সাহিত্য সমাজ-জীবনের দর্পণস্বরূপ, আর সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনে। তাই রাষ্ট্র বিপর্যয়ে সমাজের তথা শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন বিপর্যয় ঘটে থাকে, তেমনি রাষ্ট্রীয় সুশাসন সমাজ তথা শিল্পসাহিত্যেরও সমৃদ্ধি সাধন করে থাকে। মধ্যযুগের বাঙলার ইতিহাসে রাজশক্তির ক্রমিক উত্থান-পতন যে এইভাবে বাঙলা সাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে, সাহিত্যের ইতিহাস-বিশ্লেষণে তার সহজ প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রীঃ পঞ্চদশ ও যােড়শ শতকে বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায় রাষ্ট্রযন্ত্র ঘন ঘন হস্তান্তরিত হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে বাঙলা সাহিত্যেরও বার বার গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীর পর থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙলার বুকে অরাজকতা ও দুঃশাসনের যে স্রোত বয়ে গিয়েছিল, তার ফলে এ কালে যে কোন সাহিত্য রচিত হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় না।
বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা:
খ্রীঃ চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি বাঙলায় ইলিয়াস শাহী শাসন প্রবর্তিত হ’বার সঙ্গে সঙ্গে দেশে যেমন শান্তি-শৃঙ্খলার সম্ভাবনা দেখা দিল, তেমনি দেখা গেল বাঙলা ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টিরও কয়েকটি ক্ষীণ স্রোতােধারা। ইলিয়াস সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা না করলেও যে এই বংশের কেউ কেউ সক্রিয়ভাবেই বাঙলা সাহিত্য-রচনায় সহায়তা করেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্বের মাঝখানে বেশ কয়েক বছর (১৪১৪ খ্রীঃ—১৪৩৩ খ্রী) হিন্দুরাজা গণেশ এবং তার বংশধরগণ গৌড়সিংহাসনের অধিকারী ছিলেন। ডঃ সুকুমার সেন অনুমান করেন যে এই গণেশ বা কংসের রাজত্বকালেই কৃত্তিবাস রাজানুগ্রহ লাভ করে ‘রামায়ণ’ অনুবাদ কাব্য রচনা করেন; গণেশের পুত্র যদু জালালুদ্দিন নাম নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তার রাজসভায় যে হিন্দু পণ্ডিতদের শ্রদ্ধার আসন দান করেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনিই সম্ভবতঃ মহাপণ্ডিত বৃহস্পতিকে আচার্য, কবিচক্ৰবৰ্ত্তী, পণ্ডিতসার্বভৌম, কবি-পণ্ডিতচুড়ামণি, মহাচার্য, রাজপণ্ডিত এবং রায়মুকুটমণি’ উপাধি দান করেছিলেন।
গণেশ-বংশের পরই আবার গৌড়ের শাসনভার ইলিয়াস শাহী বংশেই হস্তান্তরিত হয়। এই বংশে রুকনউদ্দিন বারবাক শাহ (১৪৫৫-৭৬ খ্রীঃ) ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচয়িতা মালাধর বসুকে গুণরাজ খান’ উপাধি দান করেছিলেন। হাবসী ক্রীতদাসদের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৪৮৭ খ্রীঃ ইলিয়াস শাহী বংশের সমাপ্তি ঘটে এবং এরপর অন্ততঃ তিনজন হাঙ্গী ৬ বৎসর কাল গৌড়ের সিংহাসন নিজেদের অধিকারে রেখেছিলেন।
মুঘল শাসন: ১৪৯৩ খ্রীঃ হােসেন শাহ নামক একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। সমগ্র মধ্যযুগের ইতিহাসে সুলতান হােসেন শাহই সর্বাধিক সাফল্য অর্জন করেন। তার রাজত্বকালেই মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঘটে এবং বাঙলা সাহিত্য আদিমধ্যযুগ থেকে অন্ত্যমধ্যযুগে উত্তীর্ণ হয়। হােসেন শাহের রাজদরবারে অনেক জ্ঞানীগুণী হিন্দু শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ‘দবীর খাস’ সনাতন গােস্বামী এবং তদভ্রাতা ‘সাকর মল্লিক’ রূপ গােস্বামী অন্যতম। কবি যশােরাজ খানও রাজদরবারের একজন কর্মচারী ছিলেন এবং তিনি একটি ব্রজবুলির পদে হােসেন শাহের নাম উল্লেখ করেছেন। ‘মনসামঙ্গল-রচয়িতা বরিশালের বিজয়গুপ্ত এবং ২৪ পরগণার বিপ্রদাস পিলাই-ও হােসেন শাহের পুত্র নসরৎ শাহের এবং কবি শ্রীধর তাঁর কাব্যে নসির শাহের পুত্র ফিরােজ শাহের নাম উল্লেখ করে গেছেন। ১৫৩৮ খ্রীঃ মামুদ শাহর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে গৌড়বঙ্গে হােসেন শাহী রাজত্বের অবসান ঘটে। এরপর পনেরাে বছর শের শাহ এবং তার পুত্র শুধু বাঙলার নয়, দিল্লীর সিংহাসনও নিজের অধিকারে রেখেছিলেন। দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে আকবর জয়লাভ করে দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করেন, আর এই সময় আফগান সর্দাররা বাঙলার শাসনভার করায়ত্ত করে। ১৫৭৬ খ্রীঃ পর্যন্ত তাঁদের হাতেই ছিল বাঙলার শাসনরঙ্কু। এরপরই শুরু হয় মুঘল শাসন। মুঘল সম্রাটগণ সরাসরি বাঙলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তারা রাজধানী থেকে সুবেদারের মাধ্যমে বাঙলায় নিজেদের শাসন কায়েম রেখেছিলেন।
খ্রীঃ পঞ্চদশ শতকে পাঠান শাসন অতিশয় চণ্ডরূপে বিদ্যমান থাকায় বাঙালী হিন্দুদের মনে যে ভীতি ও সন্ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছিল, ইলিয়াস শাহী শাসনে তার কিছু নিরসন ঘটে। কোন কোন সুলতান অসাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন ছিলেন, কেউ কেউ তাদের রাজসভায় হিন্দুদের উচ্চপদেও নিয়ােগ করেছিলেন। মনে হয়, কোন সুলতান হয়তাে বাঙলা ভাষা বুঝতেন কিংবা ব্যবহার করতেন। এই সময় সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শনের পুনরালােচনা শুরু হয়, বিভিন্ন মহাকাব্য ও পুরাণাদির বাঙলা অনুবাদও শুরু হয়েছিল। তখন পর্যন্ত চৈতন্যদেবের আবির্ভাব না হওয়া সত্ত্বেও বাঙলায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব বিস্তৃত হতে আরম্ভ করেছিল।
পাঠান শাসনের সমাপ্তি: যােড়শ শতকে পাঠান-শাসনের যেমন চূড়ান্ত বিকাশ সাধিত হয়েছিল, তেমনি তার বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বাঙলায় মুঘল শাসনেরও সূত্রপাত ঘটে। এখানকার রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একদিকে বাঙলার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্ম-বিষয়ে যেমন প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছিল, তেমনি আবার শতাব্দীর শেষদিকে দেশ প্রচণ্ড শাসন-শােষণেরও মুখে পড়েছিল। পাঠান শাসকদের নির্বুদ্ধিতা এবং আফগান সর্দারদের হঠকারিতায় দেশে তখন অরাজকতা দেখা দিলেও পাঠানগণ দেশের অর্থ অন্যত্র পাঠাতেন না বলে দেশবাসী মােটামুটি সুখেই বসবাস করতাে, কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থার ঘন ঘন পরিবর্তন বাঙালীর মনােভূমিতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
বাঙলার রেনেসাঁস: যােড়শ শতক বাঙালীর জীবনে প্রথম বিরাট উন্মাদনার সৃষ্টি করলো চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকে উপলক্ষ্য করে। মহাপ্রভুর আবির্ভাব সমকালীন বাঙালী জীবনকে যে নবজীবনরসে সিক্ত করেছিল, তার স্বীকৃতি দিয়েছেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার। তিনি চৈতন্যদেবের আবির্ভাব সম্পর্কে বলেছেন, ‘The Renais- sance which we owe to English rule in the nineteenth cen tury had a precursor-a faint glimmer of dawn no doubt two hundred and fifty years earlier.’
