‘উপক্রমণিকা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল– সূত্রপাত বা মুখবন্ধ, বা প্রস্তাবনা। অর্থাৎ কোনো বিষয়ের সামগ্রিক রূপ পরিস্ফুটনের পূর্বে তার সূচনা বা প্রথামাংশে পরবর্তী ঘটনার ইঙ্গিত দেওয়া থাকে, এই অংশটিকে উপক্রমণিকা রূপে চিহ্নিত করা হয়। তবে সর্বক্ষেত্রে এই ‘উপক্রমণিকা’ অংশটি থাকবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটা লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে লেখক বঙ্কিমচন্দ্র মূল কাহিনির অবতারণার পূর্বে প্রস্তাবনা অংশ যুক্ত করেছেন। এখন প্রশ্ন হল উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাবনা অংশটির গুরুত্ব কেমন?

ঐতিহাসিক ঘটনার আশ্রয়ে চন্দ্রশেখর উপন্যাসটি রচিত হলেও, এর মূল কাহিনি কিন্তু ইতিহাস বহির্ভূত। এবং উপন্যাসের নামকরণ হয়েছে যে ব্যক্তিটির নামে তিনি একজন অনৈতিহাসিক চরিত্র। অর্থাৎ ইতিহাসের আধারে রেখে রচিত হয়েছে সামাজিক কাহিনি যার সমস্তটাই মনস্তত্ত্বের মোড়কে আবৃত। চন্দ্রশেখরের মূলীভূত বিষয় হল, প্রতাপ-শৈবালিনী চন্দ্রশেখরের প্রেমপ্রণয়ের দ্বন্দ্ব বিক্ষোভ। কামনাময়ী নারী রূপে শৈবালিনী কীভাবে ভিন্ন পুরুষকে আকৃষ্ট করেছিলেন, বিবাহিত নারী হয়েও পূর্ব প্রণায়ীর প্রতি কেমন নিজের অচঞ্চল চিত্তকে প্রতিস্থাপন করেছিলেন, লালসা তাড়িতা হয়ে বিনা প্রতিবাদে তিনি কেমন করে বিধর্মী লরেন্স ফক্টরের সঙ্গে বহিরঙ্গনে পা রাখলেন তার সামগ্রিক বিষয় এ উপন্যাসে উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। যে উপন্যাসের সামগ্রিক ঘটনা শৈবালিনীর মানসিক দ্বন্দ্ব বিক্ষোভকে নিয়ে কেন্দ্রিভূ ত হয়েছে তার পূর্ব সূচনা রূপে এ উপন্যাসের উপক্রমণিকা অংশটি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে।

সমালোচ্য উপন্যাসের উপক্রমণিকা অংশের প্রথম পরিচ্ছেদের নাম ‘বালক বালিকা’। শুরুতেই এমনভাবে বর্ণনা দেওয়া আছে– ভাগীরথী তীরে, আম্রকাননে বসিয়া একটি বালক ভাগীরথীর সান্ধ্য জলকল্লোল শ্রবণ করিতেছিল। তাহার পদতলে, নবদুর্বা শয্যায় শয়ন করিয়া একটি ক্ষুদ্র বালিকা নীরবে তাহার মুখপানে চাহিয়াছিল চাহিয়া, চাহিয়া, চাহিয়া, আকাশ নদী বৃক্ষ দেখিয়া, আবার সেই মুখপানে চাহিয়া রহিল। বালকের নাম প্রতাপ বালিকার নাম শৈবালিনী। শৈবালিনী তখন সাত আট বৎসরের বালিকা – প্রতাপ কিশোর বয়স্ক। পরবর্তীকালে উপন্যাসের মধ্যে আপন আপন কর্মতৎপরতায় প্রতাপ ও শৈবালিনী নায়ক নায়িকারূপে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। যদিও সামাজিক কারণে উভয়ের বিবাহ সুসম্পন্ন হয়নি। তবে বাল্য হতে দুজন দুজনার যে প্রণয়াসক্ত, তা এই অংশটির বর্ণনা থেকে প্রমাণ মেলে। উপক্রমণিকার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে– “এইরূপে ভালোবাসা জন্মিল। প্রণয় বলিতে হয় বলো, না বলিতে হয় না বলো। ষোলো বৎসরের নায়ক—আট বৎসরের নায়িকা। বালকের ন্যায় কেহ ভালোবাসিতে জানে না।” এখানে বালক বলতে প্রতাপ, প্রতাপের মতো ভালোবাসতে জানা অবশ্য কারুর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আলোচ্য উপন্যাসের শেষাংশে তিনি মৃত্যুর প্রাক্ মুহূর্তে শৈবালিনীকে ভালোবাসা সম্পর্কে রমানন্দ স্বামীকে বলেছেন– “আমার ভালোবাসার নাম – আত্মবিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা।” এই যার ভালোবাসার মহিমা তাঁর সমতুল কে?

