কবি জীবনানন্দ দাশ ‘কবিতার কথা’ গ্রন্থে বলেছিলেনঃ “কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসসচেতনা, মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।” একথা অনস্বীকার্য, মঙ্গলকাব্য মাত্রেই সমাজের চিত্রাল্পনা। ‘চণ্ডীমঙ্গলকাব্য’ও তার ব্যতিক্রম নয়। তথ্যগত সাক্ষ্যে সুস্পষ্ট, মুকুন্দরামের কাব্যে সমাজচিত্র ইতিহাসের দিক থেকে ষোড়শ শতকের বঙ্গদেশের এক মূল্যবান album।

আমরা জানি, মঙ্গলকাব্যের কাহিনী কবির নিজস্ব কল্পনার ফসল নয়। ঐতিহ্যের ধারায় প্রাপ্ত কাহিনীর প্রথানুকুল পথেই কবির বিশ্বস্ত পদচারণা। তার মধ্যে কোন লেখকের লেখায় প্রথার প্রস্তরশৈল ভেদ করে আপন প্রতিভা ও জীবনাদর্শের বিশিষ্টতার জোরে কতটুকু নবীনতা অভিব্যক্ত তা সমালোচকের পক্ষে প্রায় আণুবীক্ষণিক অনুসন্ধানের কাজ। তবু মনে হয়, মুকুন্দরামের কাব্য মধ্যযুগের সমাজচিত্রের বৃহত্তম আশ্রয়ভূমি।

মুকুন্দরামের কাব্যের নাম ‘অভয়ামঙ্গল’। এই কাব্যে সমাজদৃশ্য সর্বত্রই লক্ষ্যগোচর। তবু উল্লেখযোগ্য আলোচনার অংশগুলি হল

(১) গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণনা অংশ। 

(২) পারিবারিক প্রসঙ্গঃ 

  • (ক) হর-গৌরীর সংসার বর্ণনা। 

  • (খ) ব্যাধ-পরিবার তথা কালকেতু-ফুল্লরার জীবনযাপন চিত্র। 

(৩) চণ্ডীর নিকটে পশুগণের দুঃখ নিবেদন। 

(৪) কালকেতুর অঙ্গুরীয়-বিক্রয়ের সময় মুরারি শীল ও তার পত্নীর পরিচয়। 

(৫) কালকেতুর নিকট ভাড়ুদত্তের আগমন, মুসলমান ধীবর-কায়স্থ-গোপ-ব্রাহ্মণ প্রভৃতি জাতি-সম্প্রদায়ের আগমন। 

(৬) গুজরাট নগরের বসতি বিবরণ। 

(৭) হাটপত্তন ইত্যাদি।

মুসলিম শাসকশ্রেণীর প্রাথমিক অবস্থায় এদেশে অত্যাচারের ঘটনা ইতিহাসে সুবিদিত। সেই ধরনের এক গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশ ডিহিদার মামুদ শরীফের অত্যাচারে ঘুমস্ত ব্রতকথার মতো শান্ত পল্লীবাংলার জনমানসে নেমেছে আশঙ্কার ধ্বস্। ডিহিদার-পোদ্দার-উজীরের অত্যাচার ক্রমশই বেড়েছে। ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণবের বিরুদ্ধে মুসলমান শাসকশ্রেণীর বিদ্বেষ হয়েছে ঘনীভূত। এই বিদ্বেষের পরিচয় বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণে’ও পাওয়া যায় প্রায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সাক্ষ্যে। মুকুন্দরামের কাব্যে পাই এর ব্যাপকতম ও সূক্ষ্মতম প্রকাশ

পেয়াদা সবার কাছে     প্রজারা পালায় পাছে 

দুয়ার চাপিয়া দেয় থানা। 

প্রজা হইল ব্যাকুলি    বেচে ঘরের কুড়ালি

টাকায় দ্রব্য বেচে দশ আনা ৷৷”

যুগের এই সঙ্কটময় কালাপাহাড়ী মুহূর্তে কবিকে দেশত্যাগ করে যাত্রা করতে হয়েছে অজানার উদ্দেশে। পথশ্রমে ক্লান্ত কবির সে সময়কার নিরাসক্ত বর্ণনা :

“তৈল বিনা কৈল স্নান    করিনু উদক পান

শিশু কাঁদে ওদনের তরে।”

এ কথা অনস্বীকার্য, “Poverty is very good in poems, but very bad in the house, very good in maxims and sermons, but very bad in practical life”– H. W. Beecher. বহু সমালোচকের তাই সুচিন্তিত অভিমত, এর মধ্য দিয়ে কবির ‘না-বলা বাণীর’ গোপন ব্যথা রেখায়িত। কিন্তু মুক্ত মন নিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, কবির সেই অন্তরবেদনার রক্তবিন্দু একাব্যে রসসিন্ধু হয়ে ওঠে নি। কেননা মুকুন্দরাম দুঃখের অভিজ্ঞতা হয়ত লাভ করেছিলেন, কিন্তু আজীবন যে তাঁকে দুঃখের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে কাব্যের মধ্যে তার পরিচয় নেই। দেশত্যাগের পরে বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয়ধন্য অবস্থার অস্বাচ্ছল্য যে কবিকে দুঃখ দিয়েছে তারও কোন প্রমাণ কাব্যে নেই। প্রকৃতপক্ষে, দুঃখের দু-একটি কথা থাকলেই কবিকে সম্পূর্ণভাবে ‘দুঃখবাদী’ বলে চিহ্নিত করা যায় না। প্রবল ঘটনা তরঙ্গের শিখরকে দুই হাতের মুষ্ঠিতে প্রচণ্ড চেপে‌ উল্লাসের বিপুলতাকে তিনি আকণ্ঠ পান করতে চান নি। তাই শাস্তির দস্যুর প্রতি কবির‌ সুশাণিত বিদ্রুপ বা ক্রোধোদ্দীপ্ত অভিশাপ অনুপস্থিত। উদ্ধত স্বৈরাচারী রাজশক্তি কবি মনে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল সেই ক্ষত আজ বিলুপ্ত, সেই ক্ষতের জ্বালাও হয়ত কবে মুছে গেছে, শুধু আছে সেই ক্ষতের একটি স্মৃতিচিহ্নরেখা ‘বিগলিত-করুণার-জাহ্নবী-যমুনায়’ কবি চিত্ত অভিষিক্ত বলেই আধুনিক কবির মত তিনি বলতে চান নি— “ঘৃণায় সমুদ্র নীল নীল জল আকণ্ঠ ঘৃণায়” (বিষ্ণু দে)।