বাংলা দেশের বিশেষ একটি যুগসন্ধিক্ষণে একটি সামাজিক প্রয়োজনেই সম্ভবত সৃষ্টি হয়েছিল মঙ্গলকাব্যধারার। বাঙালী তখন একটি রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে প্রধানত আত্মরক্ষার তাগিদেই চিরকালের উপেক্ষিত অবজ্ঞাত অনার্য সমাজকে টেনে নিয়েছিল বুকের কাছাকাছি। তার ফলে ঐ অনার্য সমাজের অনেক দেব-দেবী, ধ্যান-ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণ স্বাঙ্গীকৃত হয়েছিল উচ্চতর সমাজ জীবনে। আর এই সুযোগেই অনেক নোতুন নোতুন দেব-দেবীর আগমন ঘটলো হিন্দু সমাজে। বহুকাল পূর্বে, আর্যদের ভারতবর্ষে সভ্যতা বিস্তারের যুগেও অনুরূপভাবে অনার্য ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল আর্যসমাজে। তৎকালীন যে সকল দেব-দেবী, ধর্মীয় ভাবনা এবং আচার-অনুষ্ঠান আর্যসমাজেও গৃহীত হয়েছিল, তাদের যথোচিত মর্যাদা দান এবং মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছিল বহু পুরাণ এবং উপপুরাণ। এবারও সেই মাহাত্ম্য প্রচারের জন্যই একদল লেখকদের কলম ধরতে হলো, এঁরা যা রচনা করলেন, তাকেই আমরা একালে ‘মঙ্গলকাব্য’ রূপে আখ্যায়িত ক’রে থাকি।

বলাই বাহুল্য, নবাগত প্রত্যেকটি প্রধান দেবতার জন্যই পৃথক পৃথক্‌ মঙ্গলকাব্য রচিত হ’য়েছিল— ফলে মঙ্গলকাব্যের সংখ্যাও হয় বেশ কয়েকটি। এঁদের মধ্যে কোনো কোনো দেবতা অর্বাচীন পুরাণেও বেশ মর্যাদার আসন পেয়ে গেছেন, আবার কোনো কোনো পৌরাণিক দেব দেবীকে এবং দেবোপম মানবসস্তানকে নিয়েও কিছু কিছু মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। মঙ্গলকাব্যের উদ্ভবকালে আমাদের দেশের সামাজিক পটভূমি যেমন ছিল, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান ক’রেই মঙ্গলকাব্যের নবাগত দেবতাদের গড়ে তুলতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই নবাগত দেবতারা কিন্তু ছক্ত হৃদয়ে আসন পেয়েছিলেন ভয়ের জোরে, ভক্তিতে নয়। তাই তাঁদের চরিত্রের মধ্যে দেবোচিত গুণের পরিচয় খুবই সামান্য, অধিকাংশ দেব-দেবীই ভয় দেখিয়ে ভক্তি আদায় করতে চেয়েছেন বলে তাঁদের চরিত্রের অন্ধকার দিকটাই বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এইসব দেব-দেবীদের অনেককেই কুলীন করে তোলবার জন্য পৌরাণিক দেব-দেবীদের সঙ্গে বিশেষ করে আশুতোষ মহাদেবের সঙ্গে একটি সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে। কাজেই অধিকাংশ মঙ্গলকাব্যেই শিব-পার্বতী বা হর-গৌরীর কাহিনী হ’য়ে দাঁড়িয়েছে এক অচ্ছেদ্য অংশ। আলোচ্য চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে উপাস্য দেবী চণ্ডীকে পৌরাণিক পার্বতী উমা বা গৌরীর সঙ্গে অভিন্ন রূপেই দেখানো হয়েছে বলে কাহিনী প্রোক্ত চণ্ডী এবং ভূমিকার হর-গৌরীর গৌরী এক হ’য়ে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—’আমরা দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবতা। বস্তুত এটা সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুসৃতি। আমরা মানবসস্তান দশরথনন্দন শ্রীরামচন্দ্র, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ কিংবা বাঙালী-হহৃদয়মথিত শ্রীচৈতন্যদেবকে দেবমহিমায় উন্নীত করেছি। আবার মানবের আকুল আহ্বানে সাড়া দেবার জন্য শিব-বিষ্ণু আদি প্রধান দেবতাদেরও বারবার পৃথিবীর বুকে মানবের ঘরে জন্মগ্রহণ করতে হয়েছে। শাস্ত্রে ও পুরাণে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে বার বার। মহাকবি কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব কাব্যে’ উমা-মহেশ্বর-কাহিনীতে তাঁদের মানবীয় চরিত্র সম্পূর্ণভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে এবং এরই সার্থক অনুসৃতি ঘটেছে কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে। অবশ্য দেশ-কাল-পাত্রের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ভূমিকারও রূপান্তর ঘটেছে। ভারতেশ্বর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তথা বিক্রমাদিত্যের সভাকবি কালিদাসের কাব্যে যে রাজকীয় ঐশ্বর্য তথা পরিবেশের পরিচয় পাওয়া যায়, গ্রাম্য জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত পালিত উদ্বাস্তু ব্রাহ্মণ-সন্তান ন্দের কাব্যে প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক। রাজবংশের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচয় কালিদাসের কাব্যে নাগাধিরাজ হিমালয়ের কন্যা পার্বতী উমা অভিজাতবংশীয়া; বাল্যে তার বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে, যৌবনে তিনি সর্বশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করেছেন। তার রূপ বর্ণনায় কালিদাস অলঙ্কারশাস্ত্রের সর্বোৎকৃষ্ট উপমাসমূহ ব্যবহার করেছেন। কবিকঙ্কণ তার কাব্যে গৌরীর রূপ বর্ণনায় সংস্কৃত পুরাণের সহায়তা নিলেও পরিবেশ রচনায় প্রত্যক্ষ পরিচিত দারিদ্র্য্যলাঞ্ছিত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের পরিচয়ই কাব্যে ফুটে উঠেছে। সমসাময়িক যুগের বাংলাদেশে কৌলীন্যপ্রথার যে উপদ্রব চলছিল জগন্মাতা উমার পিতাকেও সেই প্রথার শিকার হতে হয়েছিল। তাই তাকেও ভাবতে হয়—

