গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা:
চোল শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল ‘গ্রাম’। গ্রামীণ শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে গুপ্ত শাসনব্যবস্থার সাথে চোল শাসনধারার বিশেষ প্রভেদ নেই। তবে গঠনগত মিল থাকলেও চোল ও গুপ্ত গ্রামীণ শাসনের প্রকৃতিগত প্রভেদ ছিল লক্ষণীয়। চোল শাসনব্যবস্থায় গ্রামগুলির শাসনতান্ত্রিক স্বাধীনতা ছিল অভূতপূর্ব। চোল রাজকর্মচারীরা গ্রামীণ শাসনের কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ করতেন না। তাঁরা মূলত পরিদর্শক বা পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করতেন। অষ্টম ও নবম শতকে পাণ্ড্য ও পল্লবদের লেখাতেও স্বতন্ত্র গ্রাম শাসনের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে চোলরাজ্যের মতো পাণ্ড্য বা পল্লবদের গ্রামীণ শাসন এত স্বাধীন, সুবিন্যস্ত ও সমৃদ্ধ ছিল না। সম্ভবত এই কারণে রাজবংশের পরিবর্তন সত্ত্বেও গ্রামীণ বিকাশের ধারা অব্যাহত থাকত। রোমিলা থাপারের মতে, “উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় তামিলনাদে যে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক অবিচ্ছিন্নতা লক্ষ্য করা যায়, তার মুলেও হয়তো রয়েছে চোলদের গ্রামশাসন পদ্ধতি।” নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর ভাষায় : “The most striking feature of the chola period was the unusual vigour and efficiency that characterised the functioning of the autonomous rural institutions.” একটি অতি-উন্নত সমিতি-ব্যবস্থার (ভরিয়মস্) মাধ্যমে স্থানীয় শাসন পরিচালনা করা হত। উত্তরমেরুর ‘সভা’ অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজা প্রথম পরস্তকের আমলে দু’বার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাকে পরিশীলিত করে তোলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
চোল আমলে গ্রামীণ শাসনব্যবস্থার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল গ্রামবাসীকে স্বনির্ভর করে তোলা। এই উদ্দেশ্যে একটি গ্রাম-পরিষদ গঠন করে তার হাতে গ্রামের সম্পূর্ণ শাসনদায়িত্ব অর্পণ করা হত। মূল সমিতি ছাড়াও অনেকগুলি সামাজিক, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠী এক-একটি নির্দিষ্ট বিভাগ বা কাজের তত্ত্বাবধান করত। গোষ্ঠীগুলি কোনো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বা সমস্যার সম্মুখীন হলে পরিষদের কাছে আবেদন করতে পারত। গোষ্ঠীর সদস্যরাই মূল পরিষদের সদস্য হতেন। ফলে পরিষদের সাথে গোষ্ঠী সংগঠনের সংঘাতের সম্ভাবনা ছিল না। বড়ো বড়ো গ্রামগুলিতে সুশাসনের প্রয়োজনে একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকত। গ্রামগুলি বিভিন্ন পাড়ায় বিভক্ত ছিল। এক-একটি পাড়ায় ভিন্ন ভিন্ন পেশাজীবী মানুষ নিজ নিজ গোষ্ঠী গঠন করত; যেমন–সুত্রধর, কর্মকার, স্বর্ণকার প্রভৃতি। বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল গ্রামের সমাজজীবনের মূল ভিত্তি।
সাধারণ পরিষদে স্থানীয় অধিবাসীরাই সদস্য হতে পারত। পরিষদ ছিল তিন ধরনের—উর্, সভা ও নগরম্। (ক) যেসব গ্রামবাসী কর প্রদান করে, তাদের গঠিত সমিতির নাম ছিল ‘ঊর্’। (খ) ব্রাহ্মণদের দান করা গ্রাম (চতুবৈদিমঙ্গলম) অথবা গ্রামের ব্রাহ্মণদের নিয়ে গঠিত হত ‘সভা’। (গ) ব্যবসা কেন্দ্রগুলির তত্ত্বাবধানের জন্য বণিকদের নিয়ে গঠিত হত ‘নগরম’। কোনো কোনো সময় স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে ব্রাহ্মণদের জন্য নতুন বসতি গড়ে তোলা হত। সেক্ষেত্রে একই গ্রামে ঊর্ ও সভা দুই-ই থাকত। আবার বড়ো বড়ো গ্রামে কাজের সুবিধার জন্য প্রয়োজন হলে একই সাথে দুটি ঊর্ গঠন করা হত।
