ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তি ভারতে বিভিন্ন স্থানীয় মােড়ল বা আধিপত্যকারী সম্প্রদায়ের যােগসূত্র গড়ে তুলে রাজস্ব আদায় করতে থাকে। এরূপ একটি উল্লেখযােগ্য স্থানীয় মােড়ল বা আধিপত্যকারী সম্প্রদায় ছিল গুজরাটের পতিদাররা। গুজরাটের গ্রামের যৌথ ভূমি ‘পতি’ নামে পরিচিত ছিল। এই ভূমির রাজস্ব আদায়কারীগণ ‘পতিদার’ নামে পরিচিত ছিল। সাধারণত গুজরাটের কুনবি সম্প্রদায় পতিদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। তাদের উপাধি হত ‘প্যাটেল’ অর্থাৎ গ্রামের প্রধান।

[1] কৃষিকাজ: টের পতিদাররা আগে কোলি নামে একটি যােদ্ধা সম্প্রদায়ের সমগােত্রীয় ছিল। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা ভারতে ভূমি বন্দোবস্তের প্রবর্তন করলে পতিদাররা কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যথেষ্ট উন্নতি ঘটায়। কৃষিকাজের মাধ্যমে ১৮৬০-এর দশকের পর থেকে সঠিক ফসলের উৎপাদন, উন্নত কৃষি-কৌশল ও শস্য রপ্তানি ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে পতিদার সম্প্রদায় যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটায়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের আদমশুমারিতে পতিদার সম্প্রদায় একটি পৃথক সত্তা হিসেবে চিহ্নিত হয়।

[2] রাজস্ব আদায়: দাক্ষিণাত্যের বােম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত রায়তওয়ারি ভূমিব্যবস্থায় প্রত্যেক কৃষকদের ওপর পৃথকভাবে রাজস্ব ধার্য করা হত। পতিদাররা রাজস্ব আদায় করে তা সরকারের কোশাগারে জমা দিত। গুজরাটের বাইরে প্রতিবেশী মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশের কিছু কিছু অঞ্চলেও পতিদাররা রাজস্ব আদায় করত।

[3] শােষণ: ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে পতিদাররা গুজরাটের দরিদ্র কৃষকদের ওপর তীব্র অত্যাচার চালাত। কৃষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ সুদের অর্থও তারা ভােগ করত। এভাবে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের মালিক হয়ে উঠেছিল। পতিদারদের নানাবিধ শােষণের ফলে গুজরাটের কৃষকদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়।

[4] গ্রামীণ সমাজে ভাঙন: গুজরাটের পতিদাররা শীঘ্রই বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের মালিক হয়ে উঠলে তারা সাধারণ দরিদ্র কৃষকদের থেকে পৃথক সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পতিদাররা কংগ্রেসের একনিষ্ঠ সমর্থকে পরিণত হলে পতিদার বিরােধিরা ‘স্বতন্ত্র পার্টি’-র সমর্থকে পরিণত হয়। অবশ্য পরবর্তীকালে গান্ধিজির নেতৃত্বে উভয় সম্প্রদায়ই জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিল।

দাক্ষিণাত্যের বােম্বাই প্রেসিডেন্সিতে গ্রামের প্যাটেল বা মােড়লরা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করত। ফলে সরকার ও প্যাটেলদের যৌথ শােষণে জর্জরিত কৃষকরা মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এই সুদখাের মহাজন শ্রেণি দাক্ষিণাত্যে ‘সাউকার’ নামে পরিচিত।

[1] সাউকারদের প্রসার: দাক্ষিণাত্যে কৃষকদের ঋণগ্রহণের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেখানে সুদখাের সাউকারদের মহাজনি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ঋণের বিনিময়ে কৃষকদের জমির দলিলপত্র সাউকারদের কাছে বন্ধক থাকত। এভাবে কৃষকদের জীবন জীবিকার ওপর সাউকারদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়।

[2] শােষণ: সাউকাররা কৃষকদের নগদ টাকা, বীজধান, খাদ্যশস্য প্রভৃতি ঋণ দিত। এই ঋণের সুদের হার ছিল ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ এবং তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ত। এই ঋণ পরিশােধে ব্যর্থ হয়ে দরিদ্র কৃষকরা সাউকারদের কাছে চিরদিনের মতাে ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ত। ঋণের জালে আবদ্ধ কৃষকদের জমিজমা সাউকাররা কেড়ে নিলে কৃষকরা জমি থেকে উৎখাত হয়ে সর্বস্বান্ত হত।

[3] দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ: ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দাক্ষিণাত্যে কৃষিপণ্যের মূল্য হ্রাস, পরবর্তী কয়েক বছর ধরে অজন্মা প্রভৃতির ফলে কৃষকরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় কৃষকরা সরকারের রাজস্ব এবং সাউকারদের ঋণের অর্থ পরিশােধে ব্যর্থ হলে সাউকাররা। আদালতের সহায়তায় কৃষকদের জমি ও বাড়ি দখল করে নিতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কৃষকরা সাউকারদের বিরুদ্ধে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে পুনা জেলার কারদে গ্রামে বিদ্রোহ শুরু করে। পরের বছর এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই বিদ্রোহ সাউকার বিরােধী দাঙ্গা’ বা দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ নামে পরিচিত। অবশ্য পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তীব্র দমননীতির ফলে শেষপর্যন্ত বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।