সঙ্গীতধর্মিতা, সংক্ষিপ্ত, গাঢ়বদ্ধ রূপ, ছন্দের সংহতি, মন্ময়তা (subjectivity), আবেগ, চিত্রকল্পের সুনির্দিষ্টতা ইত্যাদি গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্যরূপে নির্দেশিত হয়ে থাকে। কেউ কেউ রূপগত সংক্ষিপ্ততাকেই গীতিকবিতার সব থেকে প্রধান বৈশিষ্ট্যরূপে নির্দেশ করেছেন, যেমন, এডগার অ্যালান পো। কিন্তু গীতিকবিতা সব সময়েই ক্ষুদ্র কবিতার রূপে আবদ্ধ থাকতে চায় নি। অনেক সময় কাব্যে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত দীর্ঘ কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য ব্যক্তিহৃদয়ের আবেগময়তা ও সঙ্গীতধর্মিতায় প্রকাশিত হয়েছে। গীতিকাব্যও সঙ্গীতধর্মী, কবির ভাবনাচিন্তা, আবেগ-অনুভূতি, কল্পনা যখন প্রত্যক্ষভাবে কিংবা কোনও কাহিনীর আশ্রয়ে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়ে গীতিধর্ম ও অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ রচনারূপে প্রকাশিত হয়, তখনই আমরা গীতিকবিতার উদাহরণ পাই। যেমন, সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ কবি মিল্টনের L’Allegro বা প্রসন্ন ও II Penseroso বা গম্ভীর কবিতা দুটি ; প্রথমটি প্রসন্ন প্রকৃতির যুবক ও দ্বিতীয়টি গম্ভীর প্রকৃতি যুবকের মনের ও দিনযাত্রার বিভিন্ন চিত্র। প্রথম কবিতাটিতে পাই প্রকৃতির অপূর্ব বর্ণনা, রক্তবর্ণময় সূর্যোদয় থেকে আরম্ভ করে গোধূলি পর্যন্ত প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ। দ্বিতীয়টিতে দেখি, বিষণ্ণ ও গম্ভীর মানুষ রাত্রির অন্ধকারে নাইটিঙ্গেলের গান শোনে, চাঁদের আলো উপভোগ করে এবং কবিতা বা দর্শন পাঠে সময় কাটায়। আমরা লক্ষ্য করি, প্রসন্নও কিছুটা পরিমাণে গম্ভীর, আর উল্লাসে গম্ভীর কুণ্ঠিত। এই প্রবণতা মিল্টনের ব্যক্তিমানসেরই প্রতিফলন, স্বচ্ছন্দ জীবনধর্ম অপেক্ষা সংযত জীবনযাত্রায় তাঁর অবিচল বিশ্বাস।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের ইংরেজ কবি ব্লেকের Songs of Innocence খন্ড খন্ড কবিতার সংকলন হলেও কবির শিশুতীর্থের উদ্দেশ্যে যাত্রার কেন্দ্রীয় সূত্রে কবিতাগুলি গাথা হয়েছে বলে গীতিকাব্যরূপেই গ্রহণীয়। ওয়ার্ডসওয়ার্থের The Prelude ও দীর্ঘ গীতিকবিতা, দশ বছর বয়েস থেকেই প্রকৃতি তাঁর জীবনের সঙ্গে কি ভাবে জড়িত হয়ে গিয়েছিল, এই রচনায় কবি তার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। কবির আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনের আদর্শ, আধ্যাত্মিকতা—এসবই এই কবিতায় রূপায়িত হয়েছে। বায়রনের Childe Harold Pilgrimage ও গীতিকাব্যের উদাহরণ। নায়ক চাইল্ড হ্যারল্ড-এর ব্যর্থতা ও হতাশা, নিঃসঙ্গতার গভীর বিষাদ ও প্রকৃতির মধ্যে আশ্রয় সন্ধান বায়রনের মানসের প্রতিফলন। শেলীর Queen Mab, Alastor, Prometheus Unbound ও Episychidion দীর্ঘ গীতিকবিতা। কীটস-এর Endymeon ও Hyperion ইংরেজি কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় গীতিকাব্যের উদাহরণ।
বাঙলা কাব্যসাহিত্যে ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় ও সনেটে মধুসূদন ব্যক্তি-হৃদয়ের ভাবানুভূতিকে রূপ দিয়ে গীতিকবিতার সূত্রপাত করেছিলেন। কিন্তু গীতিকবিতাকে তিনি তাঁর কাব্যসাধনার একমাত্র মাধ্যম রূপে গ্রহণ করেন নি। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনও গীতিকবিতা লিখেছেন, কিন্তু হেমচন্দ্রের কল্পনায় বহিমুখিতা ও প্রকাশভঙ্গিতে মহাকাব্যোচিত আলংকারিক রীতির অনুসরণ এবং নবীনচন্দ্রের কল্পনা ও আবেগের অসংযম এক্ষেত্রে সাফল্যের বড় বাধা ছিল। বিহারীলাল চক্রবর্তীই প্রথম গীতিকবিতাকে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমরূপে গ্রহণ করে বাঙলা কাব্যসাহিত্যে আধুনিক গীতিকবিতার দিগন্তকে উন্মোচিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সমকালীন বাঙলা কবিতার পটভূমিতে এইভাবে বিহারীলালের রচনার বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেছেন—”বিহারীলাল তখনকার ইংরেজি ভাষায় নব্যশিক্ষিত কবিদিগের ন্যায় যুদ্ধ-বর্ণনা-সংকুল মহাকাব্য, উদ্দীপনাপূর্ণ দেশানুরাগমূলক কবিতা লিখিলেন না, এবং পুরাতন কবিদিগের ন্যায় পৌরাণিক উপাখ্যানের দিকেও গেলেন না তিনি নিভৃতে বসিয়া নিজের ছন্দে নিজের মনের কথা বলিলেন। তাঁহার সেই স্বগত-উক্তিতে বিশ্বহিত অথবা সভামনোরঞ্জনের কোন উদ্দেশ্য দেখা গেল না। এইজন্য তাঁহার সুর অন্তরঙ্গরূপে হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া সহজেই পাঠকের বিশ্বাস আকর্ষণ করিয়া আনিল।”
প্রাচীন বাঙলা গীতিকবিতায় কবিদের ব্যক্তিহৃদয় পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত হয় নি। বৈষুব গীতিকবিতা রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে রূপক হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। সেই যুগের কাব্যের অন্যান্য শাখার মত কবিতাও ছিল ধর্মজীবনের অঙ্গ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইয়োরোপীয় সভ্যতার প্রভাবে বাঙলায় নতুন মানবিক মূল্যবোধ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিকাশ ঘটে এবং আধুনিক গীতিকবিতা রচনায় উপযুক্ত পটভূমি তৈরি হয়। বিহারীলালই সর্বপ্রথম নিজের কল্পনা ও অনুভূতির জগতের ওপর নির্ভর করে প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কে তাঁর কবিহৃদয়ের ব্যাকুলতা, অনুভূতির বৈচিত্র্য ও জগতের রহস্য সম্বন্ধে বিস্ময়মুগ্ধ মনোভাব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন। আত্মমগ্ন রোমান্টিক কবি বিহারীলাল যে আত্মগত ভাবনার সুর সৃষ্টি করেছিলেন, পরবর্তী কালে তারই বিস্তার ও বৈচিত্র্য দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘকালব্যাপী কাব্যসাধনায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যসাধনার পূর্বসূরী সম্পর্কে বলেছেন— “সে প্রত্যূষে অধিক লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্জে বিচিত্র কলগীত কুজিত হইয়া উঠে নাই, সেই ঊষাকালে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুরে গান ধরিয়াছিল। সে সুর তাহার নিজের। ঠিক ইতিহাসের কথা বলিতে পারি না—কিন্তু আমি সেই প্রথম বাঙলা কবিতায় কবির নিজের সুর শুনিলাম।”
‘বঙ্গসুন্দরী’, ‘নিসর্গ-সন্দৰ্শন’, ‘বন্ধুবিয়োগ’, প্রেমপ্ৰবাহিণী’, ‘সারদামঙ্গল’ ও ‘সাধের আসন’ বিহারীলালের প্রধান গীতিকাব্যগ্রন্থ। প্রথমদিকের রচনাগুলির প্রকৃতি-বর্ণনা, নারীবন্দনা বা বন্ধু-বিয়োগের বেদনার ভিত্তি কবির ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা। ‘বন্ধুবিয়োগে’ কবির এই স্মৃতিচারণা হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত প্রীতি, মমতা ও বিষাদে আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে—
চীনের বাদাম কিনে মাঝখানে ধোরে,
খেতেম সকলে মিলে কাড়াকাড়ি কোরে।
হেসে খেলে কোথা দিয়ে কেটে যেতো দিন,
সে দিন কি দিন হায়। এদিন কি দিন!
