চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য রোমান্টিক কবি জ্ঞানদাসের সঙ্গে চণ্ডীদাসের কবি-বৈশিষ্ট্যের মিল থাকলেও ঈষৎ পার্থকও বিদ্যমান। চণ্ডীদাসের– “দেশে দেশে ভরমিব যোগিনী হইয়া” এবং জ্ঞানদাসের— “পরিয়া অরুণবাস যোগিনী হইব।” উভয় উচ্চারণের মধ্যে প্রথমটি ব্যাকুল, শেষোক্তটি বাসনা রঙিন। চণ্ডীদাসের যেখানে ধ্বনি— “কানের ভিতর দিয়া/মরমে পশিল গো/আকুল করিল মোর প্রাণ।” সেখানে— জ্ঞানদাসের “হৃদয়ে পশিল রূপ পিঞ্জর কাটিয়া। জ্ঞানদাসের মনে রহিল জাগিয়া।” পূর্বরাগের কবি চণ্ডীদাসের কবিতায় যেখানে নিরুত্তাপ নম্র দীপশিখা দেখা যায়, ক্ষেপানুরাগের কবি জ্ঞানদাসের কবিতায় সেখানে মৃন্ময় দীপ ধারাটি চোখে পড়ে।

চণ্ডীদাসের সমস্ত কবিতার মধ্যে একটি আত্মসমাহিত ভাব মহিমা রয়েছে। জ্ঞানদাসের‌ কবিতায় দুঃখ ও আনন্দের এক একটি চকিত অভিজ্ঞতা তীব্র ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। গভীর হতাশ্বাসের পাশাপাশি সুদীপ্ত বিশ্বাসের ছবিও তাঁর পদে রয়েছে।

কবি জ্ঞানদাস হলাহলের অতল সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, কখনো আবার সপার্ষদ চৈতন্যদেবের অভিসারের উদ্ভাসিত ছবি মনে এনে বলেছেন— “ররাব মুরজ, বীণা, সুমেলি করিয়া। বৃন্দাবনে প্রবেশিল জয় জয় দিয়া।” আধুনিক কালের লিরিক কবিতায় যেমন পরপর দুটি‌ মুহূর্তে সম্পূর্ণ বিপরীত বোধ ফুটে উঠতে পারে, জ্ঞানদাসের কবিতাতেও তার উদাহরণ পাওয়া যায় সুতরাং একথা মনে করার কোনও সঙ্গত কারণ নেই যে, চণ্ডীদাসের কবিতাকে অনুসরণ করেই তিনি মৌলিকতা খুঁজে পেয়েছিলেন।

রাধাভাবের তন্ময়তায় জ্ঞানদাস গভীরতর, চণ্ডীদাস গভীরতম। চণ্ডীদাসের নায়িকা ভাবের উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত। কিন্তু জ্ঞানদাসের রাধা চণ্ডীদাসের নায়িকার মতো যৌবনে যোগিনী নয়। নিজেকে শ্যাম অনুরাগে রঙিন করে দেখতেই তাঁর ঝোঁক বেশি— “তুয়া অনুরাগের হাম পরি নীল শাড়ী। তুয়া অনুরাগে হাম পীতাম্বর ধরি।” প্রকৃত পক্ষে চণ্ডীদাসের নায়িকার সঙ্গে জ্ঞানদাসের রাধার পার্থক্য সম্ভবতঃ শ্যাম অনুরাগের তারতম্যে।

একজনের কাব্যে আমিত্ব বিলুপ্ত, আর একজনের পদ ‘আমিত্বের’ মত অভিমানে স্পন্দিত। জ্ঞানদাসের রাধা যৌবনের বনে মন হারিয়ে যাবার পর থেকেই একমাত্র অবলম্বন হল যমুনার ঘাট, ঘরে যাওয়ার অতি চেনাপথ, তবু তা যেন নিঃশেষিত—“ঘরে যাইতে পথ মোর হইল অফুরান।” অর্থালংকারের ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ রোমান্টিক এই বাণী ‘বহুযুগের ও পার হতে যোগক্ষেম রবীন্দ্র কণ্ঠে সঙ্গীতায়িত হয়েছে। শব্দঝংকার ও ধ্বন্যাত্মক শব্দের জলতরঙ্গে জ্ঞানদাসের পদ চণ্ডীদাস অপেক্ষা অধিক শিল্পসার্থক।