‘অকুলীনে দিলে সুতা    সভামাঝে হেঁট মাথা

বংশে বংশে থামিয়ে গঞ্জন।

লোকে নাহি পরিতোষ    লোকে ঘোষে ধর্মদোষ

বহু পুণ্যে পাই কুলজন।।’

বস্তুত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী আত্মজন পরিবেষ্টিত উমা-মহেশ্বরের যে জীবন-পট উদ্ঘাটন করেছেন, তা’ যে কোনো বাঙালীর নিত্যপরিচিত নিম্নবিত্ত মানব সংসারেরই অপূর্ব রূপায়ণ এখানে হিমালয় মেনকা এবং উমা-মহেশ্বর একান্তভাবে মানব-মানবীরূপে পরিণতি লাভ করেছেন।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রারম্ভেই কবিকঙ্কণ গণেশাদি পঞ্চদেবতা এবং অন্যান্য দেব-দেবীগণের যে বর্ণনা দান করেছেন, তা একান্তভাবেই শাস্ত্রানুগত দেবমাহাত্ম্য এখানে পরিপূর্ণভাবেই বিদ্যমান। এরপর কাহিনীর শুরুতেই দেখা যায় প্রজাপতি দক্ষের কন্যা সতী শিবহস্তে সমর্পিতা। দক্ষ বিরাট যজ্ঞ আরম্ভ করেছেন, কিন্তু শিব-সতীর নিমন্ত্রণ জোটেনি—অবশ্য সতীর তাতে বিরক্তি নেই। কিন্তু মহাদেবের তাতে আপত্তি আছে। তিনি বলেন

‘বিনা নিমন্ত্রণে গেলে হবে মাথাকাটা।

আমার প্রসঙ্গে তুমি পাবে বড় খোটা।’

কবিকঙ্কণ যে সমাজের মানুষ, তার রীতিপ্রকরণ তার অজানা নয়, গোটা ব্যাপারটাকেই আমাদের মধ্যবিত্ত বঙ্গীয় সমাজের ছাঁচে তৈরি করে নিয়েছেন। পিতৃগৃহে যাবার বায়না নিয়ে তাই দেবী বলেন—

‘অনুমতি দেহ হয়    যাইব বাপের ঘর

যজ্ঞ মহোৎসব দেখিবারে।’

কেন তিনি পিতৃগৃহে যেতে চাইছেন, তার কারণস্বরূপ তিনি বলেন –

‘সুমঙ্গল সূত্র করে    আইনু তোমার ঘরে 

পূর্ণ হৈল বৎসর পাঁচ সাত 

দূর কর বিসম্বাদ    পুরহ মনের সাধ 

মায়ের রন্ধনে খাব ভাত।।’

আধুনিক কালেরও যে বাঙালী ঘরের বিবাহিতা কন্যার মনের সাধটিও কি ঠিক এইভাবেই ব্যক্ত হয় না? সতীর মাতৃ-দর্শনে যাবার কাতরতা শুধু এইটুকু কারণেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি আরও বলেন

‘পর্বতবন্দরে বসি    নাহি পাট পড়শী

সীমন্তে সিন্দুর দিতে সখী।’

কিন্তু শিব তো আর সত্যি সত্যি এখানে অনাদি পুরুষ নন, তিনি মুকুন্দ চক্রবর্তীর মতোই একজন সামাজিক মানুষ, কাজেই বিনা নিমন্ত্রণে সতী পিতৃগৃহে গেলে যে লোকনিন্দা হ’তে পারে এ বিষয়ে তিনি সচেতন। তাই তিনি সতীকে যাবার অনুমতি দিলেন না। কিন্তু সতীরও রোখ চেপেছে, তাই—

‘সক্রোধ হইয়া বামা    চলিলা ভ্রুকুটি ভীমা

একাকিনী বাপের বসতি।’

সরোযা সতী দুই প্রহরের মধ্যে পিত্রালয়ের সান্নিধ্যে এসে পৌঁছে গেলেন। লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হল—“সতী আসছেন।’ শ্বশুর দক্ষের সঙ্গে জামাতা শিবের এই কলহে ঘরের গৃহিণী সতী-জননী প্রসূতির কোনো ভূমিকা নেই—সাধারণত মধ্যবিত্ত সংসারে থাকে না। তাই—

‘পাইলে বাপের গ্রাম    শুনিয়া সতীর নাম

প্রসূতি ধাইল বেগবতী।

কোলেতে করিয়া সতী    প্রসূতি পুলক অতি

কৈল সতী মায়েরে প্রণতি।।’

এই চিত্রে কোনো দৈব-মাহাত্ম্য নেই, এ একান্তই মানবসংসারের ঘরোয়া চিত্র।

দক্ষযজ্ঞে সতী ‘দেহত্যাগ ক’রে হিমালয় গৃহে পার্বর্তী উমা রূপে জন্মগ্রহণ করলেন এবং পুনর্বার শিব-হস্তে সমর্পিতা হ’লেন। শুরু হল হর-পার্বতীর নোতুন সংসারযাত্রা—কিন্তু এ সংসার হিমালয় মেনকার সংসারেরই অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ শিব ঘর জামাই হ’য়ে শ্বশুরগৃহে অধিষ্ঠিত হ’লেন। এ চিত্র কোনো দেবসমাজে সম্ভবপর নয়— তৎকালীন সমাজে কুলীন ঘরে এরূপ ঘরজামাই দেখা যেতো, অতএব এ চিত্র মুকুন্দ কবির একান্ত পরিচিত হয়তো স্বগৃহে অথবা প্রতিবেশী-গৃহেই দেখে থাকবে। যাহোক ভূত-প্রেত- প্রথম আদি অনুচরদের নিয়ে গাঁজা ভাং খেয়ে শিবঠাকুর পরমানন্দে শ্বশুরগৃহে দিন কাটাচ্ছেন। এ দিকে উমারও দুটি পুত্রসন্তান হ’লো— কার্ত্তিক আর গণেশ। অতএব মাহেশ্বরের এই বর্ধিত সংসার প্রতিপালনের গুরুদায়িত্ব বর্তালো মেনকার ঘাড়ে— ফলে তার দৈহিক এবং আর্থিক ক্ষমতায় টান ধরে, তার মনে অসস্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। একদিন সখীর সঙ্গে পার্বতীকে পাশাখেলায় রত দেখে মা ফুঁসে উঠলেন—

‘তোমা ঝিয়ে হৈতে গৌরী মজিল গিরিয়াল। 

ঘরে জামাই রাখিয়া পুষিব কতকাল।।

দুগ্ধ উথলিতে গৌরী নাহি দেয় পানী।

সখী সঙ্গে খেল পাশা দিবস-রজনী।।’

বন্যার দায়িত্বহীনতায় ক্ষুব্ধা বিরক্তা মা মেনকা যেন ক্রোধে গর্জে উঠলেন

‘দরিদ্র তোমার পতি পরে বাঘছাল।

সবে ধন বুড়া গোরু গলে হাড়মাল।

ভূতপ্রেত পিশাচ মিলিল তার সঙ্গ।

অনুদিন কত নাকি কিন্যা দিব ভাঙ্গ।।

রান্ধি বাড়ি আমার কাকাল্যে হৈল বাত।

ঘরে জামাই রাখিয়া যোগার কত ভাত।’