স্থানীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী এই সকল সমিতির কাজকর্ম ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হত। গ্রামের সকল প্রাপ্ত বয়স্ক করদাতা ঊরের সদস্য হতে পারতেন, তবে ঊর্-এর কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রবীণদেরই প্রাধান্য ছিল। দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনার জন্য প্রবীণরা কার্যকরী সমিতি গঠন করতেন। কার্যনিবাহী সমিতিগুলির পূর্ব ইতিহাস খুব স্পষ্ট নয়। সম্ভবত, পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে এগুলির রূপদান করা হয়েছে। চোল আমলের প্রথমদিকের লেখগুলিতে নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য অস্থায়ী সমিতি গঠনের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন পরিষদে সমিতির সংখ্যা ও তাদের সদস্য সংখ্যার উল্লেখও এগুলিতে পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে চিঙ্গেলপুট জেলার ‘উত্তরামেরুর’ গ্রামে প্রথম পরাস্তকের রাজত্বকালের দুটি লেখ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ৯১৯ ও ৯২১ খ্রিস্টাব্দের এই দুটি লেখতে বিভিন্ন কার্যনির্বাহী সমিতি গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে। প্রথম লেখটির সংশোধিত ও পরিমার্জিত রূপ হল পরবর্তী লেখটি।
উত্তরামেরুর এই গ্রামটি ব্রাহ্মণ-অধ্যুষিত। দশম শতকের শেষ লেখটি (৯২১ খ্রিঃ) অনুসারে উত্তরা মেরুর গ্রামের ত্রিশটি পাড়া বা কুড়ুম্ব থেকে কার্যনির্বাহী সমিতিগুলিতে নির্বাচনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের প্রথমে বেছে নেওয়া হত। এই ত্রিশটি পাড়ার অধিবাসীরা মিলিত হয়ে লটারি দ্বারা নির্বাচনের জন্য একজন করে প্রার্থী স্থির করতেন। নির্বাচনে নামার জন্য যোগ্যতা বিচার করা হত কঠোরভাবে। লেখটিতে প্রার্থীদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিবরণ দেওয়া আছে। নির্বাচন প্রার্থীকে করদায়ী জমির ২৫ শতাংশের বেশি মালিক হতে হবে। তাঁর নিজস্ব বাসগৃহ থাকবে এবং বয়স হবে ৩৫ বছরের বেশি কিন্তু ৭০-এর কম। শাস্ত্রজ্ঞানকে বিশেষ গুণ বলে উল্লেখ করা হয়। প্রার্থীকে মন্ত্র ও ব্রাহ্মণগুলি সম্পর্কে জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। কোনো ব্যক্তির যদি উল্লিখিত পরিমাণ জমি না থাকে, কিন্তু অন্তত একটি বেদ ও চারটি ভাষ্যের মধ্যে অন্তত একটি ভাষ্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকে, তাহলে তিনিও নির্বাচন প্রার্থী হতে পারবেন। যাঁদের এইসব গুণাবলি আছে তাঁদের মধ্যে যাঁরা বাণিজ্যে দক্ষ এবং যাঁদের নৈতিক চরিত্র উন্নত, তাঁদের নির্বাচনের জন্য বিবেচনা করা যাবে। নৈতিক চরিত্রের ওপর বিশেষ গুরুত্ব চোলরাজ্যের উন্নত চরিত্রভাতির সাক্ষ্য দেয়। বলা হয়েছে, “যাঁরা সৎপথে থেকে জীবিকা নির্বাহ করেন, যাঁদের মন পবিত্র, যাঁরা গত তিন বছর কোনো পরিষদের সদস্য ছিলেন না, তাঁরা যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।” অনুরূপভাবে, অযোগ্যতার দিকটিও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, যাঁরা