আকস্মিকভাবে পৃথিবীর নূতন কোনও ভূখণ্ড আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে যেমন (পৃথিবীর মানচিত্র ও ইতিহাসের পরিবর্তন সাধিত হয়। অনুরূপ প্রাচীন একখানি গ্রন্থ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সমগ্র সাহিত্যের ইতিহাসকেও বদলে দিতে পারে। পুরাতন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমনই একটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। পর পর দু’খানি গ্রন্থ আবিষ্কারের ফলে সমগ্র বাংলা সাহিত্য ও ভাষা একটা দুর্জয় পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। এক, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ভজন-গীতিকা যা ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামে পরিচিত। আর একটি হোল বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য। প্রথমটি যেমন আদি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন তেমন দ্বিতীয়টি মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন। এক কথায় উক্ত দুটি গ্রন্থের সন্ধান যদি না মিলতো পুরাতন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা দুরূহ হয়ে পড়তো। এই বিষয়ে যিনি কৃতিত্বের দাবী রেখেছেন তিনি হলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। প্রাচীন বাংলা ভাষা যখন সংস্কৃত প্রাকৃত স্তরকে অতিক্রম করে অবশেষে অপভ্রংশের জঠর থেকে জন্মগ্রহণ করছে সেই সময় বাংলা সাহিত্যের উষালগ্নে ২৪ জন কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয় সাধনতত্ত্বের গান, তা সাম্প্রতিক কালে ‘চর্যাগীতি’ নামেই খ্যাত।

চর্যাপদের আবিষ্কার:

সমগ্র প্রাচীন যুগের বালা সাহিত্যের ইতিহাসের জন্য যে একটিমাত্র গ্রন্থের উপরই আমাদের একান্তভাবে নির্ভর করে থাকতে হয়, সেটি ‘চর্যাপদ’। ১৯০৭ খ্রীঃ মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের পুঁথিশালা থেকে কিছু পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে এগুলিকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে প্রকাশ করেন (প্রকাশকাল ১৯১৬ খ্রীঃ)। শাস্ত্রী মহাশয় প্রাপ্ত গ্রন্থের যাবতীয় রচনার ভাষাকেই বাঙলা’ বলে মনে করলেও ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নিঃসন্দিগ্ধভাবে প্রমাণ করেন যে গ্রন্থস্থ বৌদ্ধগানগুলির ভাষা প্রাচীন বাঙলা হলেও দোহাগুলির ভাষা প্রাচীনতর অবহটঠ। উল্লেখ করা প্রয়ােজন, শাস্ত্রী মহাশয়ের আবিষ্কৃত পুঁথিগুলির মধ্যে চর্যাপদ ছাড়াও ছিল কৃষ্ণাচার্যের দোহা, সরহপাদের দোহা এবং ডাকার্ণব।

চর্যাপদের রচনাকালঃ

প্রাচীন বাংলা ভাষার অদ্বিতীয় নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ শুধু ধর্মের রহস্যেই ভরা নয়, তার রচনাকালও বিশেষ সংশয়যুক্ত। ভাষাতত্ত্বের প্রতিনিধি স্থানীয় পণ্ডিত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ সম্বন্ধে বিশেষ মতামত পোষণ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার তাঁর– ‘The Origin and Development of Bengali Language’ নামক গ্রন্থে এবং ড. প্রবোধ চন্দ্র বাগচী তাঁর ‘Dohakosa’ গ্রন্থে চর্যার রচনা সময় ১০ম-১২শ শতাব্দীর মধ্যে চিহ্নিত করেছেন। ভাষাতত্ত্বের বিচারেও এর অনেক পদ ১২শ শতাব্দীর রচিত বলে মনে হয়।

আবার ড. শহীদুল্লাহ এবং পণ্ডিত রাহুল সংস্কৃত্যায়নের মতে, দোহা ও চর্যার রচনাকালকে আরও দু’শত বছর পিছিয়ে দিয়ে ৮ম-১২শ শতকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। রাহুলজী তাঁর ‘পুরাতাত্ত্বিক নিবন্ধাবলী’ গ্রন্থে ‘Journal Asiatique’ নামক পত্রিকায় দেখাতে চেয়েছেন লুইপাদ ও সহরপাদ দুজন সিদ্ধাচার্য যারা চর্যা পদকার, তাঁরা ছিলেন ধর্মপালের সমসাময়িক (৭৬৯-৮০৯ খ্রিঃ) এবং ড. শহীদুল্লাহ ‘সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার’ আলোচনায় ভুসুকু ও কাহ্নপাদকে ৮ম শতাব্দীর অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। পণ্ডিত বর্গের এই সমস্ত অভিমতের উপর নির্ভর করে চর্যাপদের রচনাকালকে মূলত ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে স্থাপন করা যেতে পারে।

