যে সকল কারণে কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীকে সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিকুলের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আসন দান করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম কবির সমাজসচেতনতা। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, কঠোর বাস্তবতাবোধ এবং সহাদয়তার বলে তিনি সমাজের গভীরে দৃষ্টিপাত ক’রে তার একটি বাস্তব এবং বিশ্বাস্য প্রতিরূপ চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে উপস্থাপিত করেন বলেই আমরা এখানে তৎকালীন সমাজ জীবনের একটি যথার্থ ও বিশ্বাস্য পরিচয় লাভ করতে পারি।

কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে মোটামুটি তিনটি কাহিনী – হরগৌরীর জীবনযাত্রা, কালকেতু ফুল্লরা কাহিনী এবং ধনপতি সদাগরের কাহিনী—এই তিনটি কাহিনিতেই সমাজজীবনের এত উপাদান বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে যে, এগুলিকে গুছিয়ে সংগ্রহ করতে পারলে তৎকালীন সমাজের একটি ঐতিহাসিক চিত্র গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে। অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী বলেন, “সাহিত্যে যাহারা সমাজ-চৈতন্য খোঁজে চণ্ডীকাব্য তাহাদের লুটের মাহাল। এত অবিকৃত সমাজ-চৈতন্য আর কোনো কাব্যে আছে কিনা জানি না। বাস্তবিক চণ্ডীকাব্য সামাজিক ইতিহাসের দলিল, না কাব্য তাহা এখনো ঠিক করিয়া উঠিতে পারি নাই।”

ভারতীয় হিন্দুদের দশবিধ সংস্কারের মধ্যে সর্বপ্রধান বিবাহ-সংস্কার। বিবাহ-ব্যাপারে স্ত্রী আচার বিষয়ে দেশকালোচিত কিছুটা স্বাতন্ত্র্য থাকলেও শাস্ত্রীয় বিধান প্রায় সর্বত্রই অনুরূপ। কবিকঙ্কণের কাব্যে ষোড়শ শতকে বিবাহের যে বর্ণনা প্রদত্ত হয়েছে, নিষ্ঠাবান গৃহস্থ গৃহে। এখনো প্রায় তেমনটিই দেখা যায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য—কালকেতু-খণ্ডে কবি যে দু’টি বিবাহের বিবরণ দিয়েছেন, তার একটি উমা-মহেশ্বরের বিবাহ, অপরটি কালকেতু-ফুল্লরার বিবাহ। প্রথমটি দেব-সমাজের, দ্বিতীয়টি ব্যাধ সমাজের কোনোটিই উচ্চবর্ণ হিন্দু সমাজের হবার কথা নয়। কিন্তু কার্যত দেখা যায়, কবি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এ চিত্র গ্রহণ করেছেন বলে উভয় ক্ষেত্রেই তা উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের চিত্রই অঙ্কিত হয়েছে। দেবসমাজের বিবাহচিত্র আমাদের অজ্ঞাত ব্যাধসমাজের যে বিবাহ-চিত্র আমাদের জ্ঞানসীমার আওতায় আসে—অনুমান করা চলে, এ দুটির কোনোটিই আলোচ্য বর্ণনায় যথাযথভাবে অঙ্কিত হয়নি। কবি উভয় চিত্রকে প্রায় একই রূপ দান করেছেন পার্থক্য অতি সামান্যই এবং এ চিত্র উচ্চবর্ণ হিন্দুসমাজের বিবাহ অনুষ্ঠানের খাঁটি বাস্তব চিত্র।

সেকালে বাল্যবিবাহই প্রশস্ত বিবেচিত হ’ত। বিবাহ-কালে উমার বয়স ছিল মাত্র আট— ‘অষ্টবর্ষে ভবেৎ গৌরী’—তাই উমা হলেন গৌরী বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপনে ঘটকেরও ভূমিকা ছিল, উমা মহেশ্বরের বিবাহে ঘটক ছিলেন নারদমুনি। হিমালয় কর্তৃক প্রেরিত নারদ মহাদেবের সম্মতি পেলে গিরিরাজ সর্বত্র এই আনন্দ সংবাদ ঘোষণা করেন। শুভদিন শুভক্ষণ দেখে মুনিরা বিবাহের স্বস্তিবাচক করলেন—