বিরক্ত যে শুধু মেনকাই হয়েছেন, তা নয়। তাঁর বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও আরো একজন অন্তরে অন্তরে দগ্ধ হ’চ্ছেন লোক লজ্জার ভয়ে মুখে প্রকাশ করতে পারছেন না তিনি স্বয়ং হিমালয়। একথার সমর্থন মিলে মেনকার উক্তিতে

‘লোকলাজে স্বামী মোর কিছু নাহি কয়।’

দক্ষযজ্ঞে সতী স্বামীনিন্দা শুনে পিতা দক্ষকে অভিশাপ দিয়েছিলেন এবং যজ্ঞস্থলেই দেহত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের যুগে দৈবগুণবর্জিতা এবং সম্পূর্ণভাবেই মানবীভূতা দেবী কিন্তু দক্ষযজ্ঞ বিনাশের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন না, বরং একালের পাড়া-কুঁদুলে মেয়েদের মতোই কোমর বেঁধে মায়ের সঙ্গে কলহে প্রবৃত্ত হলেন।

‘এমন শুনিয়া গৌরী মায়ের বচন।

ক্রোধে কম্পমান তনু বলেন তখন।।

জামাতারে পিতা মোর দিল ভূমি দান।

তাহে ফলে মাষ মুগ তিল সর্বা ধান।।

বান্ধিয়া বাড়িয়া মাতা কত দেহ খোঁটা।

আজি হৈতে তোমার দুয়ারে দিনু কাঁটা।।’

স্বামীপুত্র নিয়ে রাগ ক’রে গৌরী স্বামীগৃহ কৈলাসে চলে এলেন। কিন্তু এই বৃহৎ পরিবারের উদরান্নের সংস্থান হ’বে কোন উপায়ে? কোনো প্রকার জীবিকাসংগ্রহে মহাদেব ব্যর্থ অতএব শুরু হ’ল দারিদ্র্য পীড়িত জীবনের গ্লানিময় দুঃখকাহিনী, গৌরীর সঙ্গে যুক্তি করে মহাদেব ভিক্ষাজীবী হলেন।

‘কেহ দেয় চাল কড়ি    কেহ দেয় ডাল বড়ি

কুপী ভরি তৈল দেয় তেলী।’

এইভাবে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা ক’রে নানা দ্রব্যে ভিক্ষার ঝুলি বোঝাই ক’রে মহাদেৰ বাড়ি ফিরলেন, কিন্তু ঘরে প্রবেশ করবার আগেই—

‘দেখিয়া মোদক খই    দোঁহে আল্য ধাওয়া ধাই

কোন্দল লাগিল দুই ভাই।’

সর্বসিদ্ধিদাতা গজানন এবং ময়ূরবাহন দেবসেনাপতি কার্ত্তিকেয়ের এই আচরণের মধ্যে ব্যঞ্জনায়ও কোনো দৈবমাহাত্ম্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই চিত্রটি আর মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ঘরেরও নয়, এ একেবারেই নিম্নবিত্ত কিংবা বিহীন ভিক্ষাজীবী ঘরেরই চিত্র। যাহোক পরদিন মহাদেব আর ভিক্ষায় যাবেন না, আগের দিন ভিক্ষায় বেরিয়েছিলেন বলে এদিন একটু আয়েস ক’রে খাওয়া-দাওয়া করবেন। এটিও শ্রমজীবী বাঙালী নিম্নবিত্ত ঘরেরই এক নিত্যকালীন চিত্র। তাই, গৌরীর সামনে তুলে ধরলেন ভূরিভোজের এক বিরাট্ তালিকা। বিরক্ত ও বিস্মিত গৌরী বলেন—

‘রন্ধন করিতে ভাল বলিলেন গোঁসাই।

প্রথমে যে দিব পাতে তাই ঘরে নাই।।

আজিকার মত যদি বান্ধা দেহ শূল। 

তবে সে আনিতে পারি প্রভু হে তণ্ডুল।।’

গৌরীর আস্পর্ধায় মহাদেব ক্ষিপ্ত হ’য়ে উঠলেন। তিনি বলেন

‘আমি ছাড়ি ঘর    যাব দেশান্তর

কি মোর ঘর করনে।

হয়ে স্বতস্তর    সুখে কর ঘর

লয়ে গুহ গজাননে।….