মুঘল শাসনে সুফল: এই শতকের শেষদিকে দেশের ভার মুঘলদের দ্বারা অধিকৃত হওয়াতেই কোন কোন দিক থেকে তার সুফল দেখা গেল। শাসনগত ঐক্যের ফলে দেশবাসীর মনে কিঞ্চিৎ শান্তি-শৃঙ্খলাবােধ ফিরে এলাে। বৃহত্তর ভারতের সঙ্গে বাঙলার প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপিত হালাে। অবশ্য এর আগেই মহাপ্রভু চৈতন্যদেব স্বয়ং নিজের ভ্রমণ মাধ্যমে এবং প্রচারক পাঠিয়ে মধ্য ভারত ও দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে যােগসূত্র স্থাপন করেছিলেন। পুরী, মথুরা, বৃন্দাবন, কাশী প্রভৃতি অঞ্চলে বাঙালী হিন্দুদের বসবাসের ফলে ঐ সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা বাঙালী-সংস্কৃতির সংস্পর্শে এলাে এবং কতকাংশে প্রভাবান্বিতও হলাে। আবার কিছুটা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আগ্রহবশতঃ এবং কিছুটা মুঘল শাসনব্যবস্থার সহায়তার জন্য ভিন্ন প্রদেশবাসীরাও প্রচুর সংখ্যায় বাঙলায় এসে বসবাস করতে লাগলেন। ভিন্ন সভ্যতা-সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসায় কূপমণ্ডুক বাঙালীর দৃষ্টিও অনেকটা প্রসারিত হলাে। “..বাঙলাদেশ মুঘল সম্রাটের অধীনে আসিবার ফলে যে বৃহত্তর সমাজ ও পরিবেশের সান্নিধ্য লাভ করিয়াছিল এবং তাহা যে বাঙালীর জীবনবােধ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে যথেষ্ট পরিবর্তন আনিয়াছিল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। মুঘল সাম্রাজ্যের রাজনীতিক, অর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি বাঙালীর নাগরিক জীবনের সম্মুখে এক নবদিগন্ত উদ্ঘাটন করিয়া দিল। সমৃদ্ধির এই বৈচিত্র্য যে বাঙালীর সাহিত্যজীবনেও পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য আনিয়াছিল, তাহাও অনুমান করা চলে। আবার এই মুঘল-প্রভাব যখন জাতির দৃষ্টিকে অনেকটা বহির্মুখী করিয়া তুলিয়াছিল, তখন বাঙলাদেশে চৈতন্য-প্রভাবই তাহাকে সংযত ও সংহত রাখিয়াছে। ফলত আমরা দেখিতেছি, একদিকে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব, অন্যদিকে মুঘল শাসন—এতদুভয়ের সামগ্রিক প্রভাবেই বাংলা সাহিত্যের মােড় ঘুরিল, আদিমধ্যযুগের অন্তে অন্ত্যমধ্যযুগ বা চৈতন্যোত্তর যুগের সৃষ্টি হইল।”
সুবর্ণ যুগ: এই সমস্ত কারণেই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে যােড়শ শতক ‘সুবর্ণযুগ’ নামে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। বৃন্দাবন দাস-কৃষ্ণদাস কবিরাজ-আদি চৈতন্যজীবনীকার, জ্ঞানদাস-গােবিন্দদাস আদি বৈষ্ণবপদকর্তা এবং কবিকঙ্কণ মুকুন্দ ও দ্বিজ মাধবের মত ‘চণ্ডীমণ্ডল’ রচয়িতা এই যুগে আবির্ভূত হয়ে মধ্যযুগের সাহিত্যের সেরা সম্ভার সাজিয়ে গেছেন।
Leave a comment