চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বেই এদেশে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে উপজীব্য করে পদাবলী সাহিত্যের রচনা শুরু হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের উল্লেখ করা চলে। ‘ভাগবতপুরাণ’-এ কৃষ্ণ-কাহিনী বিস্তৃতভাবেই বর্ণিত হয়েছে এবং এই কারণে পুরাণখানি ভক্ত বৈষ্ণবের নিকট শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা লাভ করে থাকে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, এতে রাধার নামটি পর্যন্ত কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। সম্ভবত পরবর্তী পুরাণসমূহে বিশেষত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী বিস্তৃতভাবে পরিবেশিত হয়েছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দেই বোধ হয় সর্বপ্রথম রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ে রচিত গীতিধর্মী পদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই সমস্ত পদসাহিত্যের কোনো কোনো রচনার মধ্যে কবিদের ব্যক্তিগত অনুভূতির উচ্ছ্বাসই প্রাধান্য লাভ করেছিল। এখানেও রাধাভাবের সাধনা – কবি স্বয়ং যেন রাধারূপে কৃষ্ণপ্রেমের স্বাদ উপলব্ধিতে তৎপর। কিন্তু চৈতন্যোত্তর কবিগণ চৈতন্যদেবের অন্তরালে দাঁড়িয়ে যেন রাধাকৃষ্ণের লীলারস আস্বাদন করেছেন।

চৈতন্যদেব-প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে রাধাভাবের সাধনাকেই শ্রেষ্ঠ সাধনা বলে অভিহিত করা হয়। “চৈতন্য চরিতামৃতে’ চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের কারণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে—

‘রাধাভাব অঙ্গীকার ধরি তার বর্ণ। 

তিনসুখ আম্বাদিতে হয় অবতীর্ণ।।’

রাধাপ্রেমের স্বরূপ উপলব্ধি করবার জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মর্ত্যলোকে নবদ্বীপচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বস্তুত গৌড়ীয় বৈষ্ণব-দর্শনে রাধাভাবের সাধনাকেই শ্রেষ্ঠ সাধনারূপে অভিহিত করা হয়েছে। চেতন্যলীলার আদি সূত্রধার স্বরূপদামোদর তাঁর কড়চার গৌরাঙ্গ অবতারতত্ত্ব বিষয়ে যে শ্লোকটি রচনা করলেন, গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা কবিরাজ গোস্বামীও তাকে স্বীকৃতি দিয়ে স্বীয় গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেছেন—

‘শ্রীরাধায়া: প্রণয়মহিমা কীদৃশো বানয়ৈবা

স্বাদ্যো যেনাদ্ভুত মধুরিমা কীর্দৃশ্যে বা মদীয়ঃ।

সৌখ্যং চা্যা মদনুভবতঃ কীদৃশ্যং বেতি লোভাৎ,

তদ্ভাবাঢ্যঃ সমজনি শচীগর্ভসিদ্ধৌ হরীদুঃ।।’

“১। শ্রীরাধার প্রণয়মহিমা কীরূপ। ২। শ্রীরাধা যাহা আস্বাদন করেন, আমার সেই বৈচিত্র্যমাধুর্য কীরূপ এবং ৩। আমার অনুভববশত শ্রীরাধা যে সৌখ্য বা আনন্দ অনুভব করেন, সেই আনন্দই বা কীরূপ—এই তিনটি বিষয়ের প্রতি লোভের বশীভূত হইয়া শচীর গর্ভরূপে সিন্ধুতে রাধাভাববিশিষ্ট শ্রীকৃষ্ণরূপ আবির্ভূত হইলেন।” অর্থাৎ রাধাপ্রেমে ভাবিত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমের স্বাদ গ্রহণ করবার জন্যই চৈতন্যদের ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন। চৈতন্য-সমকালীন বাসু ঘোষও (অথবা নরহরি সরকার) একই কথা বলে গেছেন –

“যদি গৌরাঙ্গ না হৈত কি মেনে হৈত কেমনে ধরিতাম দে

রাধার মহিমা প্রেমরসসীমা জগতে জানাত কে।।

মধুরবৃন্দাবিপিনমাধুরী প্রবেশ চাতুরী সার।

বরজ-যুবতী-ভাবের ভকতি শকতি হইত কার।।”

রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত তনু গৌরাঙ্গসুন্দর একই দেহে রাধা ও কৃষ্ণের পরমতত্ত্ব আস্বাদন করেছিলেন। বহিরঙ্গে তিনি রাধা, অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে একমাত্র ভক্তিমার্গকেই ঈশ্বর আরাধনার শ্রেষ্ঠ উপায়রূপে স্বীকৃতি দান করা হয়েছে। চৈতন্যচরিতামৃতে এই প্রসঙ্গে ‘শুদ্ধা ভক্তি’র কথা বলা হয়েছে। ‘আনুকূল্যে সৰ্বেন্দ্ৰিয়ে কৃষ্ণানুশীলন’ শুদ্ধা ভক্তি এবং এই ‘শুদ্ধা ভক্তি হৈতে প্রেম হয়। অতএব জ্ঞানেন্দ্রিয় কর্মেন্দ্রিয়াদি সর্বপ্রকার ইন্দ্রিয়কে কৃষ্ণাভিমুখী রেখে যে ভক্তি-সাধনার পথে অগ্রসর হওয়া যায়, তার সিদ্ধিই ‘প্রেম’। আবার

‘প্রেম পরম সার মহাভাব জানি। 

সেই মহাভাবরূপা রাধা ঠাকুরানি।।’

চৈতন্যদেব একদেহে উভয়বিধ প্রেমের স্বাদ গ্রহণ করেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের পত্তন করেছিলেন। মহামানব চেতন্যদেবের পক্ষে যা সাধ্য অপরের পক্ষে তা সাধ্য নাও হতে পারে। এই কারণেই চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণবদের রাধা-ভাবে ভাবিত হবার শক্তি না থাকায় তারা রাধাকৃষ্ণের লীলাকে দূর থেকে সখীর মতো নিরীক্ষণ করেছেন। ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেন, “বাঙলার বৈষ্ণব কবিগণ সকলেই একটু দূর হইতে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আস্বাদন করিবার চেষ্টা করিয়াছেন—রাধার ভাব কেহই অবলম্বন করিতে চাহেন নাই। সখী বা মঞ্জরীর অনুগভাবে সাধনা করিয়া নিত্য যুগল-লীলা আস্বাদন করাই ছিল বাঙলার বৈষ্ণব কবিদের সাধ্য সার।”

চৈতন্য পূর্ব বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রেমকে অনেকটা প্রাকৃত বা পার্থিব প্রেমরূপেই বর্ণনা করা চলে। কিন্তু চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব কবিগণ ভক্তির দ্বারা সেই পার্থিব প্রেমকে কিছুটা মেজে ঘষে মালিন্যমুক্ত করে তবে প্রকাশ করেছেন। তবে ডঃ দাশগুপ্তের মতে “পরবর্তীকালে গৌড়ীয় গোস্বামিগণ কর্তৃক যখন রাধাতত্ত্ব দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইল তখনও সাহিত্যের ভিতরে রাধা তাহার ছায়াসহচরী মানবী নারীকে একেবারে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই।”

বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রেমধর্মের যে স্বরূপ প্রকটিত হয়েছে তার যেমন একটা পার্থিব রূপ আছে, তেমনি আছে আধ্যাত্মিক রূপও। বাংলা সাহিত্যের জনৈক ঐতিহাসিক বৈষ্ণব পদাবলীতে বর্ণিত প্রেমের পার্থিবতা প্রমাণ করার জন্য একটু উগ্র অভিমতই প্রকাশ করেছেন। “সহজিয়া কবি-জীবনে পরকীয়া প্রেমের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল বলিয়াই তাহাদের রচিত বৈষ্ণব পদাবলীতে তাহা স্বাভাবিক, সজীব ও রসোচ্ছল হইয়া প্রকাশিত হইতে পারিয়াছিল এবং সেইজন্য জনপ্রিয়তা ও প্রতিষ্ঠা লাভে সমর্থ হইয়াছিল। ইহাই বৈষ্ণব পদাবলীর প্রকৃত ইতিহাস।” ইনি তার বক্তব্যের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের ‘বৈষ্ণব কবিতা’র অংশবিশেষ উদ্ধার করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, কবি রবীন্দ্রনাথ উক্ত ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। “বৈষ্ণবের গান’ যে শুধু বৈকুণ্ঠের তরে নয়’ এই সিদ্ধান্ত থেকেই রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন,

“সত্য করে কহো মোরে হে বৈষ্ণবকবি 

কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,

…………

…………..হেরি কাহার নয়ন,

রাধিকার অশ্রু আঁখি পড়েছিল মনে? 

