১৯৫১ সাল থেকে ভারতবর্ষে আর্থিক পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। তার পরবর্তী বারো তেরো বছরে কৃষির ব্যাপারে তেমন কিছু উন্নতি হয়নি। কৃষিক্ষেত্রে তখনও পর্যন্ত তিরিশ ভাগ উন্নতি লক্ষ করা গেছে সত্য কিন্তু কৃষিজীবী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে তার থেকেও বেশি হারে। ফলে কৃষকের গড় উৎপাদনের মাত্রা গেছে কমে। তাছাড়া উৎপাদন যতটা বেড়েছে তা সম্ভব হয়েছে অনাবাদি জমিকে আবাদি জমিতে পরিণত করে। উন্নত প্রথায় চাষ করে ফসলের গড় উৎপাদন বাড়িয়ে নয়, স্বাধীনতার সময় আমাদের খাদ্য শস্যের ঘাটতি ছিল পাঁচ ভাগ, কিন্তু ১৯৬৪ সালে (প্রবন্ধ লেখার সময়ে) প্রচুর অর্থব্যয় করেও ঘাটতির পরিমাণ সেই একই থেকে গেছে এর মূল কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এই ঘাটতি মেটাবার জন্য প্রতি বছর বিদেশ থেকে তিরিশ চল্লিশ টনের মতো খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে প্রচুর খাদ্যশস্য ও কৃষিজাত দ্রব্য অপর দেশ থেকে সাহায্য হিসেবেও এসেছিল। কিন্তু এই বিদেশি সাহায্যও কোনোদিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তখন আমরা বিপদে পড়বো। এখনও পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে কৃষি উৎপাদনের হার বজায় রেখে চলেছে। কিন্তু আত্মতুষ্টির অবকাশ যেখানে নেই, উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্যই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ কৃষিপণ্য উদ্বৃত্ত না হলে শিল্পের উন্নতি ও বাধাপ্রাপ্ত হবে, বৈদেশিক মুদ্রার ও অনটন হবে। আমরা কখনো জোর গলায় বলতে পারবো না যে আমাদের বাধা কেটে গেছে এবার আমরা দ্রুত গতিতে এগোবে। দেশের সত্তরভাগ মানুষ কৃষির মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে, সুতরাং কৃষির উন্নতি না হলে আমাদের আর্থিক উন্নতিও ঘটবে না, আবার কৃষির সঙ্গে শিল্পের উন্নতি ও অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। কৃষির উন্নতি হলেই শিল্পের ক্ষেত্রেও উদ্দাম গতি আসবে। কারণ চাষিদের হাতে পয়সা এলে শিল্পজাত পণ্য কেনার সঙ্গতি তাদের হবে। আবার অন্যদিকে কল কারখানায় যারা কাজ করে তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাবে কৃষকেরা। সেই সঙ্গে কৃষিপণ্য ব্যবহৃত হবে কাঁচামাল হিসেবে।

এই কারণেই লেখক কৃষি সম্পদকে সোনার কাঠি রুপোর কাঠি বলে অভিহিত করেছেন। এই সোনার কাঠি রূপোর কাঠি আমাদের একদিক থেকে উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে যদিও এই উৎকণ্ঠা একদিক দিয়ে ভালো। তবে প্রায় তিনহাজার কোটি টাকা কৃষির জন্য ব্যয় করা হয়েছে যা এসেছে অকৃষিদের কাছে থেকে। কৃষকদের ওপর কর ভার চাপিয়ে তা আদায় করা হয়নি তাই এটা প্রশংসার যোগ্য। আর ভূমি সংস্কার যেটুকু হয়েছে তাতে রাজামহারাজাদের কিছুটা ক্ষতি হলে ও বড়ো বড়ো চাষিদের কোনো ক্ষতি হয়নি। এছাড়া‌ ব্যাপক আকারে সেচের নল সরবরাহ, উন্নতি কৃষি প্রণালীর পরিবর্তন, শস্যের ন্যায্যমূল্য বজায় রাখা এবং উন্নতবীজ ও সারের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি নানা বিষয়ে সরকার যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাসত্ত্বেও কৃষিতে যথেষ্ট সাফল্য আসছে না।