চর্যাপদের গুরুত্ব:

প্রাচীন বাঙলা ভাষা-বিষয়ে আলােচনার যােগ্য উপাদান বলতে একমাত্র এই চর্যাপদএই যুগে বাঙলা ভাষায় রচিত অপর কোন গ্রন্থের সন্ধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। প্রাচীন তথা মধ্যযুগের বহু গ্রন্থের ভাষাই বহু প্রচলিত বলে অনেকটা পরিবর্তিত হলেও আমাদের ভাগ্যক্রমে লােকলােচনের অন্তরালে থাকায় চর্যার ভাষার প্রাচীনত্বটুকু বজায় রয়েছে। ফলে ভাষাবিজ্ঞানীদের নিকট এর মূল্য অসাধারণ। সচেতন সাহিত্যরূপে রচিত না হলেও চর্যাপদে যে মাঝে মধ্যে স্বভাবকবিত্বের স্ফুরণ দেখা যায়, তা অস্বীকার করা যায় না। আবার সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনে দিক-নির্দেশক-রূপে চর্যাপদের স্থান একক; বাঙলার ধর্মবিবর্তনের ইতিহাসেও চর্যার মূল্য অসাধারণ। বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্ম—উভয়েরই অবক্ষয়িত রূপের একটা সুন্দর চিত্র পাওয়া যায় চর্যাপদে। সর্বোপরি সমকালীন সমাজজীবনের এমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা- জাত চিত্র তাে অন্যত্র দুর্লভ। এই সমস্ত কারণে, যথার্থ সাহিত্যের বিচারে চর্যাপদ উচ্চমানের না হলেও ভাষাবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং ধর্মৰ্গবেষকদের নিকট চর্যাপদ অপরিহার্য সম্পদ বলেই বিবেচিত হয়ে থাকে।

চর্যাপদের নাম:

বৌদ্ধগানগুলিকে সাধারণভাবে ‘চর্যাপদ’ বা ‘চর্যাগীতি’ নামে অভিহিত করা হয়। শাস্ত্রী মহাশয় গ্রন্থটির প্রকৃত নাম অনুমান করেছিলেন ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ যার অর্থ—আচরণীয় এবং অনাচরণীয় বিষয় নির্দেশ। ডঃ সুকুমার সেন মনে করেন যে এর নাম হওয়া উচিত ছিল- ‘চর্যাশ্চর্য-বিনিশ্চয়’। গ্রন্থের মধ্যে মুনিদত্ত-কর্তৃক টীকায় এটিকে আশ্চর্য চর্যাচয় নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বিচারে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে মূল গ্রন্থটির নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষ’ এবং ‘চর্যাপদগুলি চর্যাগীতি’ নামে পরিচিত ছিল।

চর্যাপদের গ্রন্থ পরিচয়:

চর্যাগীতিকোষ’ গ্রন্থটি পাওয়া গেছে খণ্ডিত আকারে। এতে সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ এবং তেইশ জন কবির নাম পাওয়া গেছে। এর যে তিব্বতী অনুবাদ পাওয়া গেছে, তাতে আরও সাড়ে তিনটি পদ ও একজন কবির নাম পাওয়া যায়। অতএব সমগ্র চর্যাগীতিকোষে ৫০টি বা ৫১টি পদ ও ২৪ জন কবির ভণিতা ছিল। বিভিন্ন সুত্রে অনুমান করা হয় যে, মােট ১০০টি গীতি দুটি বিভিন্ন কোষে সঙ্কলন করা হায়েছিল। কিছুদিন পূর্বে ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল ও তরাই অঞ্চল থেকে আরাে ৯৮টি চর্যাগীত (চাচাগীত’) সঙ্কলন করেন, এদের মধ্যে অন্ততঃ ১৯টি গীত চর্যাগীতির সমকালীন বলে অনুমিত হয়।

চর্যাপদের কবি-পরিচয়:

