ট্রাজেডি অর্থ কি :- 

ট্র্যাজেডি’ বলতে আমরা বুঝি বিয়োগান্তক নাটক । গ্রীক শব্দ ‘Tragoidia’ থেকে Tragedy শব্দটির উৎপত্তি। Trag(os) মানে Goat এবং ‘Oide’ মানে song । | অর্থাৎ ছাগগীতি বা Goat- song হল ট্র্যাজেডি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ । গ্রীক Tragodia থেকে লাতিন Tragoedia, তার থেকে মধ্যযুগীয় লাতিনে Tragedia এবং তার থেকে মধ্যযুগীয় ইংরেজিতে Tragedie । এই Tragedie -ই আধুনিককালে Tragedy হয়েছে।

ট্রাজেডির উৎপত্তি :-

ট্রাজেডির উৎপত্তি গ্রীসে। গ্রীসের দেবতা ডায়োনিসাস (Dionysus) এর পুজো উপলক্ষে ছাগ বা ভেড়া বলিদান উৎসব হত। বসন্তকালীন এই উৎসবে গায়কেরা ভেড়ার চামড়ায় সারা শরীর ঢেকে আনুষ্ঠান করত। গানের সঙ্গে নাট্যকাহিনী যুক্তছিল। এইসব নাটককে ট্র্যাজেডি বলা হত।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নাট্যভিনয়ের প্রতিযোগিতা হত এবং সেই প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ্য নাট্যকারকে ‘ছাগ’ পুরস্কার দেওয়া হত।

অন্য একটি মতও আছে। ডায়োনিসাসের পুজোকে কেন্দ্র করে উৎসবকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমাংশে তার মৃত্যুজনিত শোকানুষ্ঠান এবং দ্বিতীয়ভাগে পুনর্জীবন প্রাপ্তিজনিত আনন্দানুষ্ঠান। শোকানুষ্ঠান থেকে ট্র্যাজেডি এবং আনান্দানুষ্ঠান থেকে কমেডি (Comedy)-র উৎপত্তি।

অ্যারিস্টটল আবার মনে করেছেন Dithramb গান থেকে ট্র্যাজেডির উৎপত্তি

ট্রাজেডি কাকে বলে :-

বাংলায় সাধারণভাবে ট্র্যাজেডি নাটককে আমরা বলে থাকি বিয়োগান্তক নাটক, কারণ প্রায়ই এই জাতীয় নাটকের শেষে একটি বিয়োগ বা মৃত্যুর ঘটনা থাকে। কিন্তু ট্র্যাজেডির পক্ষে মৃত্যু অপরিহার্য নয়, এবং মৃত্যু থাকলেই তা ট্র্যাজেডি হয় না। বাংলায় এই জাতীয় নাটককে বরং বিষাদান্ত নাটক বলা যেতে পারে। অ্যারিস্টটলের সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলেই আমরা বুঝতে পারব সমস্ত দিক বিচার করে কীভাবে তিনি এর সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন।

আরও পড়ুন :- ট্রাজেডি ও মহাকাব্যের মধ্যে পার্থক্য কি?

‘পেয়েটিকস’ গ্রন্থে গ্রিক অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডি কাকে বলে তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।

ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা নির্দেশ করে বলেছেন –

“Tragedy, then, is an imitation of an action that is serious, complete, and of a certain magnitude; in the language embellished with each kind of artistic ornament, the several kinds being found in separate parts of the play; in the form of action, not of narrative; through pity and fear affecting the proper purgation – catharsis of these and similar emotions.”

ট্রাজেডির বৈশিষ্ট্য :-

আমরা উপরে যে ট্রাজেডির সংজ্ঞা আলোচনা করলাম তা থেকে ট্রাজেডির কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়-

১ – ট্র্যাজেডির বিষয় হবে গুরুগম্ভীর বা serious ঘটনার অনুকরণ।

২ – ট্র্যাজেডির বেশ কিছুটা আয়তন থাকতে হবে (magnitude) এবং তাকে হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ itself)

