বাঙলাদেশে আধুনিক অভিনয়-কলার সূচনা হয়েছিল অভিজাত পরিবারকেন্দ্রিক শৌখিন নাট্যচর্চায়। শখের থিয়েটারের অভিনয় দেখা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। মধুসূদন পর্যন্ত এইসব শখের থিয়েটারই নাটক রচনায় সাহিত্যিকদের একমাত্র প্রেরণা ছিল। দীনবন্ধু নতুন ধরনের সামাজিক নাটক রচনা করে অপেক্ষাকৃত অল্প খরচে অভিনয় অনুষ্ঠানের সুযােগ করে দিলেন। দীনবন্ধুর রচনাবলী নিয়ে কলিকাতার মধ্যবিত্ত যুবকদের মধ্যে নতুনভাবে নাট্য আন্দোলন গড়ে উঠল। পাড়ায় পাড়ায় অস্থায়ী রঙ্গমঞ্চ বেঁধে দীনবন্ধুর নাটকগুলি বহুবার অভিনয় করা হয়েছে। তার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে অভিনয় কলা-সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণ রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে কয়েকজন উদ্যোগী অভিনয় কলারসিক যুবকের চেষ্টায় বাঙলার প্রথম জাতীয় রঙ্গালয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের মধ্যে গিরিশচন্দ্র ঘােষ (১৮৪৪-১৯১১) ছিলেন সর্বাপেক্ষা প্রতিভাশালী পুরুষ। প্রথমদিকে সহযােগীদের সঙ্গে মনােমালিন্যের জন্য দূরে সরে থাকলেও কিছুদিনের মধ্যে তিনিই জাতীয় রঙ্গমঞ্চ এবং নতুন নাট্য- আন্দোলনের প্রধান নায়ক হয়ে ওঠেন। বাঙলাদেশের কলারসিকদের বিচারে আজ পর্যন্ত গিরিশচন্দ্রের তুল্য প্রতিভাসম্পন্ন নট এবং নাট্য-পরিচালক এদেশে আবির্ভূত হন নি। স্বয়ং আচার্য শিশিরকুমারও এইরুপ ধারণা পােষণ করতেন। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে রঙ্গমঞ্চ পরিচালনা করে গিরিশচন্দ্র জীবনের সবটুকু সময় রঙ্গমঞ্চের উন্নতির জন্য এবং অভিনয়-কলা-চর্চায় নিয়ােজিত করে গিয়েছেন। সে যুগের প্রায় সকল খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী গিরিশচন্দ্রের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে তাঁরই অভিভাবকত্বে শিল্পীজীবন অতিবাহিত করেছে। শিল্পকলার একটি নতুন এবং শক্তিশালী শাখা নাটককে স্থায়িভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা গিরিশচন্দ্রের এক ঐতিহাসিক কীর্তি। আমাদের নাটকের ইতিহাসে, রঙ্গালয়ের ইতিহাসে এবং অভিনয়-কলার ইতিহাসে গিরিশচন্দ্র এক মহৎ মর্যাদার অধিকারী। এইদিক থেকে রঙ্গালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত আর কারও সঙ্গে তার ব্যক্তিত্বের তুলনা চলে না। বিভিন্ন নাটকে তার অভিনয়ের কথা এবং বিভিন্ন চরিত্রাভিনয়ে তার বৈশিষ্ট্যের কথা বাঙলাদেশে লােকশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে।

নিত্যনতুন নাটক অভিনয়ের দ্বারা রঙ্গমঞ্চের প্রতি মানুষের আগ্রহ সজাগ রাখবার জন্য গিরিশচন্দ্রকে নিয়মিত নাটক রচনা করতে হত। এইভাবে সারাজীবনে তিনি নাটক প্রহসন মিলিয়ে প্রায় শত-সংখ্যক নাট্যগ্রন্থ রচনা করেন। গিরিশচন্দ্রের প্রথমদিকের রচনার মধ্যে ‘আগমনী’ (১৮৭৭), ‘অকালবােধন’ (১৮৭৭), ‘দোললীলা’ প্রভৃতি গীতিনাট্য উল্লেখযােগ্য। গীতিনাট্যগুলি দর্শকদের মনােরঞ্জন করতাে কিন্তু তাদের সাহিত্যিক মূল্য নিতান্তই নগণ্য। নাট্যকাররূপে গিরিশচন্দ্র প্রভূত খ্যাতিলাভ করেন ‘অভিমন্যু বধ’ (১৮৮১), ‘জনা’ (১৮৯৪), ‘পাণ্ডব-গৌরব’ (১৯০০) প্রভৃতি পৌরাণিক নাটকে। এইসব নাটকের ভক্তিরস এবং আদর্শ চরিত্র-চিত্র সহজেই জনচিত্ত হরণ করেছিল। বাঙলাদেশের জনমানসে পৌরাণিক কাহিনীর অলৌকিক মহাপুরুষ এবং দেবদেবীর আখ্যান, তার অন্তর্নিহিত ভক্তিভাবের ধারা এবং নিয়তিবাদ একটা স্থায়ী সংস্কাররূপে বিদ্যমান। রঙ্গমঞ্চের সূচনার পূর্বে যাত্রা-অভিনয়ে এই পৌরাণিক কাহিনীগুলিই নাট্যবিষয়রূপে ব্যবহৃত হত। গিরিশচন্দ্রের আগে মনােমােহন বসু যাত্রা ধরনের ‘গীতাভিনয়ে’ রঙ্গমঞ্চে ভক্তিরসের ধারা প্রবাহিত করেন।

গিরিশচন্দ্র রঙ্গমঞ্চের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়াবার উদ্দেশ্যে এই সহজ পন্থাটি অনুসরণ করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্য গিরিশচন্দ্রের মানসিক-গঠনে অধ্যাত্মবােধ একটি প্রধান উপকরণ ছিল। তার পৌরাণিক নাটকে এই অধ্যাত্মবােধ উচ্ছসিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মনীষীবৃন্দের যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে অলৌকিক বিশ্বাস অনেক পরিমাণে শিথিল হয়েছিল, কিন্তু গিরিশচন্দ্র সেই প্রগতিশীল চিন্তাধারার তাৎপর্য সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন নি। তিনি পৌরাণিক নাটকের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় সংস্কার এবং ধ্যানধারণাকে নতুনভাবে জনমানসে সঞ্চারিত করেছেন। “অবশ্য আধুনিক বিচারের মানদণ্ডে এগুলি সম্পূর্ণ নাটক নহে, নাটকাকারে সংরক্ষিত অলৌকিক রসের আত্মবিস্তার ও যথাসম্ভব গাঢ় পরিণতি মাত্র। যেখানে দেব-মহিমা ও ভক্তের আত্মনিবেদনই নাটকের উপাদান, সেখানে জাগতিক নিয়ম বা কার্যকারণ শৃঙ্খলার বিশেষ কোন গুরুত্ব কিছুটা নাটকীয় উত্তাপ সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু ইহাদের পিছনে সদা-সক্রিয় যে দৈবলীলা সমস্ত ঘটনার রশ্মি ধারণ করিয়া আছে তাহারই অপ্রতিহত প্রভাবে মানসিক দ্বন্দ্বের উত্তেজনা মুহূর্তে স্তিমিত হইয়া পড়ে। তথাপি এই জাতীয় নাটকই বাঙালীর সার্থকতম, তাহার মনােধর্মের সহিত ঘনিষ্ঠতম সম্পর্কন্বিত নাট্যরস বিকাশের দৃষ্টান্ত।” (ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)।