চর্যাগীতি-রচয়িতাগণ ছিলেন সহজিয়া-পন্থী বৌদ্ধ-সাধারণতঃ ‘সিদ্ধাচার্য’ নামে এদের অভিহিত করা হয়। তিব্বতী গ্রন্থসূত্রে যে চৌরাশি সিদ্ধা’ র নাম পাওয়া যায়, চর্যাপদের ২৪ জন কবি তাদেরই অন্তর্গত। এই ২৪ জন কবির মধ্যে রয়েছে লুইপা, কুক্করীপা, চাটিলপা, ভূসুকুপা, কাহ্নপা, কামলিপা, ডােম্বীপা, শান্তিপা, বীণাপা, সরহপা, ঢেণ্যণপা, তাড়কপা, তন্ত্রীপা ইত্যাদি। চর্যাগীতিকার মধ্যে যে সকল সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায় তাদের অন্যতম কৃষ্ণপাদাচার্য বা কাহ্নপা এর রচিত পদের সংখ্যা ৯। ভুসুকপা ছিলেন চিত্রধর্মী কবি, এঁর রচিত পদের সংখ্যা ১২। সরহপা ও কু্করীপা প্রত্যেকে ৪টি করে পদ রচনা করেছেন। কাহ্নপা এবং সরহপা অবহটঠ ভাষায় কতকগুলি দোহাও রচনা করেছিলেন। অনেকে মনে করেন নাথগুরু মীননাথ লুইপা (রােহিত পাদাচাৰ্য) নামে দু’টি পদ রচনা করেন। শান্তিপা এবং শবরীপা-রও দুটি করে পদ পাওয়া যায়। অপর সিদ্ধাচার্যদের প্রত্যেকের একটি করে পদ পাওয়া যায়। এই সিদ্ধাচার্যগণ প্রত্যেকেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি—এঁরা কামরূপ, মিথিলা, উড়িষ্যা এবং গৌড়বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কালের দিক থেকেও এদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকা সম্ভব। চতুর্দশ শতকে রচিত জ্যোতিরীশ্বরের বর্ণরত্নাকর’ গ্রন্থে এদের সকলের নাম পাওয়া যায়—অতএব এই তারিখের পূর্বে এঁরা অবশ্যই বর্তমান ছিলেন। কোন কোন মতে আদি সিদ্ধাচার্য লুইপা সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর লােক। বিভিন্ন কালে এবং বিভিন্ন স্থানে রচিত পদগুলিতে সম্ভবতঃ মূলে কিছু ভাষাগত বৈচিত্র্য ছিল—পরে কোন এক সময়, অবশ্যই শতাব্দীর পূর্বে এদের সংস্কার সাধন করে অভিন্ন ভাষায় রূপায়িত করা হয়—এই অনুমান যথার্থ হওয়াই সম্ভব।

চর্যাপদের কাব্যমূল্য :

‘কাব্যং গ্রাহ্য মলঙ্কারাং’ আচার্য বামনের এই উক্তি চর্যাপদে বেশ সহজলভ্য। যেমন –বিরোধ অলঙ্কারের একটি দৃষ্টান্ত : “জো সো চৌর সোহ সাধি” (যে চোর সেই সাধি) আবার সাঙ্গরূপকের উদাহরণ— 

“মনতরু পাঞ্চ ইন্দি তসু সাহা। 

আসা বহল পতি ফলবাহা।।”

চর্যাপদের ভাষা যেহেতু ‘সন্ধ্যাভাষা’। তাই এর ভাব ও উদ্দেশ্য প্রতীকের মাধ্যমে বেশ সুন্দরভাবে সুপরিস্ফুট। যেমন—কাহ্নপাদ একটি পদে দাবা খেলার রূপকে বলেছেন— 

“করুণা পিহাড়ী খেলঠুন অবল। 

সদগুরু বোঁহে জিতেন ভববল।।”

কাব্য রসের দিক থেকে চর্যাপদ হল আদিরসের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। যেমন—“রাতি উইলে কামরু জাতন” প্রভৃতি পংক্তি বিশেষ স্মরণযোগ্য। আবার প্রেম কামনার চিত্ররূপে পাই— “তো মুহু চুম্বি কমল, রস পীবমি।” ইত্যাদি।

প্রাচীনতম এই বাংলা কাব্যে অর্থাৎ চর্যাপদে ছন্দ বৈচিত্র্যও পরিলক্ষিত হয়। যেমন— অড়িল্লা, পজঝড়ি, ত্রিপদী উল্লালা, পাদাকুলক ইত্যাদি। পজঝড়ি ছন্দের একটি দৃষ্টান্ত হল

“আলি কালি ঘণ্টা নেউর চরণে। 

রবি শশী কুন্ডল কিউ আভরণে।। 

এ সমস্ত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের গুরুত্ব অপরিসীম।

চর্যাপদের বিষয়:

চর্যাগীতিকোষে যে চর্যাগীতিসমূহ সঙ্কলিত হয়েছে, তা প্রধানতঃ আধ্যাত্মিকতা নির্ভর। গীতিকার সিদ্ধাচার্যগণ তাদের বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনভজন-সম্পর্কিত ব্যাপারসমূহ নিজেদের গােষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইতেন বলে এগুলিকে সংকেতে তথা ইঙ্গিতবহ রূপকাদির সাহায্যে পদগুলিতে প্রকাশ করেছেন। সাধারণভাবে পদগুলির যে অর্থ পাওয়া যায়, তাতে সমাজ-সংসারের বিচিত্র পরিচয় পাওয়া গেলেও তা গীতিকারের আসল উদ্দিষ্ট নয়। এর অন্তর্নিহিত যে অর্থযা গুরুমুখ থেকেই শুধু পাওয়া যেতে পারে, সাধন-ভজন-সম্পর্কিত সেই সমস্ত তত্ত্ব এবং তথ্যই পদগুলির প্রকৃত বিষয়বস্তু।

চর্যাপদের ভাষা:

চর্যাপদের ভাষা-বিষয়ে বিস্তর মতদ্বৈধ বর্তমান থাকলেও ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করেছেন যে, চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাঙলা। অবশ্য ঐ সময় ওড়িয়া ভাষা এবং অসমীয়া ভাষা বাঙলা ভাষার সঙ্গে অভিন্নভাবে যুক্ত থাকায় এদের দাবিও নস্যাৎ করা যায় না। চর্যার ভাষাকে বলা হয় ‘সন্ধ্যা ভাষা’ বা ‘আলাে-আঁধারি ভাষা’ অথবা সন্ধা ভাষা’ বা সম্যক অনুধাবন করে উপলব্ধি করবার ভাষা। ড. পবিত্র সরকার যার অর্থ করেছেন অভিসন্ধিমূলক ভাষা, অর্থাৎ গৃঢ় সাধন-পদ্ধতি প্রকাশক সংকেতমূলক গূঢ় ভাষা। আসলে এই নাম দুটি ভাষার পরিচয় নয়, বিষয়বস্তুরই পরিচয় বহন করে। বজ্রযানপন্থী বৌদ্ধগণ কালে সহজিয়া-পন্থী হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের সাধন পদ্ধতিকে অতিশয় গুহ্য বিষয়রূপে গ্রহণ করে এমনভাবে সংকেতে তাকে প্রকাশ করে যে, অপর সাধারণের পক্ষে এর মর্মগ্রহণ সম্ভবপর নয়। এদের শেষ কথা ‘গুরু পুচ্ছিআ জান’ অর্থাৎ গুরুকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে। এই কারণেই চর্যার ভাষাকে সন্ধ্যা ভাষা’ বা সন্ধা ভাষা’ বলে অভিহিত করা হয়।

চর্যাপদের দর্শন:

সহজিয়াগণ তাদের সাধনতত্ত্বকে বিভিন্ন রূপকের সাহায্যে প্রকাশ করেছেন। হয়তাে হিন্দুদের বিষয়ে তাদের প্রতিকূল মনােভাবের জন্যই তারা এই গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিল। চর্যার টীকাকার মুনিদত্ত চর্যাপদের দার্শনিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে একে ‘শূন্যবাদ’ নামে অভিহিত করেছেন। “শূন্যতাই একমাত্র সত্যশূন্যতার মধ্যেই সুখদুঃখাদির লােপ ঘটে এবং ইহাতেই মহাসুখের অস্তিত্ব নিহিত। ইহাই অদ্বয় ও সহজ অবস্থা। একমাত্র গুরুর উপদেশেই মহাসুখময় নির্বাণ লাভ করা যাইতে পারে, ইহার জন্য যােগসাধনাদির প্রয়ােজন নাই। মােটামুটি ইহাই চর্যাপদের দার্শনিক তত্ত্ব।”

চর্যাপদের সাহিত্যগুণ:

বাঙলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন-রূপে চর্যাপদকে গ্রহণ করা হলেও একে খাঁটি সাহিত্যরূপে গ্রহণ করা যায় না, কারণ বৌদ্ধ সহজিয়াগণ চর্যাপদগুলিকে তাঁদের সাধনতত্ত্বের বাহনরূপেই সৃষ্টি করেছিলেন। এই রচনার পিছনে কোন সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াস বর্তমান ছিল না। তৎসত্ত্বেও চর্যাপদগুলিকে একান্তভাবে ধর্মীয় রচনা বলেও অভিহিত করা যায় না। কারণ এদের কোন কোনটির মধ্যে বাঙ-নির্মিতির শিল্পকৌশল এবং স্বতঃস্ফূর্ত রসের আবেদন এমন স্বাভাবিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে যে এদের সহজ কবিত্বকে অস্বীকার করা সম্ভবপর নয়। প্রকৃত কাব্যসাহিত্যে রসের আবেদনকেই মুখ্য বিষয় বলে গ্রহণ করা হলেও এর ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার, বক্রোক্তি, ধ্বনিকেও একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। চর্যাপদের বিশ্লেষণে এদের উপস্থিতি অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হয়। তত্ত্বদর্শনের প্রতিই চর্যাকারদের আগ্রহ সীমাবদ্ধ ছিল,এ কথা মেনে নিলেও তারা যে তত্ত্বকথাকে নানাপ্রকার রূপক-প্রতীকের সহায়তায় বিভিন্ন চিত্রকল্পের মাধ্যমে অনির্বচনীয় করে তুলেছিলেন, এ কথাও অস্বীকার করবার উপায় নেই। “এই চিত্র প্রতীকগুলি একদিকে যেমন উদ্দিষ্ট অর্থকে সংহত আকারে পরিবেশন করিয়াছে, তেমনি চিত্রধর্ম ও রূপকল্পকেও আবার অজ্ঞাতসারে একটা শিল্প মর্যাদা দিয়াছে।” এই রূপক-প্রতীক যে প্রায় সর্বত্রই বক্তব্যকে তুলে ধরেছে, তা যে কোন সনিষ্ঠ পাঠকের নিকট সহজেই ধরা পড়ে।

এই অলঙ্করণের মধ্য দিয়েই যে চর্যাকারদের কবিত্বশক্তি নিঃশেষিত হয়েছিল, তা নয়। তাদের কবি-দৃষ্টিতে বাঙলার নদনদী-প্রান্তর, নর-নারীর আর্তি ও আকৃতি প্রভৃতি এক অপরূপ রােম্যান্টিক সৌন্দর্য-ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত হয়েছে। শিকারের চিত্র, নৌকা বেয়ে যাবার চিত্র, মদ্য বিক্রয়শালার চিত্র প্রভৃতির অনেকগুলিতেই স্বভাবােত্তির মাধ্যমে বেশ কিছু পরিমাণে রসের উদ্বোধন ঘটেছে। ভবণই গহণ গম্ভীর বের্গে বাহী কিংবা গঙ্গা জউনা মাঝে রে বহই নাঈ প্রভৃতি কবিতার চিত্রসৌন্দর্য যেমন উপভােগ্য, তেমনি ভাষার দুর্বোধ্যতা সত্ত্বেও এদের সার্বজনীন সাহিত্যিক মূল্যকে স্বীকার করে নেওয়া হয়। চর্যার, শেষ পদ গঅণত গঅণত তইলা বাড়ী হেঞ্চে ফুরাড়ী-তে শবর-শবরীর বাসভূমির একটি উপভােগ্য লিপিচিত্র অঙ্কিত হয়েছে ও আমরা সেই তৃতীয় বাড়িকে গগনতুল্য দেখি; সুন্দর কার্পাস প্রস্ফুটিত। টালত মাের ঘর নাহি পড়িবেশী পদে নিঃসঙ্গতা-জনিত বেদনাবােধ সুস্পষ্ট। ‘উঁচা উচা পাবত তহি বসই সবরীবালী’ পদের কাব্যসৌন্দর্য এর তত্ত্বকথাকে অনেকখানি পিছনে ফেলে গেছে। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, চর্যাকারগণ সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় চেতনার বশে এই পদগুলি রচনা করিলেও তাঁহাদের অনেকেরই রীতিমতাে কবিত্বশক্তি ছিল। প্রতীক-রূপকের সাহায্যে চিত্রসৃষ্টি, আখ্যানের ইঙ্গিত, মানব চরিত্রের মধ্যে সুখ-দুঃখ-বিরহ-মিলনের দৈনন্দিন জীবনচিত্র চর্যার দর্শন ও তত্ত্বের নিপ্রাণতাকে কাব্যরসের স্পর্শে সজীব করিয়াছে। প্রাচীন যুগের বাঙালী সহজিয়া সিদ্ধাচার্যগণ মূলতঃ সাধক হইলেও কবিত্বশক্তিতেও যে ন্যূন নহেন তাহা স্বীকার করিতে হইবে।