বিগত বছরে কোনো পরিষদের সদস্য ছিলেন কিন্তু আয়ব্যয়ের হিসেব দাখিল করেননি তাঁরা এবং তাঁদের নিকট আত্মীয়রা প্রার্থী হতে পারবেন না। যিনি অনাচারে লিপ্ত হয়েছেন তিনি প্রার্থী হতে পারবেন না। ব্রাহ্মণ হত্যা, মদ্যপান, চুরি, ব্যভিচারিতা ও অপরাধীর সাথে সংযোগ রক্ষা করেন তিনি বা তাঁর নিকট আত্মীয়রাও প্রার্থী পদে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। যিনি হঠকারী, যিনি অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছেন, যিনি নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করেন, তিনি বা তাঁর নিকট আত্মীয়দের অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হত। নিকট আত্মীয় হিসেবে পিতা বা পুত্র, কাকা, মামা, মাসতুতো ভাই, পিসতুতো ভাই, জামাই, ভাই, শ্বশুর, শ্যালক, ভগ্নীপতি, ভাগ্না প্রমুখের কথা বলা হয়েছে।
এই যোগ্যতার ভিত্তিতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের নাম কাগজে লিখে একটি পাত্রে রাখা হত। গ্রামের সকল বয়স্ক ব্যক্তি ও তরুণদের উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে ত্রিশটি পাড়া থেকে একজন করে ত্রিশজন নির্বাচিত হতেন। এই ত্রিশজনের মধ্যে যাঁরা ইতিপূর্বে ‘উদ্যান-সমিতি’ ও ‘পুষ্করিণী সমিতি’তে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং বয়সে প্রবীণ ও জ্ঞানী এমন বারো জনকে নিয়ে ‘বাৎসরিক সমিতি’ গঠন করা হত। অবশিষ্ট বারো জনকে নিয়ে ‘উদ্যান সমিতি’ এবং ছয় জনকে নিয়ে ‘পুষ্করিণী সমিতি’ গঠন করা যেত। এ ছাড়া আগের পদ্ধতিতে ত্রিশটি পাড়ায় লটারি দ্বারা সদস্য নির্বাচিত করে ‘স্বর্ণ সমিতি’, ‘পঞ্চমুখী সমিতি’ গঠন করা হত। ঢোল বাজিয়ে সভা বা মহাসভার অধিবেশন ডাকা হত। বিভিন্ন গ্রাম সভার মধ্যে মতবিনিময় ও সহযোগিতা ছিল সেকালের স্মরণীয় বৈশিষ্ট্য। উল্লিখিত তিনটি সমিতি ৩৬০ দিনের জন্য কার্যভার পেতেন এবং তারপরে অবসর নিতেন। কোনো সদস্য কর্মকালের মাঝে অপরাধী সাব্যস্ত হলে তাকে তৎক্ষণাৎ অপসারণ করা হত। এদের অবসর গ্রহণের পর নতুন সমিতি গঠনের জন্য বারোটি রাস্তার ‘ন্যায়রক্ষা সমিতি’ ‘মধ্যস্থ’ নামক সরকারি প্রতিনিধির মাধ্যমে মহাসভার অধিবেশন ডাকতেন এবং আবার লটারির মাধ্যমে নতুন সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতেন। গ্রামের আয়ব্যয়ের হিসেব লেখার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হত সবচেয়ে সৎ-ব্যক্তির হাতে। তিনি প্রধান সমিতির কাছে বাৎসরিক হিসেব ত্রুটিহীনভাবে তুলে দিতে দায়বদ্ধ থাকতেন। হিসেব না-মেলানো পর্যন্ত হিসেবরক্ষক নিষ্কৃতি পেতেন না।
সভা বা মহাসভার কাজের পরিধি ছিল বেশ দীর্ঘ। গ্রাম-সম্প্রদায়ের জমির ওপর সভার মালিকানাস্বত্ব ছিল। ব্যক্তিমালিকানা ধনী সম্পত্তির ওপরেও সভার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ছিল। উৎপন্ন ফসলের পরিমাপ, জমির জরিপ এবং রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণের কাজে সভা রাজকর্মচারীদের সহায়তা করত। পতিত জমি উদ্ধার করে কৃষি-এলাকা বাড়ানোর দায়িত্ব সভা পালন করত। রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করত সভা। রাজস্ব অনাদায়ী হলে উল্লিখিত জমি নীলামে হস্তান্তরের অধিকার সভার হাতেই ছিল। জমির অধিকার-সংক্রান্ত বিরোধ বা জলসেচ-বিষয়ক সমস্যা সমাধানের দায়িত্বও সভার হাতে ন্যস্ত ছিল। কোনো বিশেষ উন্নয়নমূলক কাজের জন্য সভা আলাদা খাজনা আদায় করতে পারত, যেমন—পুষ্করিণী খনন, নতুন রাস্তা নির্মাণ, বাঁধ দেওয়া ইত্যাদি। মহাসভাগুলি এই সকল কাজের জন্য কর্মচারী নিয়োগ করত। তবে ছোটো ছোটো গ্রামের অধিবাসীরা বিনা পারিশ্রমিকেই কাজ করে দিত।
