ডিহিদার মামুদ সরীফের অত্যাচারের মধ্য দিয়ে কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী সামস্ততান্ত্রিক পরিবেশে কৃষকপ্রজার দুর্দশার চিত্র প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই অপব্যবস্থার শিকার হ’য়ে কবি মুকুন্দকেও সাত পুরুষের ভিটে ত্যাগ করে অনির্দেশের পথে পাড়ি জমাতে হয়েছিল। অব্যবস্থার স্বরূপ তিনি নিজে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই কবির পক্ষে একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থার কল্পনা করা সম্ভবপর হ’য়েছিল। কালকেতু দেবী চণ্ডীর সহায়তায় যখন গুজরাট নগর পত্তন করে, তখন কবি সেই আদর্শ সমাজব্যবস্থার স্বরূপই সেখানে উদ্ঘাটন করতে সচেষ্ট হ’য়েছিলেন। সামস্ততান্ত্রিক পরিবেশেও যে মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দে বসবাস করতে পারে, তা দেখানোই সম্ভবত কবির অভিপ্রায় ছিল- আর তৎকালে সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কোনো বিকল্প ছিল না।
সমগ্র দেশ-বিষয়ে কোনো অখণ্ড জাতীয়তাবোধ সেকালে গড়ে ওঠা সম্ভবপর ছিল না। সমগ্র দেশের মাথায় একজন রাজা বা বাদশা এবং তার অধীনে কয়েকজন সামস্ত নরপতি বা সুবেদার থাকলেও তদধীন ভূস্বামীরা স্ব স্ব অঞ্চলকে প্রায় স্বাধীনভাবেই শাসন করতেন। ফলত প্রত্যেকটি অঞ্চলই ছিল প্রায় স্বয়ংত্তর। অঞ্চলের যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সেই সেই অঞ্চলেই উৎপন্ন হ’ত এবং প্রতি অঞ্চলেই সর্বজাতীয় বৃত্তিজীবী এবং ব্যবসায়ীদের বসবাসের ব্যবস্থা করা হতো। কোনো প্রয়োজনেই কাউকে বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হত না, প্রত্যেকটি অঞ্চল ছিল আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ। তাই সাধারণ রাষ্ট্রনৈতিক বিপর্যয়ও তাদের স্পর্শ করতো না। কিন্তু মুকুন্দ একটি রাজনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিলেন বলেই এমন একটি আদর্শ সমাজের চিন্তা মাথায় রেখেছিলেন, যেখানে কোন প্রজা কোন কারণেই বিপর্যস্ত হবে না। কালকেতু যে গুজরাট নগর পত্তন করেছিল, সেখানে এই আদর্শই অনুসৃত হয়েছিল বলে আমরা দেখতে পাই।
দেবী চণ্ডীর কাছ থেকে মাণিক্যের অঙ্গুরী এবং সাত ঘড়া ধন পেয়ে কালকেতু প্রথমেই বিরুনিয়া বা জঙ্গল কাটার লোকদের আহ্বান জানালো। বিরুনিয়ারা জঙ্গল কাটতে গেলে বাঘের উপদ্রব শুরু হ’ল। কালকেতু বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করলো। অতঃপর নিরুপদ্রবে। সমস্ত গাছ কেটে জঙ্গল হাসিল করলো। এবার নগর-নির্মাণের পালা।
কালকেতু ভগবতীর স্তবস্তুতি করলে দেবী বিশ্বকর্মাকে পাঠালেন নগর নির্মাণ করতে। বিশ্বকর্মা হনুমানের সহায়তায় বীরের পুরী এবং চণ্ডীর দেউল নির্মাণ করলেন। এগুলিকে চিত্রের সাহায্যে সজ্জিত করা হ’ল। এ ছাড়াও তৈরি হ’ল বিষ্ণুর মন্দির, শিবমন্দির, দোলমঞ্চ, মসজিদ প্রভৃতি এবং কাটানো হ’ল অসংখ্য পুকুর ও কৃপ। কিন্তু এতে কালকেতুর দুঃখ ঘুচলো না কারণ নগর পত্তন হ’ল, কিন্তু কোনো প্ৰজা এখানে বসতি স্থাপন করতে চাইলো না। তখন কালকেতু আবার দেবী চণ্ডীকে স্মরণ করলো। চণ্ডী পদ্মাবতীর সঙ্গে পরামর্শ ক’রে স্থির করলেন যে কলিঙ্গে ঝড়বৃষ্টি ও বন্যা সৃষ্টি ক’রে তথাকার প্রজাদের গুজরাটে আনার ব্যবস্থা করতে হ’বে। এই উদ্দেশ্যে চণ্ডী গেলেন গঙ্গার কাছে সহায়তার জন্য। কিন্তু গঙ্গা গালমন্দ ক’রে চণ্ডীকে তাড়িয়ে দিলে চণ্ডী সমুদ্র ও ইন্দ্রের সহায়তা চাইলেন। তারা কলিঙ্গে প্রবল ঝড় বৃষ্টি ও বন্যার সৃষ্টি করলেন। ফলে প্রজা সাধারণ অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। জমির ফসল গেলো, গোলার ধান গেলো, ঘর-বাড়িও সব ভেসে গেলো। এই অবস্থায় প্রজারা বুলান মণ্ডলের পরামর্শ চাইলো।
দেবী চণ্ডী বুলান মণ্ডলকে আগেই স্বপ্নে দেখা দিয়ে গুজরাট নগরে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে আদেশ করেছিলেন। এবার প্রজাদের কাছে বুলান মণ্ডল বল্লো যে এখানে থাকলে আরও দুঃখ পেতে হবে। কারণ—
‘মসীল করিবে রাজা দিয়া হাতে দড়ি।
প্রথম মাসেতে চাই এক তেহাই কড়ি।।’
অতএব বুলান তাদেরও উৎসাহিত করলো গুজরাট যেতে। সেখানে কালকেতু অনেক সুযোগ-সুবিধে দেবে। ভাড়ুদত্ত নামে এক স্বয়ংসিদ্ধ নেতা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে তারি পরিচালনায় কলিঙ্গের প্রজারা ওজরাটে উপনীত হ’ল। কালকেতু পরম সমাদরে তাদের গ্রহণ করলো এবং নানাপ্রকার সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করলো—
‘আমার নগরে বৈস যত ইচ্ছা চাষ চষ
তিন সন বহি দিহ কর।।
হাল প্রতি দিবে তত্ত্বা কারে না করিহ শঙ্কা
পাট্টায় নিশান মোর ধর।।
নাহিক বাউড়ি দেড়ি রয়্যা বস্যা দিবে কড়ি
ডিহিদার নাহি দিব দেশে।।
সেলামি বাঁশগাড়ি নানা বাবে যত কড়ি
নাহি নিব গুজরাট বাসে।।’
ডিহিদার মামুদ সরীফের যে অত্যাচারে বিপর্যস্ত বহু প্রজা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল, এমন কি স্বয়ং মুকুন্দ চক্রবর্তীকেও উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল, এখানে যে সেরকম কোনো অত্যাচার হবে না, কালকেতু প্রথমেই প্রজাদের সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশ্বস্ত করেছেন।
এইবার কলিঙ্গ ছেড়ে প্রজাদের আগমন ঘটতে লাগলো। এলো নানা জাতির মুসলমান, তাদের জন্য কালকেতু নগরের পশ্চিমভাগে বসতির ব্যবস্থা করলো। মুসলমানদের মধ্যে আছে নানাপ্রকার বৃত্তিজীবী—গোলা, জোলা, মুকেরি পিঠারি, কাবাড়ি, গরসাল, সানাকার, হাজাম, ভীরকর, কাগজী, কলন্দর, দেশাধি, দরজি, রংরেজ, কসাই প্রভৃতি। এলো বিভিন্ন গোত্র গাঞি পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর ব্রাহ্মাণ—তাদের মধ্যে আছেন পণ্ডিত ও মূর্খ, যাজক ও অধ্যাপক, বারেন্দ্র ও রাঢ়ী, গ্রহবিপ্র ও বৈষ্ণব প্রভৃতি। এলো ক্ষত্রিয়াদি নানা জাতি– চন্দ্রবংশী, সূর্যবংশী, রাজপুত, মল্লযোদ্ধা এলো ভাট, বৈশ মহাজন, বৈদ্য, অগ্রদানী, নানা উপাধিধারী কায়স্থগণ। এরা ছাড়াও এলো নানাজাতীয় হিন্দু, তাদের বৃত্তি ব্যবসায় পৃথক পৃথক। এদের মধ্যে আছে— গোপ, তেলী, চাষী, কামার, তাম্বুলী, কুম্ভকার তাবায়, মালী, বারুই, নাপিত, আগুরি, মোদক, সরাফ, গন্ধবেশে, শঙ্খবেণে, কাসারি, সুবর্ণবণিক প্রভৃতি নবশাখ সম্প্রদায়ের লোক নিম্নজাতি হিন্দুও এলো দাস, কলু, বাইতি, মাজুরি, বাগদী, মেছো, ধোপা, দরজি, শিউলি, ছুতার, পাটনি, চুনারি, চণ্ডাল, কয়ালি, কিরাত, হাড়ি, পুঁড়ি প্রভৃতি। এই সব জাতীয় প্রজার আগমনে গুজরাট নগর স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠলো।
যতপ্রকার লোকের আগমনে একটা রাজ্য অপরের ওপর নির্ভর না ক’রে আত্মম্ভর হ’য়ে উঠতে পারে, কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর কল্পনামতে তাদের সকলের বসতির ব্যবস্থা করা হ’য়েছিল ওজরাট নগরে। এই নগর পত্তন থেকে সমাজ-সচেতনতাবোধের একটি প্রকৃত প্রমাণ পাওয়া যায়।
ডিহিদার মামুদ সরীপ ধর্মে মুসলমান হ’লেও কবি মুকুন্দ কিন্তু জাতিগতভাবে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন না। তার মনোভাব ছিল একান্ত অসাম্প্রদায়িক, এই কারণে তার কল্পিত আদর্শ রাজ্যে নানা জাতীয় মুসলমানকে সাগ্রহে স্থান দান করেছেন। এদের অনেকের সম্বন্ধে কবি সশ্রদ্ধ উক্তিও করেছেন—
‘বড়ই দানিসবন্দ না জানে কপট ছন্
প্রাণ গেলে রোজা নাহি ছাড়ে।’
অতএব গুজরাট নগর পত্তনের যে আদর্শ কল্পনা করেছিলেন, তাতে তার সমাজসচেতন ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়।
Leave a comment