কেবল চিত্ররূপময় বর্ণনার সৌন্দর্য বা প্রকৃতিরূপ-চিত্রনের অসাধারণত্বই নয়, চর্যার পদগুলিতে রূঢ় বাস্তব মৃত্তিকালগ্ন জীবনের যে প্রতিফলন ঘটেছে, সেই জীবন-চিত্রও চর্যাপদাবলীকে গুঢ় ধর্মতত্ত্বের সীমানা অতিক্রম করে সর্বজনগ্রাহ্য সাহিত্যের স্তরে উন্নীত করেছে। সাহিত্য তাে জীবনের দর্পণ। চর্যায় সেই জীবনের ছবি বাস্তব এবং জীবন্ত। টিলার উপর নির্বান্ধব মানবকের দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের ছবি,নাড়িয়া ব্রাহ্মণের প্রবৃত্তিবশত গােপনে অস্পৃশ্য চণ্ডালীর গৃহগমন-চিত্র, ক্ষপণক স্বামীর দরিদ্রা গর্ভিনী স্ত্রীর আক্ষেপ-ইত্যাদি সহজিয়া সাধনতত্ত্বের উর্ধে সাহিত্যগুণের পরিচয়বাহী। সেইসঙ্গে চর্যায় প্রকাশিত বিস্তৃত সমাজচিত্রটিও চর্যাপদের সাহিত্যধর্মের প্রকাশক।

চর্যার সাহিত্যগুণ-বিষয়ে বিচার করতে গেলে আর একটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে চর্যার পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত সাহিত্যে কবিদের যে নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়, চর্যাপদগুলি ছিল তা থেকে মুক্ত। চর্যাপদে কবিদের ব্যক্তি-সম্পর্ক সুনিবিড় এবং এই কারণেই এর পদগুলি শুধুমাত্র কবিতা নয়, একেবারে গীতিকবিতার পর্যায়ে স্থানলাভ করার যােগ্য বলে। অনেকে মনে করেন। বস্তুতঃ এগুলিতে বাঙালীর স্বভাব-ধর্মেরই পরিচয় পাওয়া যায়। চর্যাপদের Mystic বা রহস্যময় রূপকটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমালােচক বলেন ঃ “অনুভূতির অনি্বাচ্যতা ব্যঞ্জনাময় প্রকাশরীতিকে আশ্রয় করে অপূর্ব রহস্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে।”

চর্যাপদের সমাজচিত্র:

ঐতিহাসিক বিচারে চর্যাপদগুলির রচনাকাল প্রাচীন যুগের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ খ্রীঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে যখন পাল বংশের পতন এবং উল্কার মত সেন বংশের অভ্যুত্থান ও পতন সূচিত হয়েছিল। অতএব সময়টা যে বাঙালীর জীবনে আশাব্যঞ্জক ছিল না, এ কথা স্বীকার করতেই হয়। চর্যাকারগণ ধর্মীয় সাধনতত্ত্বগুলিকেই চর্যাপদে ব্যবহার করতে চাইলেও এর জন্য তারা যে সকল রূপক-প্রতীকের সহায়তা নিয়েছেন, তাতে সমসাময়িক সমাজ-জীবনের বহু খণ্ডচিত্ৰই সুস্পষ্ট আকারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। চর্যাকারগণ ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়াপন্থী সাধক, কাজেই সমাজের অভিজাতবর্গ কিংবা উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক মধুর থাকবার কথা নয়, ফলে চর্যায় সমাজের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে উচ্চবিত্ত অংশ অনুপস্থিত। “সামাজিক বৈষম্য ও পক্ষপাত, উচ্চবর্ণের মধ্যে নানাপ্রকার অন্যায় ও ব্যভিচার, নিম্নবর্ণ অন্ত্যজদের সামাজিক প্রতিষ্ঠার অভাব ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ইহাই ছিল চর্যার রচনার যুগে সামাজিক অবস্থার স্বরূপ।..চর্যাপদগুলির মধ্যে যে সমাজচিত্র ও বাস্তব জীবনযাত্রার আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাহাতে একদিকে সমাজের এই ভেদবিভেদ এবং বৈষম্যের চিত্র, অন্যদিকে দুঃখপূর্ণ দরিদ্র জীবনযাত্রার কখনও পূর্ণাঙ্গ কখনও বা খণ্ডবিচ্ছিন্ন উপাদান লক্ষ্য করা যায়” (ডঃ সত্যব্রত দে)।