৩ – ট্র্যাজেডির প্লট হবে বৃত্তাকার ও সুগঠিত।

৪- কাহিনী হবে আদি-মধ্য-অন্ত্য যুক্ত।

৫ – ট্র্যাজেড়িতে ত্রি-ঐক্য থাকবে অর্থাৎ স্থান কাল পাত্রের ঐক্য থাকবে।

৬ – ঘটনাগুলির বর্ণনা থাকলেই হবে না,সেগুলি দেখাতে হবে নাটকীয় রীতিতে, অর্থাৎ ঘটনা যেমনভাবে ঘটছে সেইভাবেই দেখাতে হবে।

৭ – নাটকে বিভিন্ন ঘটনা থাকবে এবং কিন্তু ঘটনাবলির পরিণাম হবে একমুখী

৮ – নায়কের উপরে নেমে আসা বিষাদময় ঘটনা দর্শনমনে করুনা ও ভীতির (Pity ও fear) সৃষ্টি করবে। এর ফলে দর্শকদের Catharsis বা ভাবমোক্ষণ ঘটবে।

৯ – ট্র্যাজেডির ভাষা হবে সমস্ত রকম কাব্যিক অলংকার যুক্ত এবং সেটা নাটকের একটা অংশে রাখলেই হবে না, নাটকের প্রত্যেক অংশেই সেই অলংকার এর ভাষা ব্যবহার করতে হবে।

১০ – ট্র্যাজেডির ভাষা, সংলাপ, ও সংগীত হবে ভাবগম্ভীর।

১১ – ট্র্যাজেডির রস হবে ভীতিজনক করুণ।

১২ – ট্র্যাজেডি জীবনকে অনুকরণ করবে।

ট্র্যাজেডির প্রকারভেদ :-

ট্র্যাজেডিকে কয়েকটি প্রকারভেদে ভাগ করা যায়। গ্রীসে অ্যারিস্টটলের অনেক আগে থেকেই ট্র্যাজেডি নাটক লেখা হয়েছে। পরবর্তীকালে শেক্সপীয়রের ট্র্যাজেডির একটা ধারা তৈরি হয়।

আরও পড়ুন :- ছড়া কাকে বলে ও কত প্রকার?

অ্যারিস্টটলের মতে ট্র্যাজেডি মোট চার প্রকারের যথা-

১ – Complex বা জটিল,

২ – Pathetic বা বিষাদমূলক,

৩ – Ethical বা নীতিমূলক এবং

৮ – Simple বা সরল।

তিনি ট্র্যাজেডির আলোচনায় ‘Spectacular’ শব্দটা গ্রিক ভাষায় অনেকবার ব্যবহার করেছেন, কিন্তু লক্ষণীয় হল spectacular বা দর্শনীয় কোনো ট্র্যাজেডির শ্রেণী তিনি নির্দেশ করেননি।

এছাড়া ও আরও অন্তত তিনধরনের ট্র্যাজেডির প্রকারভেদের কথা নাট্যবিদরা বলেছেন –

১- রিভেঞ্জ ট্র্যাজেডি (Revenge Tragedy),

২ – ডোমেস্টিক ট্র্যাজেডি (Domestic Tragedy),

৩ – রেস্টোরেশন ট্র্যাজেডি (Restoration Tragedy)।

রিভেঞ্জ ট্র্যাজেডি :-

রিভেঞ্জ ট্র্যাজেডি শ্রেণীর নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কীড়- এর ‘The Spanish Tragedy’. ওয়েবস্টারের ‘The Duchess of Malfi’, শেক্সপীয়রের ‘হ্যামলেট’ ইত্যাদি। বাংলায় রবীন্দ্রনাথের ‘মালিনী’ কে এই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

ডোমেস্টিক ট্র্যাজেডি :-

ডোমেস্টিক ট্র্যাজেডি এই জাতীয় নাটকের উদাহরণ- হেইউডের ‘A woman killed with kindness’, লিলোর “The London Merchant”, আর্থার মিলারের ‘Death of a Salesman” শেক্সপীয়রের ‘ওথেলো’ । বাংলায় গিরিশচন্দ্রের ‘প্রফুল্ল’ বা বলিদান’ রবীন্দ্রনাথে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকের কথা বলা যেতে পারে।

রেস্টোরেশন ট্র্যাজেডি :-

রেস্টোরেশন ট্র্যাজেডি, নিও-ক্ল্যাসিক্যাল (Neoclassical) ট্র্যাজেডি বা হিরোয়িক ট্র্যাজেডি (Heroic Tragedy) নামেও পরিচিত। এই ধরনের ট্র্যাজেডি নাটকের সবথেকে বড় উদাহরণ ড্রাইডেনের “The Conquest of Granada”। বাংলায় মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’, রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রানী’।