গৃহিণী দুর্জন    ঘল হৈলা বন

বাস করি তরু-তলে।’

বিস্ময়াহত গৌরী বলেন

‘কি জানি তপের ফলে বর মিল্যাছে হর।

পাট পড়শি নাহি আসে দেখি দিগম্বর।..

দারুণ দৈবের ফলে হইনু দুঃখিনী।

ভিক্ষার ভাতে দারুণ বিধি করিল গৃহিণী।।…

উচিত কহিতে আমি সবাকার ঐরি।

দুঃখ যৌতুক দিয়া পিতা বিভা দিল গৌরী।।’

স্বামী-স্ত্রীর এই উতোর-চাপান কোনো দৈববাণী নয়, দেব-মাহাত্ম্যের ছিটেফোটার সন্ধানও এখানে পাওয়া যাবে না। এ একেবারেই ভিক্ষাজীবী নিঃসম্বল মানবগৃহস্থ ঘরের শাশ্বত কান্না। মুকুন্দের প্রতিবেশী কোনো এক শিবঠাকুর ও গৌরীঠাকরুণের দৈনন্দিন জীবনযাপনের কাহিনী।

এরপর মর্ত্যলোকে নিজের পূজা প্রচারের জন্য মহাদেবের প্রতি গৌরীর অনুরোধে ছলের সহায়তায় ইন্দ্রপুত্রকে মর্ত্যলোকে প্রেরণ, কিংবা চণ্ডী-কর্তৃক সোনার ঘড়া নিয়ে কালকেতুর অনুগমন প্রভৃতি ঘটনায়ও দৈবমাহাত্ম্য নেই—সমস্ত কিছুর মধ্যেই সহজ স্বাভাবিক মানবীয়তার স্ফুরণই লক্ষ্য করা যায়।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দেবদেবী চরিত্রে মানবীয়তা বিষয়ে ডঃ অরবিন্দ পোদ্দার লিখেছেন : “মঙ্গলকাব্যের বাইরের ছাঁচটা পৌরাণিক, কিন্তু তার অস্তর সম্পর্কে মানবিক। বিভিন্ন দেবদেবীর জন্ম, ঘর সংসার, দ্বন্দ্ব ও প্রাধান্যলাভের উপাখ্যান মঙ্গলকাব্যের উপজীব্য— এটা তার বাইরের রূপ। কিন্তু এই বহিরাবরণের মধ্যে যে কাহিনী রূপায়িত হয়েছে, তা একান্তভাবে মানবিক, এবং বিভিন্ন দেবদেবীর যে পারস্পরিক কলহ এবং শক্তির সংগ্রাম তা সংঘটিতও হচ্ছে মানবিক পটভূমিতেই। মানুষের পরিকল্পিত দেবতা মানুষেরই প্রতিবিম্ব-স্বরূপ তাই তাদের আচার-আচরণ ব্যবহার ইত্যাদি সম্পূর্ণ মানুষেরই মত— স্থানকালবিধৃত যে কোনো সামাজিক মানুষের মত। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যে মনোভঙ্গী বা গুণ বা বৈশিষ্ট্য অভিবাক্ত, তাই দেবতাতে আরোপিত হয়েছে। তাই সম্পূর্ণ অমানবিক গুণপ্রকৃতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে অতি তুচ্ছ অতি নগণ্য মানবিক গুণ – যেমন ঈর্ষা, ভয় এবং যে কোনোরূপ নীচতা। অর্থাৎ কবি-মানস কোনে অপ্রাকৃত, অলৌকিক বা অ-সত্য জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন নি। তাঁর বিচরণ-ভূমি প্রতিদিনকার পরিচিত জগৎ, নিতা পদক্ষেপের এলাকা দেবতাকে মানুষেরই মত দোষগুণের অধিকারী বলে চিত্রিত করা, অথবা ব্যাবহারিক বাস্তব পৃথিবীর সীমার মধ্যে অলৌকিক শক্তিতে আকৃষ্ট করার এই যে প্রবণতা ও চেষ্টা, তা’ মানুষের বুদ্ধিগত বিকাশধারী ও চিন্তাশীলতার বিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য স্তর…. সুতরাং মঙ্গলকাব্যের মানবায়িত দেবদেবীর কাহিনীর মধ্যে মানুষের বর্ধিষ্ণু আত্মচেতনার স্বাক্ষর বর্তমান।”