পূর্বরাগের হৃদয়ভেদী আকুতি অনাড়ম্বর ভাষায় প্রকাশিত : “প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।” অন্তরের পরশের জন্য এই আবেশ বিহ্বলতা বিশ্বসাহিত্যেও দুর্লভ। এই তীব্র আকর্ষণের পরই শ্যাম পদে রাধার গৌর তনু সমপর্ণের তর্পন অনুষ্ঠিত— “শ্যাম রাঙা পায় এতনু সঁপেছি তিলতুলসী জল দিয়া।”

মিলন এবং আক্ষেপানুরাগের পদে জ্ঞানদাসের শিল্প কুশলতা অনবদ্য অমৃত সৌধ নির্মিত। মিলনের সুর বাজাতে গিয়ে চণ্ডীদাসের একতারা যেন ‘সায়াহ্ন সমীরণের দীর্ঘশ্বাসে’ ভারাক্রান্ত। স্বাভাবের তন্ময়তায় জ্ঞানদাস গভীরতর, চণ্ডীদাস গভীরতম। জ্ঞানদাসের পদ থেকে বিরহের ম্লান ধ্বনি উত্থিত হলেও তা চণ্ডীদাসের মত সকরুণ হয়ে বাজেনি। তাঁর রাধা নিঃসংকোচে বলেন “তোমার গরবে গরবিনী হাম রূপসী তোমার রূপে।” কিংবা, “যে ধন তোমারে দিব সেই ধন তুমি।” বেদনা সিক্ত আক্ষেপের ম্লান ছায়া বিষমালংকারের মাধ্যমে অপরিসীম ভাব সুষমায় জ্ঞানদাসের এই পদে মণ্ডিত

“সুখের লাগিয়া এঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল।

প্রেমের পরিণতি পরস্পর আত্মনিবেদনে, প্রেম সাধনার সিদ্ধিও অদ্বৈতসিদ্ধি, নিবেদনের পদ রচনায় জ্ঞানদাস ও চণ্ডীদাস দুজনেই সার্থকতার সীমা-স্বর্গে উন্নীত। তবু এখানে বিদ্যাপতির মত প্রণয় স্মিত জীবনের উচ্ছ্বসিত আনন্দ নেই, নেই চণ্ডীদাসের মতো ‘দুখের বর্ষায় চক্ষের জল। জ্ঞানদাসের রাধা শুধু নিরাভরণভাবে বলেন “হিয়ার হৈতে বাহির হৈয়া। কিরূপে আছিলা তুমি।” অতিতুচ্ছ দুচারিটি কথা। এ যেন গোস্পদে আকাশের ছায়া, বিন্দুতে সিন্দু দর্শনের অভিব্যঞ্জনা। তারপর হৃদয়ের উপরিভাগের চাঞ্চল্যের যে তলদেশে প্রেমের উদ্ভব, সেই অতল স্পর্শ থেকে আশ্চর্য সুধাময় ভঙ্গিতে উচ্চারিত চণ্ডীদাসের শ্রীরাধার কণ্ঠস্বর : “অন্যের আছয়ে অনেকজনা আমার কেবল তুমি।” এছাড়া চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের ‘বংশীশিক্ষা ও নৃত্য পর্যায়ে এই ধরনের কতকগুলি পদ বিধৃত। চণ্ডীদাসের প্রসিদ্ধ পদ যেন স্তোকবাক্যে মহাপ্রভুর আগমনী গান

“আজু কেগো মুরলী বাজায়

এত কভু নহে শ্যাম রায়।” 

অন্য দিকে জ্ঞানদাসের রাধার শ্যামের কাছে প্রশ্নাকুল উক্তি

“কোন রন্ধ্রেতে শ্যাম গাও কোন তান।

কোন রন্ধ্রের গানে বহে যমুনা উজান।”

তাই বলতে হয়, জ্ঞানদাসের কাব্যের এককোটিতে আছে ভাব বিহ্বলতা, অন্য কোটিতে আছে ছন্দমাধুর্য। যথার্থ লিরিক-প্রতিভার একমাত্র উত্তরাধিকারী জ্ঞানদাস। আর পূর্বসূরী রূপে যার নাম সর্বাগ্রে মনে আসে তিনি হলেন কবি চণ্ডীদাস।