‘গৌরচন্দ্রিকা কাকে বলে? চৈতন্যদেবের সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালে রচিত গৌরপদাবলীর একটি তুলনামূলক আলোচনা করো।
“গৌরচন্দ্র-বিষয়ক পদমাত্রই গৌরচন্দ্রিকা নয়।”- এই মন্তব্যের আলোকে বৈষ্ণব পদাবলীর রসাস্বাদনে গৌরচন্দ্রিকার তাৎপর্য নির্ণয় করো।
লীলারস আস্বাদনে ‘গৌরচন্দ্রিকা’ শীর্ষক পদসমূহের গুরুত্ব নির্দেশ করো তোমার অধীত গৌরচন্দ্রিকা-বিষয়ক একটি পদের কাব্যগত বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দাও।
বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে ‘গৌরচন্দ্রিকা’ শ্রেণীর পদের প্রয়োজনীয়তা কী? ‘গৌরচন্দ্রকে লইয়া রচিত পদমাত্রই গৌরচন্দ্রিকা নহে’— উক্তিটির তাৎপর্য তোমাদের অধীত পদগুলি হইতে উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা করো।
চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলাদেশে এক যুগান্তকারী ঘটনা। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ বিশ্বাস করেন যে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধাপ্রেমের স্বাদ এবং রাধারূপে কৃষ্ণপ্রেমের স্বাদ গ্রহণ করবার জন্যেই গৌরসুন্দরের রূপ ধারণ করে নবদ্বীপধামে অবতীর্ণ হন। গৌরাঙ্গদের একদেহে রাধা এবং কৃষ্ণের যুগল অবতার—অস্তঃকৃষ্ণ বহিগৌর। অতএব গৌরাঙ্গদেবের আবির্ভাবে যে বৈষ্ণব পদাবলী সমৃদ্ধি লাভ করবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। রাধা-কৃষ্ণের লীলা অবলম্বনেই ‘মহাজন পদাবলী’ রচিত হয়ে থাকে, কিন্তু চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে তার মধ্যে আরও বৈচিত্র্য এলো। চৈতন্য-সমকালীন কবিরা গৌরাঙ্গদেবের বাল্যলীলার পদ রচনা করলেন, পরবর্তীকালে তার অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলারও অনেক পদ রচিত হল। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো বৈচিত্র্য— চৈতন্যদেব তথা গৌরাঙ্গকে অবলম্বন করেও রচিত হ’ল অসংখ্য পদ এক কথায় এদের বলা চলতে পারে ‘গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ’।
গৌরচন্দ্রিকাও গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ, কিন্তু যে-কোনো গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদই গৌরচন্দ্রিকা নয়। শ্রীচৈতন্যের রূপ ও মহিমার বর্ণনা, নদীয়া-নাগরী ভাবের আশ্রয়ে রচিত গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদ এবং ব্রজলীলার অনুসরণে যে-সকল গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ রচিত হয়েছে, একমাত্র ঐগুলোকেই বলা হয় ‘গৌরচন্দ্রিকা’, এ ছাড়াও গৌরাঙ্গদেবের লৌকিক জীবন, সন্ন্যাস ও নামকীর্তনের বর্ণনা, শচীমাতা ও বিষ্ণুপ্রিয়ার বিরহ অবলম্বনে রচিত পদ এবং চৈতন্য-সহচরদের উদ্দেশ্যে ও সম্বন্ধে রচিত পদগুলো গৌরাঙ্গ বিষয়ক হলেও এদের গৌরচন্দ্রিকা বলা চলে না। বস্তুত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বৈষ্ণব কবিগণ যে সকল গৌরাঙ্গবিষয়ক পদ রচনা করেছেন, গৌরচন্দ্রিকার মর্যাদা একমাত্র এদেরই প্রাপ্য। গৌরাঙ্গ বিষয়ক যে সকল পদে গৌরাঙ্গদেব রাধাভাবে ভাষিত ছিলেন, একমাত্র সেই পদগুলোকেই গৌরচন্দ্রিকা বলা চলতে পারে – কথাটি বিশেষভাবেই – স্মরণীয় লীলাকীর্তনে যে বিশেষ রস বা বিশেষ পর্যায়ের পালাগান পরিবেশিত হয় কীর্তনারম্ভে তার সদৃশ কোনো গৌরলীলার পদের গানকেই গৌরচন্দ্রিকা বলে। ফলত গৌরচন্দ্রিকা শ্রবণেই শ্রোতা বুঝতে পারেন, কৃষ্ণলীলার কোন পর্যায়ের গান অনুষ্ঠিত হবে। বৈষ্ণব পদাবলীর জনৈক গবেষক অধ্যাপক লিখেছেন, “রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তনের সময় ভূমিকাস্বরূপ এই পদগুলি গীত হয়, তাহাতে শ্রোতা বুঝিতে পারেন বৃন্দাবনলীলার কোন পর্যায়টি আসরে গীত হইবে। গৌরাঙ্গ বিষয়ক যে কোনো পদকেই ‘গৌরচন্দ্রিকা’ বলা হয় না, যে পদটিতে বৃন্দাবনলীলার ভাবব্যঞ্জনা রহিয়াছে—তাহাকেই গৌরচন্দ্রিকা বলিয়া ধরা হয়। শুদ্ধ প্রেমপুত শ্রীগৌরাঙ্গের লীলা আস্বাদন করিতে করিতে শ্রোতা সাময়িকভাবে কাম-গন্ধহীন প্রেমলোকে উত্তীর্ণ হয়। আর এক শ্রেণীর চৈতন্যজীবনী বিষয়ক পদাবলীতে গৌরাঙ্গের জন্ম, বাল্য, যৌবন, কীর্তন, নামপ্রচার, সন্ন্যাসগ্রহণ প্রভৃতি ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হইয়াছে। এই পদগুলি গৌরচন্দ্রিকার মতো ভাবরসসমৃদ্ধ নহে, তবে ইহাতে চৈতন্য-জীবনের বাস্তবতার দিকটি সহজ সরলভাবে বিধৃত হইয়াছে।”
বৃন্দাবনলীলার সঙ্গে সাযুজ্য রাখবার উদ্দেশ্যেই গৌরলীলায়ও পূর্বরাগ, অভিসার, মান, মাধুর প্রভৃতি পদ রচিত হয়েছে। চৈতন্যদেব শ্রীমতী রাধার ভাবটিকে আত্মস্থ করে কৃষ্ণপ্রেম উপলব্ধি করেছিলেন বলেই ব্রজলীলার সঙ্গে গৌরলীলার এই সাদৃশ্য প্রকটিত হয়েছে। “রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলায় কোনো কোনো গৌরচন্দ্রিকায় শ্রীগৌরচন্দ্র কৃষ্ণভাবে ভাবিত, আবার কোনো কোনো পদে তিনি রাধাভাবে ভাবিত। যেমন, দানলীলা নৌকালীলা প্রভৃতিতে শ্রীগৌরাঙ্গ কৃষ্ণ ভাবে লীলা করেছিলেন, তাই এইসব গৌরচন্দ্রিকায় গৌরচন্দ্রের কৃষ্ণভাব খণ্ডিতা, বাসকসজ্জা বা মাধুরে গৌরচন্দ্রের রাধাভাব। তাই এইসব গৌরচন্দ্রিকার পদে শ্রীচৈতন্য রাধাভাবে ভাবিত। প্রেমলীলার অন্যত্র কৃষ্ণের ব্রজলীলার গোষ্ঠলীলা, কালিয়দমন