‘আরোপি হেমঘটে    যুগল করপুটে

গণেশে কৈল আবাহন।’

(গণেশ জননী গৌরীর বিবাহে গণেশ পূজা অস্বাভাবিক। কবি যে প্রচলিত হিন্দু সমাজের বিবাহপ্রথাই বর্ণনা করেছেন, এটি তার প্রমাণ। অবশ্য কোনো কোনো সংস্করণে এই পংক্তিটি বর্জিত হয়েছে।) পার্বতী হলুদ শাড়ি পরে বসলেন–মুনিরা বেদধ্বনি ক’রে গন্ধাধিবাস শুরু করলেন—মহী-গন্ধ-দুর্বা পুষ্পমালা আদি নানা উপচারে অধিবাসের ডালা সাজানো হ’ল। করে সূত্র বন্ধন ক’রে মস্তকে দীপ পাত্র ছোঁয়ানো হ’ল এবং সিঁথিতে অঙ্গুরী দিয়ে আশিস্ যোজনা করা হ’ল। প্রচুর নৈবেদ্য সহযোগে বোড়শমাতৃকার পূজা হল গৃহভিত্তিতে বসুধারা দান করা হ’ল। বসুপূজা অস্তে হিমালয় নান্দীমুখ শ্রাদ্ধ করলেন। পুরনারীরা সমবেত হয়ে মঙ্গলাচরণে ব্ৰতী হলেন।

গৌরী-জননী মেনকা পুরনারীদের সঙ্গে কাখে কলসী নিয়ে ঘরে ঘরে জল সইয়ে এলেন। পরে এয়োরা সমবেতভাবে উলুধ্বনি দিয়ে ঊমার হাতে সুমঙ্গলসূত্র বেঁধে দিলেন।

ওদিকে মহাদেবও যথাবিধি বেদ-বিধান অনুযায়ী অধিবাস আদি সম্পন্ন ক’রে ভূত-প্রেত দানা দত্যি বরযাত্রী নিয়ে হিমালয়-গৃহে উপস্থিত হলেন। গিরিরাজ বর যথোচিত অভ্যর্থনা করে হাত ধরে আসনে বসালেন এবং অঙ্গুরী বসন মালা আদি দ্বারা বরণ করলেন। ওদিবে মেনকা পুরনারীদের নিয়ে স্ত্রী-আচার শুরু করলেন।

মেনকা বর মহাদেবের চরণে দধি ঢেলে দিলেন, কপালে চন্দন এবং ঘৃতযুক্ত ঔষধ লেপন করলেন। কবি এখানে মহাদেবের আবরণ ও আভরণ নিয়ে একটু রঙ্গরস করছেন। মেনকার বরণডালায় যে ঈশের মূল ছিল, তার গন্ধে মহাদেবের কটিবেষ্টন সৰ্প পালিয়ে গেলে মহাদেব শাশুড়ি ও নারীদের সামনে উলঙ্গ হয়ে পড়লে নন্দী মশাল নিবিয়ে স্থানটিকে অন্ধকার করে দিলে সবাই পালিয়ে বাঁচেন। এর পর নন্দীর অনুরোধে মহাদেব মদনমোহন বেশ ধারণ করলে তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হ’য়ে সমবেত নারীগণ পতিনিন্দা শুরু করেন। (নারীদের পতিনিন্দা মঙ্গলকাব্যের একটি সাধারণ লক্ষণ— সব মঙ্গলকাব্যেই এটি বর্ণিত হ’য়ে থাকে।)

