‘চণ্ডীদাস সুখের কথায় বড় নহনে, দুঃখের কথায় বড়।’
উত্তর: বাংলা ভাষায় রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলাগানের আদিকবি, বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতার সর্বজনপ্রিয় পদাবলীগানের কবি হলেন চণ্ডীদাস। তিনি ছিলেন বীরভূম জেলার নানুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। চণ্ডীদাসের একটি লোক প্রচলিত পরকীয়া প্রেম-আখ্যায়িকা রয়েছে। বাশুলী মন্দিরে প্রভাত সূর্যালোকে তিনি এক ‘সোনার পুতুলী’কে দেখেছিলেন। প্রেমাকুল হয়ে বাশুলী দেবীর কাছে কর্তব্যপথের নির্দেশ চেয়েছিলেন। দেবীর আদেশেই তিনি ইন্দ্রজিৎ হয়ে রজকিনী রামীকে ভালোবেসেছিলেন। বাশুলী নাকি বলেছিলেন, “তুমি ইন্দ্রজিৎ হইয়া এই নারীকে ভালোবাস, ইনি তোমার হৃদয়কে যে পবিত্রতা দিবেন-ব্রহ্মা, বিষ্ণু কিংবা আমিও তোমাকে তাহা দিতে পারিব না।”
রজকিনী রামীর প্রেমাসক্ত হওয়াতে চণ্ডীদাস সমাজচ্যুত হয়েছিলেন এবং তাঁকে সমাজে তুলবার জন্য ভ্রাতা নকুল চেষ্টা করেছিলেন একাধিক পদে তার প্রমাণ মেলে। তাঁর নিজের জীবনে রজকিনী প্রেম কামগন্ধহীন নিকষিত হেম হয়ে উঠেছিল কি না তা লোকশ্রুতির বিষয়-কিন্তু পদাবলীর রাধা চিত্র আঁকতে গিয়ে তিনি সেখানে যে একটি কামগন্ধহীন পবিত্র প্রেমরতির দেহদীপ বিরহের অগ্নি প্রজ্বলনে অনির্বাণ জ্বালিয়ে রেখেছেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিরহের চিত্র অঙ্কনে চণ্ডীদাস ছিলেন অদ্বিতীয়। আলোচ্য প্রবন্ধে বিরহের বা দুঃখের পদ রচনায় চণ্ডীদাসের সার্থকতার বিষয়টি তুলে ধরার প্রয়াস পাব।
চণ্ডীদাস এবং বিদ্যাপতি, চৈতন্যপূর্ব এই দুই কবি সমগ্র পদাবলী গানের শ্রেষ্ঠ কবি পদাবলী রচনার দুটি ধারা প্রবর্তন করেছিলেন। সেই যুক্তবেণী সংগমেই চৈতনোত্তর পদাবলী গানের | বিপুল সমৃদ্ধ প্রবাহ দেখা গিয়েছিল। একই বিষয়বস্তুকে বাংলার রজকিনী প্রেমিক বাশুলী। সেবক পল্লিকবি এবং মিথিলার তৎকালীন শাস্ত্রবিদ, ছন্দবিদ, আলঙ্কারিক রাজদরবারের শ্রেষ্ঠ নাগরিক। কবি- দুই পৃথক আধারে, সাজিয়ে রসিক পাঠকবৃন্দের কাছে পরিবেশন করেছেন। লোকশ্রুতির কিছু মর্যাদা দিয়ে বলতে হয়- রামীকে কেন্দ্র করে নানুরের কেবি কামগন্ধহীন নিকষিত হেম সদৃশ যে প্রেমামৃতের সন্ধান পেয়েছিলেন কৃষ্ণপ্রিয়ার চিত্রাঙ্কনে সেই বৈরাগিনী যোগিনী প্রেমসাধিকাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। এ যুগের চণ্ডীদাসের মর্মকথাটি যেন ব্যক্ত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়:
“আর পাব কোথা?
দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।”
চণ্ডীদাসের পদে রাধার কামাসক্তিবিহীন নিরাভরণ প্রগাঢ় প্রেমচিত্র ফুটে উঠেছে। সে চিত্র প্রেমের, সে ছবি যন্ত্রণাদগ্ধ রাধার হৃদয়ের:
“রাধার কি হলো অন্তরে ব্যথা।
বসিয়া বিরলে, থাকয়ে একলে
না শুনে কাহারো কথা ॥” (৩৬ নং পদ)
বাইরের সাজে নিরাভরণ যোগিনীর রাঙা রং, অন্তরে গাঢ় কৃষ্ণ শ্যাম রঙে রাধা হয়ে উঠেছে শ্যামল মাটির কোমল মেয়ে। চণ্ডীদাসের ভাষা ও ছন্দে সরল অলঙ্কারবিহীন এক প্রাণস্পর্শী আবেগ অজস্র করুণা ধারায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে চণ্ডীদাসের কন্ঠে। প্রতিটি কথায় তিনি যেন এক প্রাণভরা অভিমান-স্নেহ- বিষাদ মেশানো গভীর রসনিষিক্ততার স্বাক্ষর রেখেছেন। রাধা প্রেমাকুল চণ্ডীদাস সব প্রসাধন প্রেমাকুল ভাব বিগলনে একাকার হয়েছেন। রসতন্ময়তায় রাধিকা কৃষ্ণপ্রেমে আত্মবিসর্জিত হয়েছে। কবিও রাধার ভাবতন্ময়তায় একাত্ম হয়েছেন:
“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।” (৪০ নং পদ)
অনেকেই চণ্ডীদাসের পদে বিধৃত প্রেমকল্পনাকে আধ্যাত্মিকতার উচ্চাঙ্গের প্রকাশ হিসেবে মতপ্রকাশ করেছেন। তাঁর রচিত পদগুলো রোমান্টিক প্রণয়-কবিতা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে মত দিয়েছেন ড. ক্ষেত্রগুপ্ত। চণ্ডীদাস রচিত পদে বিরহের এক বেদনাময় নীল যন্ত্রণার উপস্থিতি আছে। পদাবলী সাহিত্যে প্রেম-বিরহের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার প্রকৃত পরিচয় চণ্ডীদাসের পদেই যথার্থ অঙ্কিত হয়েছে। তিনি তাঁর সৃষ্ট পদে রাধার মধ্যে নিজেকেই মিশিয়ে ফেলেন। রাধার বিরহবোধ যন্ত্রণাকাতর হৃদয়ের আর্তি প্রকাশ করতে গিয়ে চণ্ডীদাস সেই বিরহবোধ ও হৃদয় যাতনাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে তোলেন। ড. ক্ষেত্রগুপ্ত মনে করেন তাঁর এই ভাবপ্রবণতা এতটাই বেশি যে, তা স্পর্শকাতর ও কোমল; একান্ত করুণ ও জলভরা শ্যামল মেঘের সাথেই তার তুলনা করা চলে। তাঁর কামনা বাসনাহীন প্রেমে মিলনের চেয়ে বিচ্ছেদের বেদনা অধিকতর মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেঃ
“এমন পিরীতি কভু নাহি দেখি শুনি
পরাণে পরাণ বান্ধা আপনা আপনি ॥
দুহু ক্রোড়ে দুই কান্দে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।
তিল আধ না দেখিলে যায় যে মরিয়া ॥” (৭৭ নং পদ)
চণ্ডীদাসের পদাবলীতে আমরা মিলনকামী বিবহী আত্মার আকুল আকুতি শুনতে পাই। তাঁর পদগুলোতে মিলনের মাঝেও বিচ্ছেদের কারুণ্য লক্ষ করা যায়। প্রেমে আত্মনিবেদন সহজসরল ভাষা বৈশিষ্ট্যে অপার্থিব ভাব জাগিয়ে তুলেঃ
“বঁধু কি আর বলিব আমি।
