অথবা, চণ্ডীদাস সমস্যার কারণ সংক্ষেপে লেখ

অথবা, কোন প্রেক্ষাপটে চণ্ডীদাস সমস্যার সূত্রপাত ঘটে – সংক্ষেপে লিখ

উত্তর: চণ্ডীদাস সমস্যা বাংলা সাহিত্যে একটি বিতর্কিত সমস্যা। চণ্ডীদাসের পদাবলী দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত থাকলেও একাধিক চণ্ডীদাস সম্পর্কিত চণ্ডীদাস সমস্যার উদ্ভব হয়েছে ” ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে [১৩২৩ বঙ্গাব্দ) বসন্তরঞ্জন রায় সম্পাদিত “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” কাব্য প্রকাশের পর থেকে।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ গ্রন্থের ভণিতায় কবির নাম পাওয়া যায়। একাধিক- ‘বডু’ অথবা ‘অনন্ত বডু’ উপনামযুক্ত। অথচ এযাবৎকাল ‘দীন’ ‘দ্বিজ’, ‘দীনক্ষীণ’, ‘তরুণীরমণ’ আদি যে সকল উপনাম চণ্ডীদাসের নামের সঙ্গে যুক্ত হতো, তাদের সামগ্রিক ‘স্মনুপস্থিতি কৌতূহলোদ্দীপক। বিষয়, ভাব, রচনাভঙ্গি, ভাষা-আদি সবদিক থেকেই ‘শ্রীকৃষ্ণকীতর্নের’ সাথে প্রচলিত পদাবলি সাহিত্যের পার্থক্য সুস্পষ্ট। অতএব, অতি সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ো চণ্ডীদাস কে এবং চণ্ডীদাসের সংখ্যাই বা কত? ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত দীনেশ চন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” গ্রন্থে ‘অনন্ত’, ‘বড়’ একাধিক চণ্ডীদাসের কথা বলেছিলেন। এরপর ২৩৪১ বঙ্গাব্দে (১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ) মণীন্দ্রমোহন বসু কর্তৃক দীন চণ্ডীদাসের পদাবলি প্রকাশিত হলে চণ্ডীদাস সমস্যা আরো দৃঢ় এবং জটিল হয়ে ওঠে।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” প্রকাশের পর দেখা গেল এ কাব্যের ভাষা, রুচি ও রসের ধারার সঙ্গে পদাবলীর চণ্ডীদাসের বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। বাশুলী সেবক বড় চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা এবং তিনি চৈতন্যপূর্ববর্তী কবি। পদাবলীর চণ্ডীদাসের সঙ্গে তাঁর কোনো সামঞ্জস্য নেই। তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়ু চণ্ডীদাস ও পদাবলীর দ্বিজ চণ্ডীদাস ভিন্ন কবি বলে ধারণা জন্মে। পরে মণীন্দ্রমোহন বসু দেখালেন যে- পদাবলীর চণ্ডীদাস বড়ু চণ্ডীদাস বা দ্বিজ চণ্ডীদাস নন, তিনি দীন চণ্ডীদাস। বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে ভাগবত অবলম্বনে পাণ্ডিত্য ও কবিত্ব সহযোগে রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক আখ্যানকাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন। শ্রীচৈতন্যদেবের কোনো একজন চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদন করতেন। ড. সুকুমার সেন ও মণীন্দ্রমোহন বসু দুজন চণ্ডীদীসের কথা বলেছেন। অন্যদিকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও সতীশচন্দ্র রায়ের মতে চণ্ডীদাস তিন জন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও তিনজন [বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস) চণ্ডীদাসের কথা উল্লেখ করেছেন। ড. আহমদ শরীফ তিন জন চণ্ডীদাসের কথা বলেছেন। একাধিক চণ্ডীদাস সম্পর্কিত তথ্য-

  • ক. অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস- সর্বপ্রাচীন চণ্ডীদাস।
  • খ. চণ্ডীদাস- চৈতন্য-পূর্বকালের বা জ্যেষ্ঠ সমসাময়িক।
  • গ. দীন চণ্ডীদাস আঠারো শতকের শেষার্ধ।
  • সকলের মতামত থেকে যে তিনজন চণ্ডীদাসের অস্তিত্বের কথা জানা যায় তাঁরা হলেন-
  • ক. প্রাকচৈতন্যযুগের বড়ু চণ্ডীদাস।
  • খ. প্রাক চৈতন্যযুগের উৎকৃষ্ট শ্রেণির পদাবলীর চণ্ডীদাস।
  • গ. চৈতন্যোত্তর যুগের পালাগান রচয়িতা দীন চণ্ডীদাস।

এখন প্রশ্ন চণ্ডীদাস কয়জন ছিলেন? ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের’ চণ্ডীদাস এবং পদাবলীর চণ্ডীদাসকে নিয়ে যে সমস্যার উদ্ভব ঘটেছিল তাদের পৃথক ব্যক্তিরূপে নির্দেশ করে সমস্যার সমাধান করা হয়েছে বটে, কিন্তু পদাবলীর চণ্ডীদাস সমস্যার নিরসন এখনো হয়নি। বিভিন্ন পদাবলীর ‘দীন, দ্বিজ, দীনক্ষীণ, আদি, তরুণী-রমণ’ ইত্যাদি উপাধিযুক্ত এবং নিরুপাধিক চণ্ডীদাসেরও প্রচুর পদ বর্তমান। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বড়ু চণ্ডীদাস ছাড়াও আরো দু’জন চণ্ডীদাসের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, “দীন চণ্ডীদাস একটি ধারাবাহিক কৃষ্ণ যাত্রা রচনা করিয়াছেন যেমন বড়ু চণ্ডীদাস একটি ধারাবাহিক কৃষ্ণ ধামালী রচনা করিয়াছেন।”

পরিশেষে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যের একটি বিতর্কিত সমস্যা চণ্ডীদাস সমস্যা। চণ্ডীদাস সমস্যা সম্পর্কিত মতবাদগুলো এরূপ দাঁড়ায়: ড. দীনেশচন্দ্র সেন, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী অভিন্ন চণ্ডীদাস মনে করেন। বসন্তরঞ্জন রায় পদাবলী ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কবিকে এক ব্যক্তি ধরেছেন। মণীন্দ্রমোহন বসু ও ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় চৈতন্যাপূর্ব বড়ু চণ্ডীদাস এবং চৈতন্যপরবর্তী দীন বা দ্বিজ চণ্ডীদাসের কথা বলেছেন। ড. সুকুমার সেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কবি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উল্লেখযোগ্য চণ্ডীদাসের অস্তিত্বে সন্দিহান। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাসের কথা বলেছেন। প্রকৃতঅর্থে এ সমস্যা সমাধান করার মতো কোনো উপাদান এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাঁদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট-সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় চণ্ডীদাস সমস্যা বাংলা সাহিত্যে একটি রহস্যজনক অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে।