প্রশ্নঃ গোবিন্দদাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা বৈষ্ণব পদাবলী। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে কেন্দ্র করে রচিত বৈষ্ণব পদগুলো ভাব-ভাষা ও শিল্পগুণে সমুন্নত। বৈষ্ণব পদাবলীর বিভিন্ন রচয়িতা থাকলেও চৈতন্য পূর্ববর্তী বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস এবং চৈতন্য- উত্তর গোবিন্দদাস ও জ্ঞানদাসের পদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে এ সাহিত্য মধ্যযুগের সীমানা পেরিয়ে আধুনিক যুগেও নন্দিত।

গোবিন্দদাস চৈতন্য-পূর্ব প্রখ্যাত শিল্পী বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। তিনি ষোড়শ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকের কবি। তার জন্মস্থান মুর্শিদাবাদ জেলার বধুরী গ্রামে।

তিনি সংস্কৃত শাস্ত্রের অসাধারণ পণ্ডিত। তার পদে ছন্দ, অলঙ্কার ও পদবিন্যাসের বৈচিত্র্য একক ও তুলনা রহিত। বিদ্যাপতির মত গোবিন্দদাসও ছিলেন সচেতন শিল্পী। ভাব ও তন্ময়তার তুলনায় বহিরঙ্গ রূপ চিত্রণের প্রতি তারও অনুরাগ কিছুমাত্র কম ছিল না।

গৌরচন্দ্রিকা, পূর্বরাগ, মাথুর ও অভিসারের পদে গোবিন্দদাস সবিশেষ কৃতিত্ব প্ৰদৰ্শন করেছেন। তার কবিতাগুলো প্রাণের আবেগে সমুজ্জ্বল। তিনি নিজে ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন কিন্তু তার কবিত্বশক্তি এত অসাধারণ ছিল যে, তিনি ভক্ত জনোচিত ভাবালুতা সংবরণ করতে জানতেন। গোবিন্দদাস যে সমস্ত অলঙ্কারের প্রয়োগ করেছেন তন্মধ্যে রূপক ও উপমার বৈচিত্র্য দেখে বিস্মিত হতে হয়।

গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ-

নীরদ নয়নে নীর ঘন সিঞ্চনে

পুলক মুকুল অবলম্ব।

পূর্বরাগঃ 

(i) ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি

(ii) যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।

অভিসারের পদে গোবিন্দদাসের জুড়ি নেই। জ্যোৎস্নাভিসার, দিবাভিসার, গ্রীষ্মাভিসার, তিমিরাভিসার ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের অভিসারের এত বৈচিত্র্য আর কোন কবির পদে নেই। গোবিন্দদাসের অভিসার মানবাত্মারই অভিসার।

অভিসারঃ 

(i) কণ্টক গাড়ি কমল-সম পদতল

(ii) মন্দির বাহির কঠিন কপাট।

প্রকাশভঙ্গির অনবদ্যতায় তার পদগুলো রসোত্তীর্ণ হয়েছে। তার মত চিত্রকল্প আর কোন কবিই নির্মাণ করতে পারেন নি। দুস্তর পথ অতিক্রম করার জন্য রাধিকার অভিসার অভ্যাস বাস্তব জগতের অনুভূতিস্নাত।

গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির মত ব্রজবুলিতে পদ রচনা করেছেন। গোবিন্দদাসের রচনাভঙ্গি, পদবিন্যাস চাতুর্য এবং অলঙ্কারের বহুল প্রয়োগে বিদ্যাপতির পাশেই তিনি কেবল অবস্থান করে নিয়েছেন তা নয়, বরং বৈচিত্র্য ও মাধুর্যের দিক দিয়ে তিনি বিদ্যাপতিকে নিঃসন্দেহে অতিক্রম করেছেন। মৌলিক কল্পনা ও শব্দচয়ন কৌশলের দিক দিয়ে গোবিন্দদাস অগ্রণী ছিলেন।

গোবিন্দদাস যত বড় ভক্ত, তত বড় কবি। তবে তিনি সাধারণত কোন পদের অন্তরঙ্গ অপেক্ষা বহিরঙ্গের সজ্জার প্রতি অধিক সজাগ ছিলেন। ব্রজবুলি ভাষাতেই তিনি পদ রচনা করলেও তৎসম শব্দ ও অর্ধতৎসম শব্দের বহুল প্রয়োগ করে তার পদগুলোকে শ্রুতি মনোহর ও স্পন্দনশীল করে তুলেছেন। ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার প্রভৃতি বিবেচনায় গোবিন্দদাস চৈতন্য-উত্তর শ্রেষ্ঠ কবির আসন অলঙ্কৃত করেছেন।