ষোড়শ শতকে চণ্ডীমঙ্গল তথা মঙ্গলকাব্যের সব চাইতে দীপ্তিমান কবি মুকুন্দরাম। তার সঙ্গে দ্বিজমাধবের তুলনা অনেক রসিক ঐতিহাসিককে ভাবিয়েছে। সেইসব ভাবনার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় এইভাবে সূত্রাকারে বলা যায় :

(ক) কালকেতুর বাল্যক্রীড়া বর্ণনায় দ্বিজমাধব বলেছেন

“তবে বাড়ে বীরবর    জিনি মত্ত করিবর

গজশুণ্ড জিনি কর বারে।

যতেক আখেটি সুত     তারা সব পরাভূত

খেলায় জিনিতে কেহ নারে ॥ 

বাঁটুল বাঁশ লয়ে করে     পশুপক্ষী চাপি ধরে

কাহার ঘরেতে নাহি যায়।

কুঞ্চিত করিয়া আঁখি    থাকিয়া মারয়ে পাখী

ঘুরিয়া ঘুরিয়া পড়ে যায় ।”

এখানে কালকেতুর পক্ষী শিকারের মধ্যে শিকারের একাগ্রতার দৃশ্য, পাখিটি ঘুরে ঘুরে পড়ার গতিময় চিত্র প্রত্যক্ষ বাস্তবতায় উপভোগ্য। অথচ কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম কালকেতুর বীরত্বের যে বর্ণনা দেন সেখানে অলঙ্কারের আড়ালে কালকেতুর পূর্ণ বীর্য প্রকাশ পায়। সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, এখানে আছে সময়কালীন শিশু কালকেতু-বৃদ্ধির সংবাদ

“দশ মাসে ধায় বালা দিয়া হামাগুড়ি।

ধরিতে ধরিতে যায় বাঁকুড়ি বাঁকুড়ি ৷৷ 

একাদশ মাস গেল হইল বৎসর। 

ঘরে ঘরে ফিরে শিশু মনে নাহি ডর ॥” 

দুই তিন সমা গেলে শিশুগণ মেলে।

ভল্লুক শরভ ধরি কালকেতু খেলে ৷৷”

আর এইভাবে সকলের চোখের সামনে—

“দিনে দিনে বাড়ে কালকেতু।

মাতঙ্গ জিনিয়া গতি    রূপে জিনি রতিপতি

সবার লোচন-সুখ-হেতু ৷৷”

তবে সামগ্রিকভাবে চরিত্রটির নির্মাণে কবিকঙ্কণ কালকেতুর বন্য পৌরুষের মর্যাদা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেন নি। দ্বিজমাধব কিন্তু এক্ষেত্রে সফল শিল্পী।

(খ) কবিকঙ্কণের কাব্যে পারিবারিক তথা সমাজচিত্রের উপস্থাপনায় বাঙালীর সংসারজীবনের নিঁখুত ও বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায়। প্রসূতির আহারে অরুচি, গর্ভবেদনা ও নবজাতকের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, পণপ্রথা বা যৌতুকদান ইত্যাদি সবকিছু এক সামগ্রিক অভিজ্ঞতায় বিধৃত হয়েছে। সেই তুলনায় দ্বিজমাধবের কাব্যে কালকেতুর বিবাহ-অনুষ্ঠান অনার্য সমাজসম্মত। বর্ণনা অংশও সংক্ষিপ্ত। রন্ধন-তালিকাও ব্যাধ পরিবারের রুচি ও অর্থসঙ্গতি অনুযায়ী স্বল্প উপকরণে সীমাবদ্ধ। মুকুন্দরামের কাব্যে ব্যাধজীবনের ক্রিয়াকাণ্ডে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির আরোপ করা হয়েছে। বাস্তবতা এবং স্বাভাবিকতা রক্ষা করে দ্বিজমাধব বিবাহসভায় উপস্থিত ব্যাধ রমণীদের অপরিচ্ছন্ন শরীর এবং উদ্ভট সাজসজ্জার বর্ণনা দিয়ে কৌতুকরস সৃষ্টি করেছেন। তবে কবিকঙ্কণের মতো সে চিত্র উপভোগ্য হয় নি।

(গ) মাধব বন্য পশুর আক্রমণে কালকেতুর পিতা ধর্মকেতুর জীবনাবসান বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে মুকুন্দরাম ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিধি মেনে কালকেতুর পিতামাতাকে কাশীধামে পাঠিয়েছেন। এমন কি উচ্চবর্ণের অনুকরণে কালকেতুর দ্বারা তাদের মাসোহারার ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছেন।

(ঘ) দ্বিজমাধবের কাব্যের দেবী চণ্ডী মঙ্গলাসুরকে বধ করে তার রণরঙ্গিণী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কলিঙ্গ কালকেতুর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। কিন্তু মুকুন্দরামের কাব্যে চণ্ডী ডাকিনী যোগিনীসহ স্বয়ং সশরীরে যুদ্ধে অবতীর্ণা হয়ে কালকেতুকে শত্রুপক্ষের অস্ত্রক্ষেপ থেকে রক্ষা করেছেন। এদিক থেকে ভক্তের প্রতি তার করুণার মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।

(ঙ) ভাঁড়ু দত্ত চরিত্র-সৃষ্টিতে উভয় কবিই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তবে পরিণতি প্রদর্শনে কিছুটা পার্থক্য আছে। দ্বিজমাধব দেখিয়েছেন, ভাঁড়ুর পেটে ভাত নেই। কিন্তু পান খেতে তার জুড়ি নেই : “উদরে না চিনে অন্ন তাম্বুল পান মুখে।” সে যেমন স্বার্থপর ভণ্ড, তেমনি নির্লজ্জ। তাই কালকেতুর আদেশে তার মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গঙ্গাপার করে দেওয়া হলেও সে লোকেদের বলে বেড়ায় “গঙ্গাপাড়ে গিয়া মুড়াইয়াছি মাথা।” বিপরীতভাবে মুকুন্দরাম তার পরিণতি প্রদর্শনে রাজা কালকেতুর ক্ষমাশীল মনোভাব দেখিয়েছেন। পুরবাসীদের হাতে তার চূড়ান্ত লাঞ্ছনা দেখে শেষে,

“ভাড়ুর লাঘবে বীর দুঃখ ভাবে বড়ি।

কৃপা করি পুনর্ব্বার দিল ঘর-বাড়ী ।”

(চ) মুকুন্দরামের কাব্যে বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার যে অপূর্ব সম্মেলন ঘটেছে, দ্বিজমাধবের কাব্যে তা একেবারেই ঘটেনি। তাই শৈল্পিক বিচারে কবিকঙ্কণের কাব্য শ্রেষ্ঠতর বলে মনে হয়।