আধুনিক দৃষ্টিতে গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটকগুলির ত্রুটি-বিচ্যুতি যত গুরুতর বলেই মনে হােক, নাটকের এই শাখায়ই তার নাট্য-প্রতিভার উন্মেষ ও পরিণতি হয়েছে এবং তিনি সর্বাধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সামাজিক বা ঐতিহাসিক নাটকে তাঁর প্রতিভা বিকাশের স্বাভাবিক ক্ষেত্রটি পায় নি। তিনি নিজেই তার পৌরাণিক নাটক নিবন্ধে বলেছেন : “হিন্দুস্তানের মর্মে ধর্ম, মর্মাশ্রয় করিয়া নাটক লিখিতে হইলে ধর্মাশ্রয় করিতে হইবে।”

গিরিশচন্দ্রের কালে বাঙলাদেশে হিন্দুধর্মপ্রধান জাতীয়তাবাদ প্রবল হয়ে উঠেছিল। জনসাধারণের মন তখন হিন্দুধর্ম ও পুরাণ এবং পৌরাণিক কাহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। গিরিশচন্দ্র তাহার দেশবাসীদের সেই প্রবণতাকে নিজের সহজাত চেতনায় উলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ‘রাবণ বধ’ (১৮৮১), ‘সীতার বনবাস’ (১৮৮২) প্রভৃতি নাটকে গিরিশচন্দ্র কৃত্তিবাসকে অনুসরণ করেছিলেন। ‘অভিমন্যু বধ’ (১৮৮২) তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পৌরাণিক নাটক, বীররস ও করুণরসের স্মরণে নাটকটি বিশিষ্ট।

‘বিল্বমঙ্গল’ (১৮৮৮) গিরিশচন্দ্রের ভক্তিরসপ্রধান পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় হয়েছিল। নাটকটির মধ্যে রামকৃষ্ণদেবের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট, তবে তার নাট্যগুণ বিশেষ কিছু নেই। গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে ‘জনাই সর্বশ্রেষ্ঠ। জনা ও প্রবীর চরিত্র অবলম্বনে নাট্যকার জীবনের বাস্তব আবেগ ও ঘাত প্রতিঘাতসঞ্জাত লৌকিক নাট্যরস সৃষ্টি করেছেন, বীরধর্ম, স্বাদেশিকতা, মাতৃভক্তি, প্রেমমােহ প্রভৃতি বিচিত্র গুণের সমাবেশে প্রবীর চরিত্রটি লৌকিক রসের আধাররূপে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অন্যদিকে তিনি নীলধ্বজ, বিদূষক, অগ্নি, বৃষকেতু প্রভৃতির মধ্য দিয়ে অলৌকিক ভক্তিরস নাটকের মধ্যে প্রবাহিত করেছেন। জনা তার প্রতিহিংসা জ্বালা নিয়ে নাটকের মধ্যে বহ্নিশিখার মতই দীপ্ত। প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, অন্তর্দ্বন্দ্ব, গভীর বেদনা ও অনির্বাণ প্রতিহিংসা জনাকে ট্র্যাজিক চরিত্রে পরিণত করেছে। গিরিশচন্দ্রের বিশেষ দান গৈরিশ ছন্দের কথাও স্মরণীয়। তার পূর্বে কালীপ্রসন্ন ‘হুতােম প্যাঁচার নকশা’য়, ব্রজমােহন রায় ‘দানবিজয়’ এবং রাজকৃষ্ণ রায় তাঁর কাব্যে এই ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন। গিরিশচন্দ্র তার সংস্কার করে তাকে নাট্যোপযােগী করে তােলেন। দীনবন্ধু-ব্যবহৃত পয়ার ও মধুসূদন-প্রবর্তিত অমিত্রাক্ষর ছন্দ নাটকের উপযােগী নয়। কিন্তু গৈরিশ ছন্দে নাট্যক্রিয়া ও চরিত্রচিত্রণ গতিশীলতা লাভ করে গিরিশচন্দ্রের এই নাটকীয় ছন্দের জন্যই তার পৌরাণিক নাটকগুলি একঘেয়েমি থেকে মুক্ত হতে পেরেছে।