মহাদেব বৃষে আরোহণ করলেন— মধ্যে কাণ্ডার বস্ত্র ধারণ করা হ’ল। গৌরী শিবকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে নিছিয়া পেলিল পান কৈল নমস্কার’। তারপর শিবের গলায় রত্নমালা পরিয়ে দিলেন গৌরী। দুজনে সামনাসামনি বসলেন, ঋষিপত্নীরা উলুধ্বনি করলেন। এরপর ব্রহ্মার পৌরোহিত্যে গিরিরাজ মহাদেবের হাতে গৌরীকে সম্প্রদান করলেন। হরগৌরী একাসনে বসলে পিতামহ গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন। নবদম্পতি গন্ধপুষ্প দিয়ে মহীপূজা করলেন এবং অরুন্ধতী দর্শন করলেন।

গিরিরাজ জামাতাকে ঝালর শয্যা থালা ধেনু এবং উত্তম আসন যৌতুক দান করলেন। তিনি যে যৌতুকস্বরূপ শিবকে প্রচুর ভূসম্পত্তিও দান করেছিলেন তার অন্যত্র উল্লেখ রয়েছে। এ সমস্ত যৌতুকের সঙ্গে জয়া ও সখী পদ্মাবতীকেও তাদের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হ’ল। এর পর উভয়ে ক্ষীর অন্ন ভোজন করে বাসর শয্যায় গেলেন।

কালকেতু-ফুল্লরার বিবাহ চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে মূল কাহিনী অর্থাৎ কালকেতুর কাহিনীতে কালকেতু ও ফুল্লরার যে বিবাহের চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে, তার সঙ্গে হরগৌরীর বিবাহ কাহিনীর কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। ফলে, নামত, কালকেতু ফুল্লরার বিবাহ কাহিনী বলা হ’লেও কার্যত এখানেও উচ্চবর্ণের হিন্দুঘরের বিবাহের চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। এখানে যে সকল শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান বর্ণিত হয়েছে, বাস্তবে ব্যাধ পরিবারে এ জাতীয় অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। যাহোক, এখানে ব্যাধ জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিছু বিশেষ বর্ণনাও রয়েছে, যার গুরুত্ব অবশ্যই স্বীকার্য।

সেকালে ব্যাধ-সমাজেও বাল্য বিবাহ প্রথাই প্রচলিত ছিল। বিবাহ-কালে কালকেতুর বয়স ছিল সম্ভবত দশ, কারণ ঘটক বলেছেন, কালকেতু–

‘কার করে দশম বৎসরে মাতা হাতী।’

এখানেও ঘটকের সহায়তায় বিবাহ সম্বন্ধ স্থিরীকৃত হ’ল। হাটেই কালকেতু ও ফুল্লরার অভিভাবকগণ পাত্র-পাত্রী মনোনীত করলেও সামাজিক কারণে উভয়েই ঘটকের শরণ নিয়েছে। কালকেতুর পিতা ধর্মকেতু তাদের কুলপুরহিত সোমাই ওঝাকে কালকেতুর বিবাহের জন্য অনুরোধ করে

‘কিরাত নগরে কর কন্যার উপাস।’

সোমাই ওঝার মনে পড়লো ফুল্লরার কথা। সেই ভেবে তিনি গেলেন ফুল্লরার পিতা সঞ্জয়কেতুর গৃহে। পুরোহিতকে দেখে সঞ্জয়কেতু ও ফুল্লরা প্রণতি জানালো। সঞ্জয়কেতু প্রথমেই ফুল্লরার গুণের পরিচয় দিয়ে বলে

‘কিনিতে বেচিতে ভাল জানয়ে পসরা। 

রন্ধন করিতে ভাল এই কন্যা জানে।।’

সঞ্জয়কেতু এরপর সোমাই ওঝার কাছে ফুল্লরার যোগ্য বর দেখে দেবার জন্য আবেদন জানালে ওঝা কালকেতুর কথা উল্লেখ করে বলেন— 

‘খুজিয়া পাইল যেন হাঁড়ির মুখে শরা।’