চর্যার যুগে সমাজে শ্রেণীবিভাগ স্পষ্ট আকার ধারণ করেছিল এবং সমাজের নিম্নশ্রেণীর লােকেরা ছিল অবজ্ঞাত এবং আর্থিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। এদের বাসস্থান সম্ভবতঃ ছিল নগরের বাইরে—এদের চলতে হবে উচ্চবর্ণের স্পর্শ বাঁচিয়ে। কিন্তু উচ্চবর্ণের সঙ্গে এদের যে কোন সম্পর্ক ছিল না, তা নয়, বরং উচ্চবর্ণের মনস্তুষ্টির জন্য ডােম্বীদের আতিশয্য কিছুটা সংশয়েরই সৃষ্টি করে। এই সকল অন্ত্যজ অস্পৃশ্য শ্রমিকদের বৃত্তি অর্থকরী কিংবা প্রশংসনীয় ছিল না। এদের কেউ ছিল তাঁত-বােনা তাতী, চাঙ্গড়ি- প্রস্তুতকারী ডােম্বী, নৌকাবাহক জেলে বা নেয়ে। এ ছাড়া ছিল শুড়ি যারা মদ তৈরি করত, ছিল। বৃক্ষছেদক, ছিল নট-সম্ভবতঃ এরা লেটোর দল নিয়ে গ্রামে গ্রামে নেচে গেয়ে বেড়াত।

চর্যাগীতির বিভিন্ন পদে তৎকালীন সমাজ-জীবনের যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে প্রতিবেশীহীন জীবনের নিঃসঙ্গতা, অন্নাভাব, আর্থিক বিপর্যয় প্রভৃতির দুঃখ-বেদনাময় দিকটিই বিশেষভাবে উদঘাটিত হয়েছে। দেশে চুরি-ডাকাতি, অশান্তি ও অরাজকতা সাধারণ গৃহস্থের জীবনেও নানা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। এ জাতীয় সামাজিক পরিবেশে নৈতিক আদর্শের মানদণ্ড যে বেশি উঁচুতে ছিল না, তা সহজেই অনুভব করা চলে

‘দিবসই বহুড়ী কাউই ডরে ভাঅ।

রাতি ভইলে কামরু জাম।।’

দিনের বেলা যে বধূটি কাকের ভয়ে ভীত, রাত্রিবেলা সেই কামরূপ যায়। ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও ডােম-শবর-আদি অন্ত্যজদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত থাকতেন তারও উল্লেখ রয়েছে। চর্যার পদে। এত অব্যবস্থার মধ্যেও যে মানুষের মনে সুস্থ জীবনের আকাঙ্ক্ষা বর্তমান ছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায় উঁচা উচা পাবত পদটির মধ্যে—শবর-শবরীর মিলিত জীবনযাত্রার একটি মাধুর্যময় চিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় এটিতে।

এ জাতীয় সামগ্রিক পরিচয় ছাড়াও বহু বিভিন্ন খণ্ডচিত্রের সহায়তায় চর্যাকারগণ তৎকালীন সমাজ-জীবনের অনেক পরিচয় উদঘাটিত করে গেছেন। শ্বশুর-শাশুড়ি ননদ-শালী প্রভৃতিকে নিয়ে এক একটি যৌথ পরিবার সেকালে গড়ে উঠতাে। একালের মতই সেকালের বিবাহও ছিল আড়ম্বরপূর্ণবাদ্য-ভাণ্ড-সহকারে বরযাত্রা, যৌতুক-প্রথা, রমণীদের বাসর জাগরণ এবং অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে বিবাহের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় চর্যার কোন কোন পদে। সম্পন্ন গৃহস্থ গৃহে গােরু-বলদ ছাড়া হাতিও পােষা হতাে। দাবা খেলা বিশেষভাবেই প্রচলিত ছিল, মদ্যপানেরও বিশেষভাবে চিহ্নিত আখড়া ছিল। নাচ গান ও বিবিধ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সামাজিক আনন্দ উৎসবের অঙ্গ বলে বিবেচিত হতাে। নাটকের অভিনয় হাতে বলে মনে হয়। গৃহস্থালির বিভিন্ন দ্রব্যের উল্লেখ পাওয়া যায় হাঁড়ি, পিবা, ঘড়ি, ঘড়ুলি প্রভৃতি; অলঙ্কারের মধ্যে আছে কানেট, ঘন্টানেউর, কাঙ্কান, কুণ্ডল, মুক্তাহার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে—পড়হ, মাদল, করণ্ড, কসাল, ডমরু, বীণা, বাঁশি প্রভৃতি।

