(১) চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের উদ্ভব:

ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক পণ্ডিতগণের দৃঢ় বিশ্বাস যে, যে-চণ্ডীকে নিয়ে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে ঐ চণ্ডীর আবির্ভাব ঘটেছিল মূলত কোনো অনার্য সমাজে। তুর্কী-আক্রমণকালে গৌড়বঙ্গে নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাতে যে-সমাজ বিবর্তন সূচিত হয়েছিল, তার একটি প্রত্যক্ষ সুফল বৃহত্তর সমাজ-জীবনে, আর্য-অনার্য ভাবধারার সমীকরণ। ঐ সমীকরণ-সুত্রেই বিভিন্ন অনার্য দেব-দেবী, অনার্য ভাবধারা, আচার-আচরণ ও ধর্মবিশ্বাস বেশ কিছু পরিমাণেই আর্য সমাজেও গৃহীত হয়েছিল। সম্ভবত ঐ সময়ই ওঁরাও জাতির ‘চাণ্ডী’ নামক দেবী আর্য সমাজে পরমা প্রকৃতি আদ্যাশক্তির এক শক্তিরূপে গৃহীত হলেন এবং কালক্রমে তার সঙ্গে মিশেও গেলেন। অবশ্য আর্যসমাজে গৃহীত এই চণ্ডী নির্ভেজাল অনার্যদেবী রইলেন না, এর সঙ্গে বৈদিক ‘মৃগাণাং মাতরম্’ অর্থাৎ পশুকুলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘অরণ্যানী’, কোনো কোনো বৌদ্ধদেবী (চনষ্ঠী, অভয়া), জৈনদেবী সরস্বতী) এবং বিভিন্ন বৈদিক, ঔপনিষদিক এবং পৌরাণিক দেবীর মিশেল ঘটা সম্ভবপর। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, মার্কণ্ডেয় পুরাণে ‘চণ্ডী’ নামে যে-দেবীর বিস্তৃত কাহিনী পরিবেশিত হয়েছে, তার সঙ্গে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত দেবী চণ্ডীর নাম-সাদৃশ্য ছাড়া অপর কোনো অংশই মিল নেই।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দুটি কাহিনী– দু’টি কাহিনীতেই দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এই দুটি কাহিনীর চণ্ডীও একজন নন, নামসাদৃশ্য ছাড়া এঁদের মধ্যেও কোন মিল নেই। প্রথম কাহিনী—আবেটিক খণ্ডে বর্ণিত কালকেতু-ফুল্লরা কাহিনীতে যে চণ্ডীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি তো স্পষ্টতঃই পশুকুলের রক্ষয়িত্রী, ব্যাযজাতির আরাধ্যা দেবী চণ্ডী। কাহিনীর মধ্যেই পশুকুলের এবং ব্যাধজাতির সঙ্গে এঁর সম্পর্কের কথা সুস্পষ্টরূপেই স্বীকৃত হয়েছে। ইনি যখন স্বরূপে দেখা দিয়েছিলেন, তখন দশভুজা মহিষমর্দিনীরূপেই আমরা তাকে দেখতে পাই। আর দ্বিতীয় কাহিনী বণিকখণ্ডে ধনপতি সদাগরের কাহিনীতে যে চণ্ডীর কথা বলা হয়েছে, ইনি তো স্পষ্টতাই দেবী মঙ্গলচণ্ডী– যিনি হারানো জিনিসের পুনঃপ্রাপ্তি ঘটিয়ে দেন। ইনি যখন স্বরূপে দেখা দিলেন, তখন ইনি গজগ্রাসী কমলেকামিনী। অতএব নাম সাদৃশ্য ছাড়া এই দুই চণ্ডীর মধ্যেও কোনো মিল নেই। যাহোক, এই দু’জনই মূলত অনার্য সমাজ থেকে গৃহীত হ’য়েছেন এবং চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের অন্তর্গত দেবখণ্ডে অপর পৌরাণিক দেবীদের সঙ্গে এঁকে অভিন্ন দেখানোর জন্য হর গৌরীর কাহিনী যোজনা কাঁরে গৌরী তথা পার্বতী উমা অর্থাৎ শিব গৃহিণী দেবী ভগবতীর সঙ্গে একটা জোড়াতালি দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে এবং তাও যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হ’য়েছে, তা কোন সনিষ্ঠ পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না।