গ্রাম এবং রাজা বা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে স্বতন্ত্র সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল। চোলযুগে সামন্তরা এই কাজ করতেন। তবে সামন্ত ও রাজার সম্পর্ক বিষয়ে গ্রামসভার কোনো উৎসাহ ছিল না। সভা রাজস্ব আদায় করলে সামন্তদের মাধ্যমে তা রাজকোষে পৌঁছে যেত। এর বাইরে গ্রামের ওপর সামন্ত বা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। চোলযুগে গ্রামগুলির রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। এই কারণে দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েন গ্রামগুলির কর্মধারায় কোনো ছেদ ঘটাতে পারত না।
ঊর্ ও সভার মতো আর একটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ছিল ‘নগরম্’। সাধারণভাবে এটি ছিল স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমবায় সংঘ। অধিকাংশ শহরে এগুলির অস্তিত্ব ছিল। অনেক সময় ঊর্ ও নগরম্ পাশাপাশি থেকে কাজ করত। বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষা করাই ছিল নগরম্-এর প্রধান কাজ। অনেকে নগরকে ব্যবসায়ীদের সংঘ বা গিল্ড (Guild) হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই সংগঠন বাণিজ্যকর্ম তত্ত্বাবধান করত।
আঞ্চলিক শাসনতান্ত্রিক বিভাগ হিসেবে যে ‘নাড়ু’র উল্লেখ আছে, তারও নিজস্ব ‘সভা’ ছিল। একে বলা হত ‘নাত্তার’। নাত্তার কীভাবে গঠিত হত তা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত, নাড়ুর অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রামের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘নাত্তার’ গঠিত হত। বিচার ও রাজস্ব আদায়-সংক্রান্ত কাজে এই নাত্তার ‘সভা’কে সাহায্য করতে বলে অনুমিত হয়।
গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনমূলক সংগঠনগুলির কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সমকালীন লেখাগুলি প্রায় নীরব। তবে সামগ্রিকভাবে চোলরাজাদের উদারতা, শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি এবং গ্রামসভাগুলির স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার প্রেক্ষিতে কিছুটা অনুমান করা যায়। সম্ভবত, যে-কোনো বিষয় নিয়ে সাধারণভাবে আলোচনা করা হত। ব্রাহ্মণ, প্রবীণ বা প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা সামাজিক মর্যাদা এবং অন্যান্যরা পদমর্যাদার ভিত্তিতে আলোচনায় অংশ নিতেন। কোনো বিশেষ সামাজিক শ্রেণির স্বার্থ-সংক্রান্ত আলোচনার সময় ওই শ্রেণির প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনা হত। সম্ভবত ভোটদান প্রথা ছিল না। বিস্তারিত আলোচনার পর সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। প্রথম পরাস্তকের রাজত্বকালে প্রতিবেশী দুটি গ্রামের সভা যৌথ অধিবেশনের মাধ্যমে (৯৩৩ খ্রিঃ) দুটি গ্রামকে মিলিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়নি। এই ঘটনা গ্রামগুলির স্বাধীনতার ব্যাপকতা ও গভীরতা প্রমাণ করে।