গৌরচন্দ্রিকায় শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণভাব। কতকগুলি গৌরবিষয়ক পদে যেমন, গোবিন্দদাসের ‘পতিত হেরিয়া কাদে, স্থির নাহি বান্ধে, করুণ নয়নে চায়’; পরমানন্দ সেনের ‘পরশমণির সাথে কি দিব তুলনা রে, পরশে ছোঁয়াইলে হয় ‘সোনা’—’ইত্যাদিতে শ্রীচৈতন্যের যে চিত্র ফুটিয়াছে তাহা আচণ্ডালে প্রেম-বিতরণকারী ‘পতিতপাবন’ গৌরচন্দ্রের। এই ধরনের পদগুলিকে গৌরচন্দ্রিকা বলা হয়। পালাবন্দী রসকীর্তনের ক্ষেত্রেই গৌরচন্দ্রিকার সার্থকতা।”
কৃষ্ণলীলা কীর্তনের পূর্বে গৌরচন্দ্রিকা অবতারণার আর একটি তাৎপর্য’ – এর সঙ্গে সঙ্গে একটা আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল তৈরি হয় এবং শ্রোতার মানসভূমিও উপযুক্ত রস গ্রহণের জন্য উন্মুখ থাকে। অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ভাষায় -“মহাপ্রভু কৃষ্ণলীলায় চমৎকারিত্ব যেভাবে – আস্বাদন করিয়াছিলেন এমন আর কেহ করেন নাই। বস্তুত সেই নিখিল রসমাধুরী-বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণ শ্রীগৌরাঙ্গরূপে নিজ রসমাধুর্য নিজেই আস্বাদন করিয়াছিলেন। সুতরাং তাহারই অনুগত হইয়া রসাস্বাদন করিবার যে প্রতিজ্ঞা গায়ক ও ভক্তগণ করেন, তাহা তত্ত্বের দিক্ দিয়া ও রসের দিক্ দিয়া সর্বদা যোগ্য বলিয়া মনে হয়।”
‘গৌরচন্দ্রিকা’ নামকরণ থেকে একটি সহজ সত্য চিনে নেওয়া যায়। গৌরাঙ্গদেব পরবর্তী জীবনে শ্রীকৃষ্ণচৈতনা বা চৈতন্যদেবরূপেই পরিচিত ছিলেন এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন ও রসশাস্ত্র চৈতন্যদেবকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে। তার জীবনী গ্রন্থগুলোও চৈতন্য নামাঙ্কিত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও যে গৌরচন্দ্রিকা চৈতন্যচন্দ্রিকারূপে আখ্যায়িত হল না, তার একমাত্র কারণ এই যে, গৌরলীলার কাহিনী প্রধানত তাঁর সন্ন্যাস-পূর্ব জীবন অর্থাৎ গৌরাঙ্গজীবনকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে। অতএব স্মরণ রাখা দরকার, কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত হয়েই তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন সন্ন্যাস গ্রহণের পর তার মধ্যে কৃষ্ণপ্রেম জাগরিত হয়নি। রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত গৌরাঙ্গদেব প্রথম জীবনেই রাধাভাবে বিভোর হয়ে কৃষ্ণপ্রেম কামনা করেছিলেন এবং এই সময়েই তার মধ্যে রাধাভাবের অনুরূপ পূর্বরাগ-অভিসারাদি বিভিন্ন ভাবপর্যায় লক্ষিত হয়েছিল।
