সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘চরণ দাস এম.এল.এ. গল্পের মধ্যে চরণদাসই কেন্দ্রীয় চরিত্রের মর্যাদা পায়। গল্পের নামকরণ থেকেও বোঝা যায় তিনিই গল্পের প্রধান আলম্বন বিভাব। ফলত তাঁকে ঘিরেই সমস্ত ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। চরণদাস কোনো এক অঞ্চলের বিধায়ক। কোনো এক অঞ্চলের জনসমর্থনে তিনি জনতার প্রতিনিধি হয়েছেন। কিন্তু এম.এল.এ. হবার পরই তিনি তাঁর নির্বাচন ক্ষেত্রকে ত্যাগ করে শহরবাসী হয়েছেন। ইদানীং গ্রামের পথে খালি পায়ে হাঁটতে তিনি আর পারেন না। পৈত্রিক বাড়ি সরকারকে ভাড়া দেওয়ার ফলে তিনি কখনো সখনো এদিকে এলে থাকেন সার্কিট হাউসে।

এম.এল.এ. হবার আগে পর্যন্ত তিনি পিতামাতার দেওয়া নির্ভেজাল নামটাই ব্যবহার করতেন – শ্রীচরণ দাস। তখন তিনি ছিলেন গ্রামের সকলের ভালোবাসার জন। কিন্তু এম.এল.এ. হবার পর থেকেই তাঁর নাম সরকারী খাতায় লেখা হয়েছে চরণদাস এম.এল.এ। এই নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বভাব চরিত্রেরও পরিবর্তন হয়েছে। যিনি ছিলেন গ্রামের ভালোবাসার জন, তাঁকেই এখন এড়িয়ে চলে গ্রামবাসীরা। যিনি ছিলেন সকলের আদরের ‘চরণা’, তিনি এখন হয়েছেন, ‘মায়লেজী’, ইয়েমিয়েলিয়ে সাহেব। তাঁর এই ধরনের নামকরণের অর্থ সম্বন্ধে বসুমিত্র মজুমদার বলেছেন, “তিনি সরকারের দপ্তরে শ্রীচরণ দাস এম.এল.এ। বাইরের অশিক্ষিত লোকেরা তাঁকে চিনে নিয়েছে যে তিনি মায়লেজী ছাড়া আর কিছু নয়। অর্থাৎ স্বচ্ছ নয়। অর্দ্ধ শিক্ষিতরা বলে ইয়েমিয়েলিয়ে সাহাব। তার মানে পরিষ্কারভাবে কিছুই তিনি করেন না, সবই ‘তালে গোলে হরিবোল’ করা ব্যাপার।”

‘তালে গোলে হরিবোল’ ব্যাপারের মতো অনেক কিছুই তাঁর চরিত্রের মধ্যে লক্ষ করা যায়। যেমন তিনি সব সময়েই পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মপন্থা পরিবর্তন করেন, দরাজ হাতে অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষীকে সুপারিশ পত্র দিয়ে সরকারী দপ্তরে সে পত্রের ওপর গুরুত্ব দিতে নিষেধ করে দেন। একদিকে স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে যেমন অধস্তন রাজনৈতিক কর্মীদের কটুকথা নির্বিবাদে হজম করতে পারেন, অন্যদিকে তেমনি ক্ষেত্র বিশেষে বাহুবল প্রযুক্তির কথা ঘোষণা করতেও দ্বিধা করেন না। তা ছাড়া কিছু করতে পারুন বা নাই পারুন আস্ফালন করতে যে তাঁর গলা কাঁপে না, সে দৃশ্য পাঠকরা মৌলবী সাহেবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের সময় বুঝে গেছেন। মৌলবীর উপর অকারণ ক্রুদ্ধ হওয়ার ঘটনা থেকে একটা কথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, গ্রামের পথে বেড়াতে বেরিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে হতাশ হয়েই মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন নি। তার মানে নির্বাচন ক্ষেত্রে জন সংযোগের কাজে নেমে প্রথমেই চরণদাস হতাশ হয়েছেন। তারই ফল স্বরূপ মৌলবী সাহেবকে তিনি চাকরি খাবার ভয় দেখিয়েছেন, গালাগালি করেছেন এবং মারমুখী হয়ে তেড়ে গেছেন। কিন্তু তার পরেই অর্থাৎ অতটা উত্তেজনার পরেই শান্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করেছেন চরণদাস। এখানে তার এক কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।

বিবেচনা করে চরণদাস দেখেছেন যে ভোটারদের মন জয় করতে হলে তাদের প্রাণের মনের আশ্রয় জগৎগুরু সহস্রানন্দের কৃপা তাঁকে লাভ করতেই হবে। তাই বিকেল বেলা সপারিষদ তিনি ভেট নিয়ে হাজির হন সহস্রানন্দের আশ্রমে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যখন দেখলেন জনতাকে নিজের দিকে ফেরাতে হলে জগৎগুরু নয়, সকালের সেই মৌলবী সাহেবের দারস্থ হতে হবে। তখন পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত বদল করে জগৎগুরুর ভক্তবৃন্দদের নিয়ে মিছিল করে সেই মৌলবীর বাড়ি গিয়ে মৌলবী সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে ভোটের বৈতরণী পার হবার ব্যবস্থা পাকা করে নিলেন। এখানেই তিনি হয়ে ওঠেন সার্থক নামা চরণদাস এম.এল.এ.। চরণদাসের এই চরিত্র নামের সঙ্গে পদের সঙ্গে অনবদ্য রূপে চিত্রিত করেছেন সতীনাথ। রাজনীতিকদের এতটা বাস্তবচিত্র বাংলা ছোটোগল্পে বিরল দৃষ্টান্ত।