সঞ্জয়কেতু স্বীকৃত হয়ে ওঝাকে এই বিবাহ সম্বন্ধ স্থির ক’রে দেবার অনুরোধ জানিয়ে বলে

‘পণের নির্দেশ কৈল দ্বাদশ কাহন।

ঘটকালি পাবে ওঝা তুমি চারিপণ।।

পচি গণ্ডা ওয়া দিব গুড় পাঁচ সের।

ইহা দিনে আর কিছু না করিবে ফের।।’

এই সংবাদ নিয়ে সোমাই ওঝা ধর্মকেতুকে এই সংবাদ জানালে পর মনে হয় সঞ্জয়কেতু ভাবী বর ও তার আত্মীয় স্বজনের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিবাহের ব্যবস্থা পাকা করলো। এর বিবরণ

ভক্ষ্যদ্রব্য কৰি কৈল বান্ধবের মেলা।

সঞ্জয় ‘আনিয়া বরে দিল বরমালা।।

তিনটা পাতন কাঁড় দিল জামাতারে।

দু’ বেহাই কোলাকুলি করি গেলা ঘরে।।

গোলাহাটে শোধ দিল দ্বাদশ কাহন। 

কন্যা দরশনী দিয়া করিল লগন।।’

মনে হয়, বরকে নানাবিধ যৌতুক দান করলেও কন্যাপণও প্রচলিত ছিল। বিবাহের লগ্ন নির্দিষ্ট হ’ল রেবতীনক্ষত্রযুক্ত ত্রয়োদশী তিথি বৃহস্পতিবার (অথবা রবিবার)।

কালকেতু-ফুল্লরার বিবাহের বর্ণনা প্রায় ঊমা-মহেশ্বরের বিবাহের অনুরূপ, শুধু ব্যাধজীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্য কিছুটা নতুনত্ব সৃষ্টি করা হয়েছে, ঢেমচা দগড় বাজদা, কুঙর চর্মে উপবেশন, দোলায় গমন, বনফুলের মালা দিয়ে বরণ প্রভৃতি। এ ছাড়া এখানেও ব্রাহ্মণ পুরোহিত বেদমন্ত্রে গণেশের আবাহন দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন, এখানেও হয় গদ্ধাধিবাসন, ফুল্লরাও হলুদ শাড়ি পরে বসে, দ্বিজ করে সূত্র বেঁধে দেন বোড়শমাতৃকা পূজা, বসুধারা দান এবং নান্দীমুখ শ্রদ্ধা-আদি যাবতীয় ক্রিয়াকমই শাস্ত্রীয় বিধানে হচ্ছে। হরগৌরীর বিবাহ অনুষ্ঠানের সঙ্গে এর কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই।

এখানে বাউড়িদের দোলায় চড়ে এলো কালকেতু সঙ্গে রয়েছে বরযাত্রীরা। উলুধ্বনির মধ্যে সবাই এসে পৌঁছলে—

‘বেহ আগাইয়া ধীরে    গুড় চাউলী মারে

গুয়া কাটায় হৈল গণ্ডগোল।’

ফুল্লরার মা স্ত্রী-আচারে জামাতাকে বরণ করে

‘শিরে দিয়া দূর্বাধান    নিছিয়া ফেলিল পান

গলে দিল বনফুলমালা।’

সঞ্জয়কেতু কুশহস্তে কন্যাদান করে সঙ্গে দিল যৌতুক

‘যৌতুক ধনুক খান    দিল খর তিন বাণ

জামাতারে করিল বহু মান’

এখানেও দ্বিজ বরকন্যার বস্ত্রে গাঁটছড়া বেঁধে দিলে তারা লাজাহুতি দিয়ে হোম করলো এবং অরুন্ধতী দর্শন করলো। এর পর খাদ্যের ব্যাপারে হরপার্বতীর সঙ্গে মিল নেই, বরং একটু বৈশিষ্ট্য আছে।