চর্যার পদগুলির অন্ততঃ অধিকাংশই যে গৌড়বঙ্গে রচিত হয়েছিল, তা বিশেষভাবে অনুমান করা চলে এর নদীমাতৃক পটভূমি থেকে। বহু পদেই নদ-নদী, নৌযাত্রা, নৌকার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেই পারিভাষিক নাম, নৌবাণিজ্য, জলদস্যুদের হানা, পথেঘাটে বাটপারের ভয়, নৌকার খুঁটি, কেডুয়াল-আদির উল্লেখ থেকে এ কথাই বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় যে সুজলা বঙ্গভূমিতেই এদের সৃষ্টি এবং চর্যাপদে বর্ণিত সমাজব্যবস্থায় সমকালীন গৌড়বঙ্গের সমাজ-জীবনেরই ছায়াপাত ঘটেছে।

বৌদ্ধধর্মীয় পালরাজগণের সমুন্নতি ও পতন এবং ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী সেনরাজদের উত্থান ও পতন-কালের পটভূমিকায় চর্যাপদগুলি রচিত হওয়াতেও এগুলির মধ্যে সমকালীন ধর্ম-বিবর্তনের পরিচয়-চিহ্ন বর্তমান রয়েছে। গীতিকার সিদ্ধাচার্যগণ ছিলেন সহজিয়াপন্থী বৌদ্ধ-এই সহজপন্থা বজ্রযান পস্থার বিকারে উৎপন্ন। পরবর্তীকালের বৈষ্ণব সহজিয়া এবং বাউল সাধকদের মধ্যে এই ধারার রেশ বর্তমান ছিল, এই কালে ধর্মীয় জীবনেও যে অবক্ষয়-চিহ্ন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তারও পরিচয় পাওয়া যায় পদগুলিতে। হিন্দুসমাজেও দেখা দিয়েছিল নানা অনাচার ব্যভিচার। বর্ণভেদপ্রথা শুধু কঠোরভাবেই অনুসৃত হতাে না, উচ্চবর্ণের লােকেরা সেই সুযােগ গ্রহণ করে নিম্নতর শ্রেণীর উপর যথেষ্ট অত্যাচারও চালাতেন। বৌদ্ধগণও অবক্ষয়ের চরম সীমায় উপনীত হয়েছিলেন বলেই এই যুগের অবসানেই তারা সমাজ-জীবন থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন।

বঙ্গ সমাজে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনার ধারা বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত। কিন্তু চর্যাপদের আঙ্গিকটি প্রায় অবিকল অনুসৃত বাংলার শাক্তপদাবলীতে এবং বাউল গানে। উভয় ক্ষেত্র থেকে উদাহরণ দিলেই চর্যাপদের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তা স্পষ্ট হবে-

শাক্তপদাবলী

‘শুকনা তরু মুঞ্জরে না, ভয় লাগে মা ভাঙে পাছে।

তরু পবন-বলে সদাই দোলে, প্রাণ কাপে মা, থাকতে গাছে।’ (কমলাকান্ত) 

‘এক আসামী ছয়টা প্যাদা, বল মা কিসে সামাই করি। আমার ইচ্ছা করে ঐ ছটারে গরল খাইয়ে প্রাণে মারি।’ (রামপ্রসাদ)

বাউল-গীতি

‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়।

ধরতে পারলে মন-বেড়ি দিতাম তাহার পায়।’ (লালন)

‘আমি কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যেরে।’

পরিশেষে বলতে হয়, পৃথিবীর সব দেশে কাব্যের প্রাথমিক আত্মস্ফুরণে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে ধর্মচেতনা। ঋগ্‌বেদ, উপনিষদ, জালালুদ্দীন রুমির রুবাইৎ সুফী সম্প্রদায়ের ভজনগীতি শুধু ধর্মের গণ্ডীতেই আবদ্ধ থাকেনি, তা সাহিত্য পদবাচ্যও হয়ে উঠেছে। বস্তুত, আধ্যাত্মিকতা, দেবতা ও দৈবকথা যতক্ষণ মন্ত্র ও প্রার্থনায় আত্মনিবেদিত, ততক্ষণ তারা ধর্মের এলাকাধীন, কিন্তু যখনই তারা সাহিত্যসঙ্গ হয়, রূপবদল ঘটতে থাকে। কারণ সাহিত্য ধর্ম ও দেবতাকে অবলম্বন করে শিল্পরূপ দান করে। ফলে যা ছিল ধর্মতত্ত্ব’, পরে তা পর্যবসিত হয় ‘কথা’ বা ‘সাহিত্য’। এই ভাবে দেখা যায় চর্যাপদও যেন ধর্মের জয় তিলক ললাটে এঁকে সাহিত্যের আসরে প্রবেশ করেছে। তত্ত্বের ধূসর ঊষর মরুভূমিতে চর্যার কবি প্রবাহিত করেছেন—“সকল রসের ধারা।”