চৈতন্য-সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালের অনেক কবিই গৌরাঙ্গদেবকে অবলম্বন করে অনেক পদ রচনা করেছেন। কিন্তু পুর্বেই বলা হয়েছে, তাদের সকল পদই গৌরচন্দ্রিকা নয়। গৌরসুন্দরের রূপ ও মহিমাসূচক পদগুলো গৌরচন্দ্রিকার অন্তর্ভূত। এরূপ পদও অনেক আছে। গোবিন্দদাসের
নীরদ নয়ন নীর ঘন সিঞ্চনে
পুলক- মুকুল-অবলম্ব।
এরূপ একটি সার্থক পদ।
গৌরাঙ্গের সমকালীন ঘোষভ্রাতৃত্রয়ের কনিষ্ঠ জনের হাত দিয়েই সম্ভবত গৌরচন্দ্রিকার বিভিন্ন পর্যায়ভুক্ত পদ রচিত হয়েছিল। এই বাসুদেব ঘোষ আবার নিমাই সন্ন্যাসের পালা লিখে চৈতন্যজীবনের অনেক প্রামাণিক কাহিনী উদ্ঘাটন করে গেছেন। তিনিই প্রথম রাধাকৃষ্ণলীলার অনুসরণে চৈতন্যদেবের পূর্বরাগ, মিলন, দানলীলা, রাসলীলা, বিরহ প্রভৃতি পর্যায়ের পদ রচনা করেন।
শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার মতই গৌরাঙ্গের বাল্যলীলার পদ লিখেছেন বাসুদেব ঘোষ—
শচীর আঙ্গিনায় নাচে বিশ্বস্তর রায়।
হাসি হাসি ফিরি ফিরি মায়েরে লুকায়।।
বয়নে বসন দিয়া বলে লুকাইনু।
শচী বলে বিশ্বস্তর আমি না দেখিনু ।।
শুধু বাসুদেব ঘোষ নয়, আরও অনেকেই বৃন্দাবনলীলার অনুসরণে বিভিন্ন পর্যায়ের গৌরচন্দ্রিকা রচনা করেছেন।
রাধামোহন বয়ঃসন্ধি, অভিসার, রসোেগার, খণ্ডিতা, কলহাস্তরিতা, রূপোল্লাস, গোষ্ঠ, রাস, বিরহ, দশ দশা-আদি যাবতীয় পর্যায়ের পদই গৌরচন্দ্রিকায় রচনা করেছেন। এ ছাড়া জ্ঞানদাস, লোচনদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখ প্রধান বৈষ্ণব মহাজনগণও অনুরূপ গৌরচন্দ্রিকার পদ রচনা করেছেন।
রাধাকৃষ্ণের লীলা কীর্তনের অনুসরণেই গৌরচন্দ্রিকার পদগুলো রচিত হয়েছিল বলে এর মধ্যেও অসাধারণ বৈচিত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়। পদকর্তারা চৈতন্যদেব ও রাধার আবেগের সাদৃশ্য অনুভব করে রাধার অনুভূতিই গৌরাঙ্গদেবে আরোপ করেছেন। গৌরচন্দ্রিকার বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত নিচে দেওয়া হল।
রাধামোহন রচিত পূর্বরাগের একটা পদ—
‘আঙ্গু হাম পেখলু নবদ্বীপ চন্দ।
করতলে করই বয়ন অবলম্ব।।
পুন পুন গতাগতি করু ঘর পন্থ।
খেনে খেনে ফুলবনে চলই একাস্ত ৷৷’
পূর্বরাগের বা বিরহের অনুরূপ ভাব প্রকাশ পেয়েছে জ্ঞানদাসের একটি পদে—
‘সহচর-অঙ্গে গোরা অঙ্গ হেলাইয়া।
চলিতে না পারে খেনে পড়ে মুরছিয়া।।
……
কোথায় পরাণনাথ বলি খেনে কান্দে।
পূরব বিরহ-জ্বরে থির নাহি বান্ধে।।’
বৈষ্ণবপদকর্তাগণ কখন কখন গৌরাঙ্গকে কৃষ্ণরূপে এবং ভক্তদের গোপীরূপে চিহ্নিত করে দানলীলা আদি-বিভিন্ন পর্যায়ের পদ রচনা করেছেন—
‘আজু রে গৌরাঙ্গের মনে কিভাব উঠিল।
নদীয়ার মাঝে গোরা দান সিরজিল।।’
Leave a comment