বেদগ্রামের ভীমা পুষ্করিণীতে স্নানরতা শৈবালিনীকে দেখে তাঁর রূপে মোহমুগ্ধ হয়ে কুঠিয়াল লরেন্স ফষ্টর শৈবালিনীকে অপহরণের ছক কষেন। একদা এক রাত্রে তা কার্যে পরিণত করতে ফষ্টর লাঠিয়ালদের নিয়ে শৈবালিনীকে অপহরণ করেন এবং তিনি শৈবালিনীকে নিয়ে মুঙ্গের যাত্রা করেন। সহজ সরলা পল্লিবালা শৈবালিনী এখান থেকেই কুলত্যাগিনী রূপে আঘাত হন। ননদী সুন্দরী তাঁকে উদ্ধারের জন্য শত প্রচেষ্টা চালালেও শৈবালিনী নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে মুঙ্গের যাত্রা করেন। নৌকা থেকে পালিয়ে আসার কোনো তাগিদ অনুভব করলেন না। কিন্তু সুন্দর নিকট যখন প্রতাপ শৈবালিনীর অপহূতা হওয়ার সংবাদ প্রাপ্ত হলেন তখন আর স্থির থাকতে না পেরে রামচরণসহ কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে তিনি শৈবালিনীকে উদ্ধারের জন্য মুঙ্গেরগামী ফষ্টরের নৌকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রবল কৌশলের দ্বারা শৈবালিনীকে উদ্ধার করতে প্রতাপ সচেষ্ট হয়েছিলেন। শৈবালিনীকে উদ্ধারের পর প্রতাপ শৈবালিনীকে নিয়ে নিজগৃহে এসে সে রাতের মতো সংস্থাপিত করেছিলেন। তবে প্রতাপ খেয়ালই করেননি– শৈবালিনীকে নিয়ে তিনি যখন নিজ গৃহাভিমুখে প্রত্যাগমন করছিলেন তখন তাঁদেরকে অনুসরণ করেছিলেন ইংরাজ পক্ষের এক বিশ্বস্ত আহত মুসলীম সৈনিক।
ইতিহাসের কাহিনিধারায় আছে– নবাবের উপপত্নী দলনী বেগম পতিগতপ্রাণা, সতী সাধ্বী রমণী। সর্বদা নবাবের মঙ্গলকামনায় তৎপর। মুঙ্গেরের ঘাটে দুটি ইংরাজ নৌ-বহর আটক করেছেন সেনাপতি গুরগন খাঁ। এক সংবাদে দলনী বেগম আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। ইংরাজদের সঙ্গে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ভেবে নিয়ে এ যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে তিনি সেনাপতি গুরগন খাঁর স্মরণাপন্ন হন। নবাবের অজান্তে অস্তপুর থেকে তিনি দাসী কুলসমকে নিয়ে রাজপথে নামেন। তারপর এসে হাজির হন সেনাপতি গুরগন খাঁর ছাউনিতে। শত অনুরোধেও দলনী বেগম সমর্থ হলেন না গুরগন খাঁকে ইংরজের সঙ্গে বিরোধ থেকে সরিয়ে আনতে। ব্যর্থ মনোরথে দলনী ও কুলসম যখন সেনাপতির ডেরা থেকে বেরিয়ে রাজপথে এসে হাজির হন তখন মধ্যরাতের নির্জনতায় তাঁরা কেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। এইসময় তাঁদের নিকট দেবদূতের মতো এসে হাজির হন এক ব্রষ্মচারী। সেই ব্রহ্মচারীর নির্দেশমতো তাঁরা আর দূর্গে না ফিরে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন অরণ্যমধ্যে এক গৃহে। এ গৃহটি ছিল প্রতাপের অর্থাৎ এই গৃহের ভিন্ন ভিন্ন ঘরে প্রতাপ ও শৈবালিনী পূর্বে থেকে অবস্থান করছিলেন। এবার ব্রষ্মচারীর সহায়তায় দলনী কুলসম আর একটি ঘরে অবস্থান করতে থাকলেন। অথচ কেউ কারুর অবস্থান সম্পর্কে কিছু বুঝলেন না বা জানলেন না।