‘প্রেমপ্রবাহিণী’তে বাস্তব সংসারের অপূর্ণতায় পীড়িত কবিহৃদয়ের বেদনা প্রকাশিত হয়েছে—
‘ক্রমে ক্রমে নিবিতেছে লোক কোলাহল,
ললিত বাঁশরী তান উঠিছে কেবল।
মন যেন মজিছে অমৃত সাগরে,
দেহ যেন উড়িতেছে সমাবেগ-ভরে।
অবশ্য প্রথমদিকের কাব্যগ্রন্থগুলির বাণীবন্ধন শিথিল, অসংহত, কবির হৃদয়োচ্ছ্বাসও অসংযত। তবু ভাব ও ভাষার সারল্যে, ব্যক্তিহৃদয়ের অকুণ্ঠিত প্রকাশে এই কবিতাগুলি হৃদয়স্পর্শী।
পাঁচ সর্গে বিভক্ত বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘সারদামঙ্গল’-এ কাব্যলক্ষ্মী সারদার সঙ্গে কবির মিলন বিরহের লীলা চিত্রিত হয়েছে। সারদার রূপকল্পনায় কবির সৌন্দর্য চেতনার সঙ্গে ‘বিরহিত-মৈত্রী-প্রীতি’র করুণা মিশ্রিত হয়ে সারদাকে এক বিষাদময়ী করুণা-ঘন অপূর্ব সৌন্দর্য প্রতিমায় পরিণত করেছে। সারদার মূর্তি ধ্যান এই কাব্যের কেন্দ্রীয় বিষয়, তার টানে কবির কল্পনা অনেকটা পরিমাণেই সংহতি লাভ করেছে। ‘বন্ধুবিয়োগ’ ‘বঙ্গসুন্দরী’ ও ‘নিসর্গ সন্দর্শন’-এ মানব সংসারের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার এবং বিশ্বচরাচরের সৌন্দর্যের প্রতি কবিহৃদয়ের যে আকর্ষণের পরিচয় মেলে, তারই পূর্ণ পরিণতি উদ্ভাসিত ‘সারদামঙ্গলে’। কবির কল্পনা বিশ্বের বিচিত্র রূপের অন্তরালে এক অখন্ড পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের বিগ্রহ—কবির সৌন্দর্য ভাবনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে প্রেম, প্রীতি ও করুণা। কবিহৃদয়ের সৌন্দর্যচেতনা ও প্রেমানুভূতি অখন্ড কল্পনায় পরিণত হয়ে সারদার করুণা-বিগলিত সৌন্দর্যে মূর্তিলাভ করেছে। সারদা বিশ্বের সৌন্দর্য-রূপিণী—
তুমিই বিশ্বের আলো তুমি বিশ্বরূপিণী।
প্রত্যক্ষে বিরাজমান,
সর্বভূতে অধিষ্ঠান,
তুমি বিশ্বময়ী কান্তি, দীপ্তি অনুপমা ;
কবির যোগীর ধ্যান,
ভোলা প্রেমিকের প্রাণ,
মানবমনের তুমি উদার সুষমা।
‘সাধের আসন’ ‘সারদামঙ্গল’-এ পরিপূরক কাব্য, এই রচনায় বিহারীলাল নিজ সৌন্দর্য-চেতনার তত্ত্ব দশটি সর্গে বিশদভাবে উপস্থাপিত করেছেন।
মোহিতলাল মজুমদার বিহারীলালের কাব্যের গীতিধর্মিতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন— “……বিহারীলালের কাব্যে প্রকৃত কাব্যসৃষ্টি অপেক্ষা কবির নিজ প্রাণের পরিচয়ই বিশেষ করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। তাঁহার ‘বাউল বিংশতি’, ‘সঙ্গীত-শতক’ প্রভৃতি কাব্য পাঠ করিলেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন এই কবির কাব্যসাধনার প্রধান লক্ষণ কি। বিহারীলালের কাব্য যেন আদি লিরিক জাতীয়, তাহার প্রেরণা একেবারে গীতাত্মক। বাহিরের বস্তুকে, গীতি-কবি নিজস্ব ভাব-কল্পনায় মন্ডিত করিয়া যে একটি বিশেষ রূপ ও রসের সৃষ্টি করেন, ইহা তাহা হইতে ভিন্ন, কবি নিজের আনন্দে ধ্যান-কল্পনার আবেশে, সর্বত্র নিছক ভাবের সাধনা করিয়াছেন; তাঁর কাব্যের প্রধান লক্ষণ ভাববিভোরতা। তাঁহার কল্পনা অতিমাত্রায় Subjective; তিনি যখন গান করেন, তখন সম্মুখে শ্রোতা আছে এমন কথাও ভাবেন না, ভাবকে স্পষ্ট রূপ দিরার আকাঙ্ক্ষাই তাহার নাই। কিন্তু এই আত্মনিমগ্ন কবির স্বতঃ-উৎসারিত গীতধারায় এমন সকল বাণী নিঃসৃত হয়, যাহাতে সন্দেহ থাকে না যে তাঁহার মনোভৃঙ্গ সরস্বতীর আসন-কমলের মর্মমধু পান করিয়াছে। সেই পদ্মের পরাগ-ধূলি সর্বাঙ্গে মাখিয়া কবিজীবন সার্থক করিয়াছে।”
Leave a comment