ট্রাজেডির উপাদান কি কি :-

অ্যারিস্টটল তাঁর পোয়েটিক্স্ গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ট্র্যাজেডির উপাদান কি কি তা নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা করেছেন এবং তাদের পারস্পরিক গুরুত্বের কথাও বলেছেন।

অ্যারিস্টটলের মতে ট্র্যাজেডির উপাদান (৬) ছয়টি। এগুলো হলো-

১ – কাহিনী বা বৃত্ত (Fable or Plot),

২ – চরিত্র (Character)

৩ – বাচন (Diction),

৪ – মনন (Thought),

৫ – দৃশ্যসজ্জা (Spectacle), এবং

৬ – সংগীত (Music)।

এগুলি বলতে তিনি ঠিক কী বুঝিয়েছেন সে সব বিষয়ে আমরা তাঁকে অনুসরণ করেই একে একে উপাদানগুলিকে বিশ্লেষণ করছি।

১ – কাহিনী বা বৃত্ত :-

প্রথম উপাদানটিকে Fable or Plot বললেও বৃত্ত বলতে অ্যারিস্টটল যে ট্র্যাজেডির কাহিনী অংশকেই বোঝেন, অথবা কাহিনীর কার্যকারণ শৃঙ্খল সমন্বিত বিন্যাস, এটি বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না।

কারণ তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ‘The Fable in our present sense of the term is simply this, the combination of the incidents, or things done in the story:’

২ – চরিত্র :-

দ্বিতীয় উপাদান চরিত্র বলতে অ্যারিস্টটল বোঝেন নাটকের কাহিনীকে উপস্থাপন করবার জন্য বিভিন্ন প্রকারের নৈতিক গুণসম্পন্ন কিছু মানুষ। তাদের আচার-আচরণ এবং সংলাপের দ্বারা তাদের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি সম্বন্ধে আমরা অবহিত হই।

আরও পড়ুন :- সাহিত্য কাকে বলে?

তাঁর বক্তব্যের ইংরেজি অনুবাদ এইরকম— ‘Character is what makes us ascribe certain moral qualities to the agents.’

৩ – বাচন :-

বাচন বলতে অ্যারিস্টটল খুব সাধারণ অর্থেই বোঝেন নাটকটি কীরকম ভাষায় লেখা হল।

‘বাচন’ হল manner of dramatic imitation.’ আরও স্পষ্ট করে তিনি বলেছেন এক জায়গায় ‘by Diction I mean merely this, the composition of the verses’

৪ – চিন্তন বা মনন :-

কাহিনীর গড়ে তোলার জন্য নায়কের চিন্তা বা অনুভবকে চিন্তন বা Thought বলতে পারি। একে চরিত্রের বিচারশক্তিও বলা চলে। চিত্তন ও নাট্যমুহূর্তের মধ্যে সংযোগ আছে। যেমন – সংকটজনক নাট্য মুহূর্ত সৰ্বাদা সংকটজনক চিন্তনেই প্রকাশ। চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব নাট্যদ্বন্দ্বেকে বাড়িয়ে তোলে।

৫ – দৃশ্যসজ্জা :-

‘The Spectacle is theatrical effect presented on the stage’, নাটককে জীবন্ত করার জন্য দৃশ্যসজ্জার সৃষ্টি প্রয়োগ প্রয়োজন। দৃশ্যপট দর্শকের আবেগকে জাগিয়ে তোলার জন্য ব্যবহৃত হয়।

৬ – সংগীত :-

গানের মধ্য দিয়ে চরিত্রের অন্তর্নিহিত সত্য ব্যক্ত হয়। নাটকের অন্তঃসারও গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা যেতে পারে।

অ্যারিস্টটল কোরাস (Chorus) এর কথা বলেছেন। সমবেতসংগীত যেন সাধারণ মানুষের কন্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। Chorus should be fully integrated into the play like an actor.” একইসঙ্গে সংগীত অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে নাটককে দেখতে সাহায্য করে। অনেক সময় নাটকে যা দেখানো সম্ভব হয় না বা জানানো যায় না সংগীত তা ব্যাখ্যা করে দেয়।