চোলদের লেখ থেকে গ্রামশাসনের সাথে সম্পর্কিত অন্তত দুজন কর্মচারীর নামোল্লেখ পাওয়া যায়। এঁরা হলেন ‘মধ্যস্থ’ও ‘করণত্তার।’ সম্ভবত মধ্যস্থ ছিলেন কেন্দ্রের প্রতিনিধি ও পরিদর্শক। সভা বা মহাসভার অধিবেশনে এঁরা পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকতেন, তবে আলোচনায় অংশ নিতেন না কিংবা সভার আলোচনাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করতেন না। ‘করনত্তার’ ছিলেন হিসেবপরীক্ষক। সম্ভবত জমির সীমার ওপরেও তাঁরা নজর রাখতেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, চোল শাসনব্যবস্থা ছিল একদিকে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র এবং অন্য প্রান্তে স্বশাসিত ও স্বনির্ভর গ্রামসমূহের স্বাধীন স্থানীয় শাসনধারার সমন্বয়। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী মনে করেন যে, আদি-মধ্যযুগীয় রাজনীতির লক্ষ্য ছিল সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। নিম্নবর্ণের মানুষ ছিল অবহেলিত। তবে এই ব্যবস্থা নিজ থেকেই একটা দহনশীল গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকত। জনগণের রাজস্ব অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হত এবং সেবামূলক কাজের মাধ্যমে তার একাংশ আবার জনগণের কাছেই ফিরে যেত। তাঁর মতে, এক বিস্ময়কর সামাজিক ঐক্যের ওপর দক্ষিণ ভারতের শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এই ঐক্যের ভিত্তি সামাজিক সাম্য বা ব্যক্তির সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তবে উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদানের শুভ মানসিকতা সক্রিয় ছিল, যার শিকড় সমষ্টি-জীবনের গভীরে প্রোথিত ছিল। ড. শাস্ত্রী লিখেছেন, “It was a wounderful social harmony based not on equality of classes or individuals but on readiness to give and take, a mutual goodwill that had its roots deep down at the foundations of communal life.”
চোল শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের সাম্প্রতিক বিতর্কটি উল্লেখ্য। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী, টি. মহালিঙ্গম, ডি. এন. ঝা, আর চম্পকলক্ষ্মী প্রমুখ চোল শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীকরণ প্রবণতার ওপর জোর দিয়েছেন। বার্টন স্টাইন, জর্জ স্পেনসার প্রমুখের বক্তব্যের সাথে এখানেই তাঁদের সংঘাত। স্টোইন ও স্পেনসার-এর মতে, চোলশাসন কাঠামোয় ছিল দুটি প্রশাসনিক কেন্দ্রের সমাহার। একদিকে ছিল কেন্দ্রীভূত প্রশাসন, অন্যদিকে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় শাসন। তাঁদের মতে, চোলরাজ্য ছিল ‘খণ্ডিত রাষ্ট্র’ বা ‘Segmented state’। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা তিনটি অঞ্চলে (Zone) বিভক্ত—মূল এলাকা (Core area), মধ্যবর্তী অঞ্চল (Intermediate area) এবং প্রান্তিক এলাকা (Peripherial area)। মূল এলাকায় থাকতেন প্রবল প্রতাপশালী রাজা, কিন্তু প্রান্তিক এলাকায় ছিল স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা। স্টাইনের মতে, গ্রামাঞ্চলে মূল ক্ষমতার উৎস ছিল নাড়ু ও সভা বা ঊর্। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঝা, চম্পকলক্ষ্মী প্রমুখ ভিন্ন মত পোষণ করেন। চম্পকলক্ষ্মী চোল লেখমালার নতুন পাঠ অনুসরণ করে বলেছেন যে, চোলদের তথাকথিত স্বাধীন গ্রামসভাগুলি কার্যত কেন্দ্রীয় রাজ্যপুরুষদের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই বিতর্কের সমাধান পরবর্তী গবেষণার ওপর নির্ভর করছে।
Leave a comment