মরণে জীবনে জনমে জনমে
প্রাণনাথ হৈও তুমি।”
প্রতীক্ষাদঃখবিহীন অবিমিশ্র সুখ চেতনার সেখানে স্থান হয় নান গৃহকাজে প্রেমিকা গৃহপিঞ্জরাবদ্ধ হয়ে থাকলেও প্রেমিক কৃষ্ণ কিন্তু তার দেরি দেখে নিজেই দেখা দেন। তখন সব বাধা জলাঞ্জলি দিয়ে রাধাকে বেরুতে হয়। কৃষ্ণের দুঃখ তার সহ্য হয় না।
“এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইল বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া তিতিছে
দেখিয়া পরাণ ফাটে।” (৬৭ নং পদ)
মর্মস্পর্শী অসংখ্য শব্দের মাধ্যমে তিনি বেদনামধুর যে প্রেমের কল্পলোক গড়ে তুলেছেন এ জন্য বোধ হয় চৈতন্য পরবর্তী গীতিকারেরা চণ্ডীদাসের কাছে ঋণী। চণ্ডীদাসের ভাষার শব্দসম্পদে বাংলার স্বকীয় স্নেহ অনুযোগ, সৌন্দর্যের ধারাস্নান, সুখ-দুঃখ নিংড়ানো প্রেমের আর্তি, লোকচেতনার বিভিন্ন প্রকাশ, পদাবলীর একটি নিজস্ব প্রকাশরীতির পরিচয় বহন করছে। বিরহের মাত্রাকে গভীর করতে কবি কালিয়া বঁধু, বিনোদ বঁধুয়া, কালা জপমালা, কুলবতী নারী, বিনোদ নাগর, সতী কুলবতী প্রভৃতি মানবহৃদয়স্পর্শী শব্দমালা ব্যবহার করেছেন। পিরীতিসর্বস্ব পদাবলী সাহিত্যে হৃদয় নিঙড়ানো সুখ-দুঃখময় প্রেমের আকুলতাও চণ্ডীদাস প্রথম প্রকাশ করেছেন। প্রেমের মাঝে যে এত যন্ত্রণা আছে চণ্ডীদাস সুন্দর ভাষাভঙ্গিতে তার বর্ণনা দিয়েছেন। পিরীতের প্রতি আক্ষেপ জানিয়ে কবি বলেন:
“সই কে বলে পিরীতি ভাল।
হাসিতে হাসিতে পিরীতি করিয়া
কাঁদিতে জনম গেল।” (১১৫ নং পদ)
প্রেমের যন্ত্রণা অসহনীয়। সব মানুষের দেয়া কষ্ট সহ্য করা যায়, কিন্তু মনের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া কষ্ট সহ্য করা যায় না। মনের মানুষ যখন তার প্রেয়সীকে এড়িয়ে চলে, অবজ্ঞা করে তখন তার কষ্ট হয় অবর্ণনীয়। এই অবর্ণনীয় যন্ত্রণার চিত্রই ফুটে উঠেছে নিম্নোক্ত পদে:
“সই কেমনে ধরিব হিয়া
আমার বঁধুয়া আন বাড়ী যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া ॥ ” (৫৯ নং পদ)
পদাবলী সাহিত্যে চণ্ডীদাসের বড়ো পরিচয় বিরহের কবি হিসেবে। রাধাবিরহের পদগুলো যেভাবে পাঠকচিত্তকে আলোড়িত করে, আর অন্য কোনো কবির পদে তার অস্তিত্ব বিরল। চণ্ডীদাসের পদগুলোতে পার্থিব জীবনে নরনারীর প্রেম-বিচ্ছেদের চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি শ্রীমতি রাধার মর্মবেদনা কবি মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। পদাবলীর চণ্ডীদাস তাঁর রচনায় মানবমনের চিরন্তন বিরহবোধকে যে কৌশলে ধারণ করেছেন তা অবিস্মরণীয় ও তুলনাহীন। তাই বলা হয়ে থাকে- ‘চণ্ডীদাস সুখের কথায় বড় নহেন, দুঃখের কথায় বড়।”
Leave a comment