বিজন বসস্তরাতে মিলনশয়নে 

কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে, 

আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে 

রেখেছিল মগ্ন করি।”

ব্যক্তি জীবনের উপলব্ধিজাত প্রেমই বৈষ্ণব কবিদের রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণনায় উদ্বুদ্ধ করলেও রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব কবিতাকে মূলত রিয়ালিষ্টিক কবিতা বলে চিহ্নিত করেননি। তিনি বলেন, “বৈষ্ণব পদাবলী প্রেমের মূল বাস্তব জীবনের মৃত্তিকায় বটে, কিন্তু তাহার ফুল ফুটিয়াছে কবি-কল্পনায় উন্মুক্ত আকাশে। এইখানেই পদাবলীর কবিদিগের কবি-প্রতিভা।” এই বিষয়ে অপর একজন মধ্যপথাবলম্বী ঐতিহাসিকের অভিমত উদ্ধারযোগ্য। তিনি বলেন, “… বৈষ্ণব পদাবলীকে পুরাপুরি মর্ত্যপ্রেমের নিরিখে বোঝা যাইবে না, আবার শাস্ত-রসাম্পদ ভক্তির নিরাকাঙ্ক্ষা আত্মনিবেদনও ইহার একমাত্র পরিচয় নহে—উভয়ের সংমিশ্রণে প্রেমের বিষামৃতের তীব্রতায় ইহা অনন্য সাধারণ।” ইনি এইভাবে পার্থিব প্রেম ও ভক্তির মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করে বৈষ্ণব পদাবলীর একটা যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দান করতে চেষ্টা করেছেন।

বৈষ্ণব পদাবলী রোম্যান্টিক গীতিকবিতার লক্ষণযুক্ত। মর্ত্যচৈতন্যকে প্রধান অবলম্বন’ রূপে গ্রহণ করে কবি তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছেন অনেক ঊর্ধ্বে যেখানে কামনা আর প্রাপ্তির মধ্যে আছে দুস্তর ব্যবধান এই প্রাপ্তি কামনার ব্যাকুলতাই কবিকে রোম্যান্টিক করে তুলেছে। অবশ্য ভাগবত চেতনা এবং ধর্মানুভূতিও এই বিষয়ে কবিকে সহায়তা করেছে। এই বিষয়ে প্রাচীন সংস্কৃত এবং প্রাকৃত কবিদের মর্ত্য জীবনাশ্রয়ী রোম্যান্টিক কবিতার এবং জয়দেব-বিদ্যাপতির সৌন্দর্য পিপাসু রোম্যান্টিক মনের প্রভাবের কথাও স্বীকার করতে হয়। বৈষ্ণবপদে পূর্বরাগাদি যে বিচিত্র অনুভূতি রূপায়িত হয়েছে, প্রাচীন সংস্কৃত এবং প্রাকৃত সাহিত্যেও তেমন নিদর্শন অনুপস্থিত নয়। একটি মাত্র দৃষ্টাত্ত উল্লেখ করা যাক

জই সোণ বপ্লহো বি অ গোগ্রহণেণ অস সহি কাঁস। 

হোহি মুহং তে রবি-অর-কংস-বিসদং ব তামরসং।।

অর্থাৎ—‘হে সখী, সে যদি তোমায় প্রিয় না হবে তবে তার নামগ্রহণে তোমার মুখ রবিকরস্পর্শে বিকশিত পদ্মের মতো প্রতীয়মান হবে কেন?

এই প্রাকৃত কবিতাটিতে চণ্ডীদাসের বিখ্যাত ‘কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’-এর পূর্ব নির্দেশ পাওয়া যায় না কী? রাধাকৃষ্ণের প্রেমানুভূতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবিচিত্তে যে রোম্যান্টিকতার জন্মদান করেছে, তা’ কবির কাব্যব্যঞ্জনা এবং সৌন্দর্যসৃষ্টিতেই অবসানপ্রাপ্ত হয়নি, কাব্যদেহ নির্মাণেও স্বধর্মের পরিচয় দান করেছে। অর্থাৎ কাব্যের ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কারাদি বিচারেও এর রোম্যান্টিকতা সুস্পষ্ট।