সূচনা: বাংলা নগর রাষ্ট্র বা ইংরেজি ‘City-state’ শব্দের গ্রিক প্রতিশব্দ হল পলিস যার অর্থ হল ‘স্বশাসিত রাষ্ট্র’। প্রাচীন কালে। গ্রিস, এশিয়া মাইনর, ইজিয়ান সাগরের দ্বীপসমূহ প্রভৃতি অঞ্চলে জনসংখ্যায় ও আয়তনে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগর রাষ্ট্র বা পলিসের অস্তিত্ব ছিল।
[1] রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা: গ্রিক পলিসগুলি আয়তনে ও লােকসংখ্যায় ক্ষুদ্র হত। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো বলেছেন যে, একটি আদর্শ পলিসের লােকসংখ্যা হওয়া উচিত ৫০০০। অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, ১০ জন নাগরিক নিয়ে গঠিত পলিস যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না, তেমনি ১ লক্ষ নাগরিক নিয়ে গঠিত পলিস সুদক্ষ শাসন পরিচালনা করতে পারবে না।
[2] রাজার অনুপস্থিতি: অধিকাংশ পলিসেই রাজতন্ত্র অনুপস্থিত ছিল। পলিসগুলি অভিজাততান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক এইরূপ বিভিন্ন ধরনের হত। অবশ্য স্পার্টায় বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র থাকলেও নির্দিষ্ট অভিজাতদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চলে গিয়েছিল।
[3] নাগরিক ও বিদেশিদের অবস্থান: প্রতিটি পলিসে নাগরিক ছাড়াও বহু বিদেশি বসবাস করত। তাদের নাগরিক অধিকার ছিল না, তবে সেখানে বসবাসের বিষয়ে তারা সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। এথেন্সের শাসক পেরিক্লিস বলেছেন যে, “আমরা বিদেশিদের কোনো শিক্ষা বা দৃশ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখি না।”
[4] প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণ: গ্রিক পলিসগুলিতে নাগরিকরা শাসন পরিচালনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে পারত। অ্যারিস্টটল তাঁর ‘পলিটিকস্’ গ্রন্থে বলেছেন যে, পলিসের আয়তন এমন ক্ষুদ্র হওয়া উচিত যাতে সেখানকার প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে প্রত্যক্ষ পরিচয় থাকে।
[5] স্বতন্ত্র: গ্রিসের প্রতিটি পলিস একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র ছিল। প্রতিটি পলিসের নিজস্ব সরকার, সেনাবাহিনী, ক্যালেন্ডার থাকত। পলিসগুলির প্রতিটির পৃথক মুদ্রাব্যবস্থা এবং মানচিত্র ছিল বলেও অনুমান করা হয়। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে পলিসগুলির পূজাপদ্ধতিও পৃথক হত।
[6] নগর ও গ্রামের সমন্বয়: গ্রিক নগর রাষ্ট্র বলতে শুধু রাষ্ট্র জুড়ে নগরের অবস্থান বা নগর কর্তৃক গ্রাম শাসনকে বােঝায় না। প্রাচীন গ্রিসে যেমন এথেন্সের মতাে উন্নত নগর-রাষ্ট্র ছিল তেমনি অনেক নগর-রাষ্ট্র ছিল, যা আদৌ নগর ছিল না।
[7] অর্থনৈতিক বৈষম্য: গ্রিসের বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। যেমন, একদিকে করিন্থ ও মিলেটাসের মানুষ শিল্প ও বাণিজ্যের দ্বারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করত, অন্যদিকে স্পার্টা, এলিস ও আরকাডিয়ার মানুষ কৃষি, যুদ্ধকর ও মন্দিরের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
গ্রিক পলিসপুলিতে বসবাসকারী নাগরিক, বিদেশি, ক্রীতদাস ও মহিলাদের নাগরিক অধিকারের যথেষ্ট তারতম্য ছিল।
[1] নাগরিক: পলিসের বেশিরভাগ নাগরিক ছিল স্বাধীন কৃষক, কারুশিল্পী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নাগরিকরা বহু প্রত্যক্ষ সুযােগসুবিধা ভােগ করত। গ্রিক পলিসগুলির রাষ্ট্রীয় চরিত্রভেদে বিভিন্ন পলিসের নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকারেও তারতম্য ছিল।
- [i] গণতান্ত্রিক পলিসপুলিতে মােটামুটিভাবে সকল নাগরিকের সমান রাজনৈতিক অধিকার ও রাজনৈতিক পদ লাভের সমান সুযােগ ছিল। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দুর্বল নাগরিকদের রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত।
- [ii] অভিজাত তান্ত্রিক পলিসগুলিতে নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকারে বৈষম্য ছিল। সেখানে একমাত্র ধনীরাই অশ্বারােহী এবং ভারী অস্ত্রসজ্জিত পদাতিক বাহিনীতে যােগ দিতে পারত।
[2] বিদেশি: এথেন্স-সহ বিভিন্ন পলিসে অসংখ্য বিদেশি বসবাস করত এবং তারা সেখানে সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল। তারা মেটিক নামে পরিচিত ছিল। তবে বিদেশিরা সেখানকার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এই বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনাে ব্যবস্থাও সেখানে ছিল না। স্পার্টায় বিদেশিদের প্রবেশাধিকারই ছিল না।
[3] ক্রীতদাস ও মহিলা: বিদেশি ছাড়াও বিভিন্ন গ্রিক পলিসে অসংখ্য ক্রীতদাস ও মহিলা বসবাস করত যারা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। ক্রীতদাসরা এথেন্সে থিটিস এবং স্পার্টায় হেলট নামে পরিচিত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাদেরও নাগরিক অধিকার ছিল না। ধনীরা ক্রীতদাসদের নিজেদের বিভিন্ন কাজে নিয়ােগ করতে, ভাড়া খাটাতে, বিক্রি করতে, এমনকি হত্যাও করতে পারত।
Leave a comment