যিক মূল্য ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রমাণ করা গেলেও কিন্তু কাব্য বিচারে এই সমস্ত মাপকাঠিই সব নয়। সবচেয়ে বড়ো মাপ কাঠি পাঠকের অনুভূতি। যদি সেই অনুভূতিতে কোনো কাব্য নাড়া দিতে পারে তবে তার ভাষা ছন্দ অলঙ্কার প্রয়োগের অসম্পূর্ণতা থাকলেও তা-ই সত্যিকার কাব্য। ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কারের দিকে চর্যাপদ নিশ্চয় ত্রুটি মুক্ত নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও চর্যাপদকে সুষ্ঠু সুন্দর কাব্য বলে স্বীকার করতে দ্বিধা হয় না, কারণ চর্যাপদে আছে সুগভীর মানবতাবোধের নির্মল অনুভূতি। চর্যাপদ সেই দিক দিয়ে অমূল্য সৃষ্টি।
Leave a comment