নবকুমারের জননী সমালোচ্য নাটকটিতে রক্তমাংসের স্বাভাবিক রমণী, তিনি স্নেহশীলা জননীরূপেই চিত্রিতা। রক্ষণশীলা এই নারী উচ্চ-মধ্যবিত্ত সংসারের গৃহকর্ত্রী রূপেই আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছেন। কন্যা, পুত্রবধূ, চাকর-চাকরানীরা তাঁকে যুগপৎ ভয় ও ভক্তি করে, মেয়েদের গল্পগুজব আলস্যতা বা তাসখেলা তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। গৃহকর্ত্রী আসছে দেখে মেয়েরা সঙ্গে সঙ্গে তাস লুকিয়ে রেখে নবকুমারের বিছানা তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিছানা করতে দেরি হওয়ায় তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং ‘কালিকালের মেয়ে’ বলে ঈষৎ ভৎসনাও করেছেন।

গৃহিণী চরিত্রের যে দিকটি বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল নবকুমারের প্রতি তাঁর অগাধ স্নেহ। তাঁর পুত্র যে লম্পট, মাতাল, সে যে অধঃপতনের শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে, পুত্র স্নেহাতুর মাতা সে সংবাদ রাখেন না। বিবাহিত পুত্র তার কাছে এখনও ‘খোকা’, রূপেই বিরাজিত। ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা থেকে মাতাল অবস্থায় বাড়িতে ফিরে এসে নবকুমার বমি করতে শুরু করলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন- “আমার দুধের বাছাকে কি কেউ বিষ টিষ খাইয়ে দিয়েছে নাকি ?” তাঁর ‘সোনার চাঁদ’ ছেলে মদ খেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে দেখে তিনি আর্তনাদ করে উঠেছেন। তাঁর ছেলে যে মদ খেয়ে বেলেল্লাপনা করছে সে কথা বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধি তাঁর নেই। কর্তা এসে যখন পুত্রের কুকীর্তির কথা বলেছেন তখনও তিনি তা বিশ্বাস করেন নি, উলটে কর্তার বয়সের প্রতি কটাক্ষপাত করে বলেছেন যে, যেহেতু তাঁর বয়েস হয়েছে সেহেতু তার মধ্যে পাগলামির লক্ষণ ফুটে উঠেছে।

পুত্রস্নেহে যিনি একেবারেই অন্ধ, পুত্রের দোষ ত্রুটি তাঁর কাছে ধরা পড়বে কেমন করে? তাই যে পুত্র পিতার কাছে বংশের কুলাঙ্গার ও নরাধম বলে বিবেচিত হয়, সেই পুত্রই মাতার কাছে হয়ে দাঁড়ায় কখনও ‘দুধের বাছা’ কখনও ‘সোনার চাঁদ’। পুত্রের জন্য স্নেহময়ী মাতার উদ্বেগ আকুলতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, সামান্যতম বাস্তব বুদ্ধিও তাঁর ছিল না। আর সেইসঙ্গে এটাও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে, মাতার অত্যধিক স্নেহাধিক্যই নবকুমারের অধঃপতনে যাওয়ার পথকে ত্বরান্বিত করেছিল।