লেখক মনে করেছেন আমাদের কৃষি উন্নয়নের পদ্ধতির মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা বড়ো ফাঁক থেকে যাচ্ছে অথবা গ্রাম উন্নয়নের গঠন প্রণালীতে কোনো অবহেলা প্রকাশ পাচ্ছে। হয়তো যে সামান্য সাহায্য সরকার থেকে দেওয়া হচ্ছে অর্ধপথে তা উধাও হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজে অসাম্যও প্রচুর, উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের ভেদাভেদ আছে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য আছে। সমাজতন্ত্রের কথা মুখে বলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যারা বিত্তবান তারাই বেশি সুযোগসুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। যারা দরিদ্র তারা দরিদ্রই থেকে যাচ্ছে। কাগজে কলমে যাই বলা হোক না কেন গ্রামে বিত্তবান চাষিরাই সেচের জল, উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার ইত্যাদি সুযোগসুবিধা ভোগ করছে, সুতরাং সরকারি প্রচেষ্টার শুভফল সকলের কাছে গিয়ে পৌঁছেছে না। এমনও দেখা গেছে কৃষি প্রসারের জন্য যে অর্থ দেওয়া হয়েছে তা কিছু মহাজনের হাতে গিয়ে পৌঁছেছে, তারা সেই অর্থ কৃষির জন্য ব্যয় না করে সুদে খাটিয়েছে অথবা মজুতদারিতে নিয়োগ করেছে। সাধারণভাবে বলা যায় কৃষি পরিকল্পনায় নানা শুভ উদ্যোগ নেওয়া হলেও কৃষিক্ষেত্রে অসাম্য বৃদ্ধিই পেয়েছে। আমাদের দেশের পঁচিশ শতাংশের কৃষকের জমি নেই তাই তারা পরের জমিতে আবাদে খেটে দিয়ে আসে। কিন্তু তারা উচিত মূল্য পায় না।

অধিকাংশ চাষি যদি অভাব ও অসন্তোষের মধ্য দিয়ে দিন যাপন করে তাহলে উৎপাদনে উদ্দাম গতি আনা কখনই সম্ভব নয়। কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য পেতে হলে নির্দিষ্ট চিত্তে কৃষি সমস্যার উৎস অনুসন্ধান করতে হবে। নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে বিচার করতে হবে কোথায় ত্রুটি বা গলদ। সন্ধান করতে হবে কোথায় কোন ধরনের উন্নতি সম্ভব। তবে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবন্ধটি কতখানি প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ প্রসঙ্গটি চল্লিশ বছর আগে লেখা। এই সময়ের মধ্যে বহু পরিবর্তন ঘটেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে তেরো চোদ্দোটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়ার বিস্ময়কর উন্নতি দেখে লেখকের সে বিস্ময় মিশ্রিত শ্রদ্ধা জেগেছিল বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে দেখা গেল সেই উন্নতির ভগ্নদশা। যতই রাজনৈতিক কারণ থাকে মূলত অর্থনৈতিক দুর্দশাই সে পতনের মূল কারণ যে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর একটি ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে সেটি হল ভারতের কৃষিপণ্যের উৎপাদন। ১৯১৪ সালের কাছাকাছি বছরগুলোতে ভারতকে বছরে তিরিশ চল্লিশ লক্ষ টন খাদ্য আমদানি করতে হত। কিন্তু বর্তমানে ভারত শুধু খাদ্যে স্বয়ম্বর হয়নি প্রচুর উদ্বৃত্ত শস্য ফলাতে ভাণ্ডারও গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ঔষধ এবং চাষের যন্ত্রপাতি নির্মাণ করে। সেই সঙ্গে অনাবদি জমিকে আবাদি জমিতে পরিণত করে এবং গড় উৎপাদন বাড়িয়ে ভারত এই সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু একটি ক্ষেত্রে সমস্যা আছে প্রচুর উৎপাদন এবং খাদ্যে স্বয়ম্বরতা অর্জন সম্ভব হলেও খেতে মজুর ভাগচাষিদের আর্থিক উন্নতি মোটেই ঘটেনি। চাষের যা কিছু সুফল পেয়েছে তারা হল বিত্তবান চাষি। তবে সরকার কর্তৃক ফসলের ন্যায্যমূল্য দেওয়া হচ্ছে, ফসল বিক্রি করে তারা নিজ হাতে সরাসরি টাকা পাচ্ছে। তাহলেও কৃষকদের অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষদের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি সম্ভব নয় এটা লেখক সর্বাজ্ঞে বলেছেন।