যে আহত ইংরাজের সৈন্যটি পলায়নরত প্রতাপ-শৈবালিনীকে অনুসরণ করেছিল, তারই সাহায্যে ইংরাজরা সেই রাতে প্রতাপের গৃহ অতর্কিতে আক্রমণ করেছিলেন। আক্রমণের ফল দাঁড়ালো প্রতাপের অপরাধের শাস্তি বিধানের নিমিত্তে তাঁকে তো বন্দি করলেন এবং দলনীকে ইংরাজরা সঙ্গে নিলেন শৈবালিনী ভেবে। এই বিশেষ মুহূর্তটি সংঘটিত হয় উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের সপ্তম পরিচ্ছেদে গলষ্টন ও জনসন অংশে। উপন্যাসের এই অংশটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানেই নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল শৈবালিনী ও দলনীর আগামী জীবন কোন খাতে বইতে পারে। অর্থাৎ এই অংশটি শৈবালিনী ও দলনী বেগমের জীবনগতির নিয়ন্ত্রণ রূপে চিহ্নিত হয়ে যায়। কারণ এরপর থেকে দলনী আর একটিবারের জন্য তাঁর সুখনীড়ে ফিরতে পারেননি। ভাগ্যচক্রে ফষ্টরের নৌকা হতে নদীতীরে অবতরণ করে ব্রহ্মচারীর সহায়তায় মুর্শিদাবাদে এলেও ততদিনে নবাবের কর্ণগোচর হয় ইংরাজদের দ্বারা তিনি কলঙ্কিনী হয়ে গেছেন, এবং নবাব তাঁকে বিষপানে মৃত্যুর দণ্ডাজ্ঞা দেন। দলনীর নিকট নবাব শুধু স্বামী নন, তাঁর প্রভু। প্রভুর আজ্ঞা তিনি বিনা বিচারে মাথা পেতে নিলেন। কোনো প্রতিবাদ না করে হাসতে হাসতে বিষপানে আত্মহত্যা করলেন। বোধ করি সে রাত্রে ইংরাজ কর্তৃক তিনি অপহ্তা না হতেন তাহলে তাঁর জীবনটা এমন করুণ ভাবে অঙ্কিত হতো না। নিষ্পাপ ফুলের মতো মনের দেহের চিত্তের অধিকারিণী হয়েও কলংকের শিরোপা মাথায় পরে চিরবিদায় নিলেন। তার জন্য পাঠকহৃদয় অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
ইংরাজরা প্রতাপ ও দলনীকে যখন বন্দি করে নিয়ে যান তখন সেই গৃহের অন্য একটা ঘরের গবাক্ষ পথ থেকে শৈবালিনী সমস্তই দেখেছিলেন। কুলত্যাগিনী হওয়ার পর সংসারে ফিরে যাওয়ার পথ তাঁর রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রতাপের সান্নিধ্য লাভের পর সংসারে ফেরার একটা সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু ইংরাজরা যখন প্রতাপকে বন্দি করে নিয়ে গেলেন শৈবালিনীর সে আশায়ও ছাই পড়লো। প্রতাপ সঙ্গে থাকলে হয়তো তিনি প্রতিবেশিদের নিকট বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি যদি একা ফেরেন কেউই তাঁকে বিশ্বাস করবেন না। কাজেই ব্রহ্মচারীর পত্র পেয়ে যখন নবাব দলনীকে নিয়ে যেতে লোক পাঠালেন শৈবালিনী অনায়াসেই তাদের সঙ্গে রাজদরবারে এসে হাজির হলেন। তারপর নবাবের সহায়তায় শৈবালিনী বন্দি প্রতাপকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন বটে ততক্ষণে কলঙ্কিনীর তকমা তাঁর জীবনে ভালো করে অঙ্কিত হয়ে গেছে। প্রতাপের চিন্তা মন থেকে তাড়াতে তিনি প্রতাপের সঙ্গ পরিত্যাগ করে নির্জন অরণ্যমধ্যে নিজে থেকেই বিসর্জিতা হলেন বটে, তবে তিনি অনুভব করলেন প্রতাপ জীবিত থাকতে তাঁর ইহজীবনে কোনো সুখ নেই। প্রতাপ ও প্রণয়াস্পদার জীবন ও সুখ করতে রণক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। অর্থাৎ সেই রাত্রে যদি প্রতাপ এমনভাবে বন্দি হয়ে ইংরাজদের সঙ্গে না যেতেন বোধ করি শৈবালিনী পরবর্তী জীবনটা এমন বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠত না। অতএব সব মিলিয়ে স্বীকার করতেই হয় চন্দ্রশেখর উপন্যাস মধ্যে দ্বিতীয় খণ্ডের সপ্তম পরিচ্ছেদটি পাত্রপাত্রী জীবন নিয়ন্ত্রক রূপে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রূপে প্রতিভাত হয়েছে।
Leave a comment