শৈবালিনী প্রতাপকে ভালোবাসলেও প্রতাপের মতো জীবন বিসর্জন দিয়ে ধন্য হতে চান না। যখন তিনি ও প্রতাপ জানলেন তাঁরা একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসলেও সামাজিক বিধিনিষেধহেতু তাঁদের বিবাহ সম্ভব নয়, তখন একসাথে তাঁরা জলে ডুবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। পূর্বেই জেনেছি প্রতাপের মতো ভালোবাসতে কেউ জানে না। তিনি ভালোবাসার জন্য সবকিছু করতে পারেন, কিন্তু সবকিছুর জন্য ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারেন না। তিনি প্রতিশ্রুতি মতো জলে ডুবলেন, কিন্তু শৈবালিনী ডুবতে গিয়েও ডুবলেন না। ভাবলেন– “কেন মরিব? প্রতাপ আমার কে? আমার ভয় করে, আমি মরিতে পারিব না। শৈবালিনী ডুবিল না–ফিরিল। সন্তরণ করিয়া কূলে ফিরিয়া আসিল।” এ বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শৈবালিনীর দ্বিচারিতা। প্রতাপকে তিনি ভালোবাসলেও, এই ভালোবাসার জন্য তিনি প্রাণ বিসর্জন দিতে নারাজ, অর্থাৎ প্রতাপের চেয়ে তিনি নিজেকেই বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু প্রতাপ শৈবালিনীকে ভালোবেসে বুঝেছিলেন তাঁর ভালোবাসার অপর নাম আত্মবিসর্জন। এরপর শৈবালিনীর সঙ্গে চন্দ্রশেখরের বিবাহের মধ্য দিয়ে উপক্রমণিকা অংশের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং শুরু হয় মূলকাহিনি।

তিন পরিচ্ছেদে বিশেষ উপক্রমণিকা অংশে লেখক শৈবালিনী প্রতাপ সম্পর্কে যে তথ্য পেশ করলেন এবং ব্রতচারী ব্রহ্মচারী চন্দ্রশেখর শৈবালিনীর রূপ দেখে মোহগ্রস্ত হয়ে তাঁকে বিবাহ করার প্রসঙ্গটি যেভাবে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা দিলেন তা হতচকিত হতে হয়। সূচনা অংশে উক্ত চরিত্রের ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবের যে পরিচয় পাওয়া গেল তাতে বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি, আগামী দিনে তাঁদের জীবনধারা কোন খাতে বইতে পারে। মূলকাহিনি অংশে শৈবালিনী যেভাবে কুলত্যাগিনী হয়েছিলেন উপক্রমণিকা অংশে তাঁর ডুবে না মরার মধ্যে কিছুটা আভাস মেলে। শৈবালিনীর জন্য প্রতাপ যেভাবে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন, তা উপক্রমণিকা অংশে তাঁর ডুবে মরতে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে সাংকেতিক রূপ ফুটে উঠেছে। চন্দ্রশেখর যে ব্রতধর্মাচরণ ত্যাগ করে শৈবালিনীর রূপে প্রমুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহ করেছিলেন, তার পরিণতি রূপ হিসাবে দেখা যায় শৈবালিনীকে অপহূতা হয়েছে জেনে চন্দ্রশেখর তাঁর নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি বিলিয়ে দিয়েছেন, সখের গ্রন্থগুলিতে অগ্নি সংযোগ করেছেন, শেষে গৃহত্যাগ হয়েছেন। শৈবালিনীর প্রতি রূপমুগ্ধতার মধ্যেই যে এই করুণ পরিণতি নিহিত ছিল তা বলাই বাহুল্য।

অতএব স্বীকার করতেই হয়, ‘চন্দ্রশেখর’-এর মূলকাহিনি শুরুর প্রাক মুহূর্তে উপক্রমণিকা অংশটিতে লেখক যে যে কাহিনির অবতারণা করেছেন তা যে পরবর্তী ঘটনার পূর্ব সূচনা রূপে সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। একাৰ্থে উপক্রমণিকায় উক্ত তিনটি চরিত্রের সামগ্রিক গতিবিধি সাংকেতিক ভাবে আভাসিত হয়েছে। কাজেই উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই অংশটির গুরুত্ব যে অপরিসীম সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।