অথবা, বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে চণ্ডীদাসের বৈশিষ্ট্য তুলে ধর

অথবা, চণ্ডীদাসের পদের ভাব ও ভাষার পরিচয় দাও

উত্তর : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বৈষ্ণব রস-আশ্রিত রাধা-কৃষ্ণ-বিষয়ক ভক্তিরসমিশ্রিত গীতিকবিতাগুলোই বৈষ্ণর কবিতা হিসেবে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে সৃষ্ট বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের ধারাটি অভিনব মাত্রা ব্যঞ্জনায় বিকশিত হয়েছিল। এ সাহিত্য ধারার অন্যতম কবি বড়ু চণ্ডীদাস।

কবি বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের প্রথম কাব্য লোকসমাজে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণের প্রেমসম্পর্কিত গ্রাম্যগল্প অবলম্বনে কবি বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব‍্য রচনা করেন। ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের এক গৃহস্থ বাড়ির গোয়ালঘর থেকে বড়ু চণ্ডীদাসের নবাবিষ্কৃত কাব্য ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে প্রকাশিত হয়। তাঁর এ কাব্যটি মধ্যযুগের প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন।

বড়ু চণ্ডীদাসের আবির্ভাবকাল সম্পর্কেও মতভেদ বিদ্যমান। কারো মতে, তাঁর জন্মস্থান বীরভূমের নানুর, আবার কারো মতে, বাঁকুড়ার ছাতনা। নানা প্রবাদ, সহজিয়া গ্রন্থ প্রভৃতি অনুসারে বীরভূমের নানুর বাশুলী দেবীর পীঠস্থান বড়ু চণ্ডীদাসের জন্মস্থান। আবার বাঁকুড়ার ছাতনা গ্রামে বাশুলী দেবীর মন্দির ‘ও চণ্ডীদাসের ভিটার প্রবাদ প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদাস সেনের ‘চণ্ডীদাস চরিত’ গ্রন্থে ছাতনার দাবি প্রবলভাবে উত্থাপিত হয়েছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের কিছু অংশ খণ্ডিত বলে কবির আবির্ভাবের স্থান, কাল সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। আবিষ্কর্তা বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ কবির জন্ম ১৪০৩, ১৪১৭, বা ১৩৮৬ থেকে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনো একসময় বলে মত প্রকাশ করেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে কবির জন্মসাল ১৩৭০ থেকে ১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, ড. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে কাব্যটি চোদ্দো শতকের প্রথমার্ধে লিখিত, ড. রাধাগোবিন্দ বসাকের মতে, ১৪৫০ থেকে ১৫০০ খিষ্টাব্দের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কিছু অংশ খণ্ডিত বলে কবি বড়ু চণ্ডীদাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্পর্কে বড়ো বাধা। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি আদিরসাত্মক। অবশ্য সমকালে শ্লীলতার বাঁধন না মানাই স্বাভাবিক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভিতরে কবি বড় চণ্ডীদাস ভণিতা বহুবার ব্যবহার করেছেন। বড়ু চণ্ডীদাস শক্তিদেবী বাশুলীর সেবক ছিলেন। ভাগবত প্রভৃতি পুরাণের কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাহিনিকে সামান্য অনুসরণ করে জয়দেবের গীতগোবিন্দের বিশেষ প্রভাব শিরোধার্য করে এবং জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত রাখাকৃষ্ণবিষয়ক অমার্জিত গালগল্পের উপর ভিত্তি করে বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রচনা করেন। এই কাব্যের নাট্যগুণও চমৎকার। কৃষ্ণ চরিত্র ব্যতীত অন্যান্য চরিত্রাঙ্কনে অশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। চরিত্র চিত্রন কাইনির আঁটসাঁট গাঁথুনি, ভাষাভঙ্গিমা, বিচক্ষণতা, নাটকীয় চমৎকারিত্বের বিচারে বড়ু চণ্ডীদাস কবি হিসেবে সফল। বিরহ ও প্রেমাকাঙ্ক্ষা চণ্ডীদাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে চণ্ডীদাসের কবি প্রতিভার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে দেখা যাবে তিনি সহজভাবের আত্মতন্ময় কবি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-

“চণ্ডীদাস সহজ ভাষায়, সহজ ভাবের কবি” চণ্ডীদাসের কবিতার কাব্য সৌন্দর্য বিচারে প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কবির অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ। অনুভূতির রসাপুতি তাঁর কবিতার প্রাণ। বুদ্ধির দীপ্তির অপেক্ষা তিনি রাখেন না। যুক্তির ক্রম তাঁর কবিতায় মেলে না। এই আবেগপ্রবণতা আবার অতিমাত্রায় কোমল এবং স্পর্শকাতর একান্ত করুণ এবং বাংলার জলভরা শ্যামল মেঘের সাথে তুলনীয়।”

কালিদাস রায় বলেন

“বলপ্রয়োগ, ভয়প্রদর্শন, গ্রাম্যভাষা প্রয়োগ, বর্বরোচিত আচরণের সমাবেশ আলঙ্কারিক বিচারে এই কাব্যে রসাভাস ঘটেছে।”

গোপাল হালদার বলেছেন,

“শ্রীকৃষ্ণ যতই আপনার দেবত্বের বড়াই করুক সে ধূর্ত এক গ্রাম্য লম্পট ছাড়া আর কিছুই নয়।”

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কবির নামই বড় চণ্ডীদাস। কবির কাব্যের আদ্যন্ত বড়ু চণ্ডীদাস ভণিতা ব্যবহার করেছেন। মধ্যযুগে আরো চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বড় চণ্ডীদাসের কাব্যে ভাব, ভাষা উপস্থাপনা পদ্ধতি ও রুচিবোধের যে স্বাতন্ত্র্য দেখিয়েছেন তার পরিপ্রেক্ষিতেই তাকে বড়ু চণ্ডীদাস হিসেবেই চিনতে পারা যায়। সর্বোপরি বড়ু চণ্ডীদাস মধ্যযুগের হয়েও জীবনমুখী ও মানবিক কবি।