দেবী চণ্ডীর আবির্ভাব এদেশে কবে ঘটেছিল কিংবা বাংলা সাহিত্যেই বা কখন সর্বপ্রথম এঁর অন্তর্ভুক্তি ঘটে, এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা এখন আর সম্ভব নয়। ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ একটি শ্লোক আছে—’ত্বং কালকেতুবরদাছলগোধিকাসি যা তাং শুভা ভবসি মঙ্গলচণ্ডীকাখ্যা। শ্রীশালবাহন নৃপাদ্ বণিজঃ স্বসুনাঃ রক্ষেহসুজে করিদ্বয়ং গ্রসতী বমন্তী।’ অর্থাৎ- ‘আপনি সুবর্ণগোধিকা মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া কালকেতুকে বর দিয়াছেন, আপনি শুভা মঙ্গলচণ্ডীকা, আপনি মাতঙ্গভোজন ও উদ্গীরণ করতঃ কমলেকামিনী রূপে শ্রীমস্ত সদাগর ও তৎ পিতাকে শ্রীশালবাহ রাজার হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছেন। এখানে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দু’টি কাহিনীরই উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এদের প্রাচীনত্ব স্বীকার করা চলে না, কারণ বৃহদ্ধর্ম পুরাণ স্পষ্টতঃই অর্বাচীন কালের রচনা। সম্ভবত এদেশে চণ্ডীমঙ্গল কাহিনী প্রচলিত হবার পরই পুরাণে এই শ্লোকটির অন্তর্ভুক্তি ঘটে থাকবে।

এ যাবৎ যে সকল মঙ্গলকাব্যের সন্ধান পাওয়া গেছে, তাদের কোনটিই ষোড়শশতকের পূর্ববর্তী কালের নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যে চণ্ডীপূজার প্রবর্তন ঘটেছিল আরো আগে, হয়তো বা তুর্কী আক্রমণ পর্বেই তার অপর কিছু কিছু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী লিখেছেন—

‘মাণিক দত্তেরে বন্দো করিয়া বিনয়।

যাহা হইতে হৈল গীত পথ-পরিচয়।।

এখানে আমরা মুকুন্দ কবির পূর্ববর্তী মাণিক দন্ডের নাম পাচ্ছি, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মাণিক দত্তের কোনো প্রামাণিক পুথির সন্ধান পাওয়া যায় না। অনেকেই অনুমান করেন, ইনি হয়তো প্রাচীন যুগ ও মধ্যবর্তী যুগের অন্তর্বর্তীকালে অর্থাৎ তুর্কী আক্রমণ যুগে বর্তমান ছিলেন। চণ্ডীমঙ্গল কাব্য এবং চণ্ডীমঙ্গল পূজা যে চৈতন্য-পূর্ব কালেই প্রচলিত ছিল, তার সাক্ষ্য দিয়েছেন চৈতন্যজীবনীকার বৃন্দাবনদাস। তিনি লিখেছেন

‘ধর্মকর্ম লোকে সবে এই মাত্র জানে।

মঙ্গলচণ্ডীর গীত ক’রে জাগরণে।।’

-এটি চৈতন্য-আবির্ভাব কালের ঘটনা। এগুলি ছাড়াও কয়েকটি পাথুরে প্রমাণের কথা উল্লেখ করা চলে।

দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত একটি দেবীমূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে যে দেবীর বামপার্শ্বে ছিল একটি গোধিকা মূর্তি। ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ ‘মঙ্গলচণ্ডী’র বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও পৌরাণিক চণ্ডীর উল্লেখ বর্তমান রয়েছে ‘দেবীপুরাণ, বামনপুরাণ, বারাহীতন্ত্র প্রভৃতি বহু গ্রন্থেই। অতএব অন্তত চতুর্দশ পঞ্চদশ শতকেই বাংলা ভাষায় চণ্ডীমঙ্গল কাহিনী—অন্তত পাঁচালী আকারে হ’লেও প্রথম রচিত হয়েছিল, এমন বিশ্বাস অসঙ্গত নয়। এই ক্ষেত্রে দেবী চণ্ডী অথবা মঙ্গলচণ্ডীর পূজা যে আরও পূর্বেই প্রচলিত ছিল, একথা মনে করা চলে।

ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের পর আর্য-অনার্য সংঘর্ষ এবং পরে সমীকরণের ফলে আর্য সমাজে যে সকল অনার্য দেব-দেবী, ধর্মবিশ্বাস, ভাবধারা ও আচার-আচরণের অনুপ্রবেশ ঘটে, তাদের যথোপযুক্ত মর্যাদা ও স্থিতিশীলতা দানের জন্যই বিভিন্ন পুরাণের সৃষ্টি হয়েছিল। অনুরূপ কারণে এবং অনুরূপভাবেই খ্ৰীঃ ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকেও গৌড়বঙ্গে আর্য-অনার্য-সমীকরণের ফলে দেব-দেবীর আর্যসমাজে প্রতিষ্ঠিত করবার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় রচিত হয় বিবিধ মঙ্গলকাব্য। এইদিক থেকে মঙ্গলকাব্যগুলিকে ‘বাংলা পুরাণ’ রূপেই গ্রহণ করা চলে। সংস্কৃত পুরাণের কতকগুলি লক্ষণ কালে কালে গড়ে উঠলেও প্রচলিত প্রায় কোনো পুরাণেই সবগুলি লক্ষণ যেমন উপস্থিত নেই, তেমনি আবার বিভিন্ন পুরাণও নিজস্ব লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত হয়ে আছে। বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলির সেকালে কোনো বিশ্লেষণ হয়নি, কিংবা কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিও এদের গঠনগত অথবা প্রকৃতিগত কোনো বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা না করায় মঙ্গলকাব্যের কোনো লাক্ষণিক বৈশিষ্টা কখনো কঠোরভাবে নির্দিষ্ট হয়নি। কিন্তু তাহলেও কালে কালে তাদের মধ্যে কতকগুলি সাধারণ কর্ম দেখা দেয় – যেগুলিকে আমরা মঙ্গলকাব্যের লক্ষণরূপে চিহ্নিত করতে পারি।

(২)চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের লক্ষণ: 

অধিকাংশ মঙ্গলকাব্যে দুটি খণ্ড দেখা যায় প্রথমটি দেবদত্ত, দ্বিতীয়টি নরখণ্ড। দেবখণ্ডে সাধারণভাবে কিছু পৌরাণিক কাহিনী প্রধানত হর-পার্বতীর কাহিনী থাকে। মঙ্গলকাব্যে সাধারণত যে দেবতার মাহাত্ম্য কীর্তিত হয় সেই দেবতাকে ঐ খণ্ডে শিবের সঙ্গে কোন-না-কোন সম্পর্ক দ্বারা যুক্ত করা হয়। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের চণ্ডী প্রথম খণ্ডের কোথাও ‘চণ্ডী’ নামে পরিচিত না হলেও এখানে তাঁকে শিবগৃহিণী সতী ও পার্বতী উমার সঙ্গে অভিন্ন করে দেখানো হয়েছে। মঙ্গলকাব্যের নায়ক-নায়িকাদের সাধারণত কোনো শাপভ্রষ্ট দেবতার বা গন্ধর্ব-আদিরূপে দেখানো হয় এবং তাদের পূর্বজীবনের কাহিনী এই দেবখণ্ডেই স্থান লাভ করে থাকে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের নায়ক-নায়িকা কালকেতু-ফুল্লরা ছিলেন স্বর্গের ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর ও তৎপত্নী ছায়া। কীভাবে তাঁরা শাপগ্রস্ত হ’লেন, সেই কাহিনী এই খণ্ডে বর্তমান গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে থাকে মূল গল্পটি। আলোচ্য ক্ষেত্রে ‘আর্থেটিক খণ্ডে’ কালকেতু-ফুল্লরা নামক ব্যাধদম্পতির কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে কতকগুলি বিষয়গত ঐক্য দেখা যায়, সেগুলিকে সাধারণ লক্ষণ মনে করতে পারি।

গ্রন্থের প্রথমেই থাকে বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা এবং গ্রন্থোৎপত্তির কারণ। অধিকাংশ কবিই গ্রন্থোৎপত্তির কারণ-রূপে স্বপ্নাদেশ বা দেবাদেশকে নির্দেশ ক’রে থাকেন। সমসাময়িক সমাজ জীবন বা বাস্তব পরিবেশ রচনা করতে গিয়ে মঙ্গল কাব্যের কবিরা বিভিন্ন ধরনের রান্না, গাছপালা, পশুপাখি প্রভৃতির বিবরণ দিয়ে থাকেন। এছাড়া দশবিধ সংস্কারের অনেকগুলিই যেমন–বিবাহ, সাধভক্ষণ, অন্নপ্রাশন-আদি বিভিন্ন অনুষ্ঠান বিস্তৃতভাবেই বর্ণিত হয়। শাস্ত্রীয় আচারাদি ছাড়াও বিভিন্ন স্ত্রী-আচার, নারীদের পতিনিন্দা, বারমাস্যা, বিশ্বকর্মার কাঁচুলি নির্মাণ, চৌত্রিশাক্ষর স্তব প্রভৃতি প্রতি মঙ্গল কাব্যেই স্থান লাভ ক’রে থাকে। বলা বাহুল্য, এ সবই কবিকঙ্কণ রচিত ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও স্থান লাভ করেছে।