তৃতীয় পর্বে গিরিশচন্দ্র কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের জন্য স্বাদেশিকতার ভাবধারায় তখন দেশের চিত্ত প্রবলভাবে আলােড়িত হচ্ছিল। রঙ্গমঞ্চে খুব স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব দেখা যায়। দেশাত্মবােধ এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করার উদ্দীপনা-সঞ্চারের দিক থেকে গিরিশচন্দ্রের ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যে ‘সিরাজদ্দৌলা’ (১৯০৬), ‘মীরকাশিম’ (১৯০৬) এবং ‘ছত্রপতি শিবাজী’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ঐতিহাসিক-বিষয়াশ্রিত রচনার শিল্পগত উৎকর্ষের বিচার করতে গেলে দেখতে হয় লেখক রচনায় সামগ্রিকভাবে ইতিহাস রস’ সৃষ্টিতে কতটা সফল হয়েছেন। গিরিশচন্দ্র এইসব নাটকে এক একটি ঐতিহাসিক যুগের সমুন্নত মহিমা পরিস্ফুট করে তুলতে আদৌ সচেষ্ট ছিলেন বলেই মনে হয় না। তিনি প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু ঘটনাধারার যুক্তিক্রমটি আবিষ্কার করতে পারেন নি। ঘটনাগতিতে সঙ্কট দেখা দিলে দ্বিধাহীনভাবে কাল্পনিক ঘটনা সন্নিবেশ করে মূল সমস্যাকে পাশ কেটে গিয়েছেন। “অহেতুক স্বাদেশিক উচ্ছ্বাস, স্থান-কাল-পাত্রের কালানৌচিত্য দোষ, নাটকীয় বাস্তব ঘটনাকে মেলােড্রামাটিক ফুৎকারে উড়াইয়া দিয়া এবং বিশ্বাস- অবিশ্বাস, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকের সীমাকে অবহেলাভরে লঙ্ঘন করিয়া যাওয়ার অনুচিত ঝোঁক গিরিশচন্দ্রের ঐতিহাসিক নাটকগুলিকে আধুনিক পাঠক ও দর্শকের রুচির প্রতিকূল করিয়া তুলিয়াছে” (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)। একমাত্র ‘সিরাজদ্দৌলা’-কেই অপেক্ষাকৃত উন্নত রচনা বলা যায়। কিন্তু এই ‘সিরাজদ্দৌলা’ও দোষবর্জিত নয়। এর গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে ডঃ ভূদেব চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, “জাতীয়তা ও মানবিক জীবনাদর্শের আবেগাতিরেক পরিকীর্তন, ঐতিহাসিক সত্যপ্রতিষ্ঠার প্রয়ােগে আতিশয্য এবং ঘটনাবিন্যাসের অতিবিস্তার, রােমান্টিক উপস্থাপনার অসঙ্গতি—সবকিছু মিলে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক অতিনাটকীয়তায় উচ্ছসিত Melo- drama-ই হয়েছে। তবু গিরিশের হাতের একটি অতি উৎকৃষ্ট সৃষ্টি এই নাটক, বাঙালি চেতনার পক্ষে নাট্যগুণেও অতি সমৃদ্ধ। ….ফল কথা, Melodrama হয়েও গিরিশের অন্যান্য সার্থক সৃষ্টির মত ‘সিরাজউদ্দৌলা’-ও সার্থক বাঙলা নাটক।”

গিরিশচন্দ্রের সামাজিক নাটকের মধ্যে ‘প্রফুল্ল’ (১৮৮৯), ‘বলিদান’ (১৯০৪) এবং ‘শাস্তি কি শান্তি’ বিশেষ প্রসিদ্ধ। গিরিশচন্দ্রের অন্যান্য শ্রেণীর নাটকের প্রধান দোষ অতিমাত্রায় দৈবনির্ভতা, অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ এবং ঘটনা-পরিণতিতে যুক্তিসঙ্গতির একান্ত অভাব। সামাজিক নাটকগুলাে অবশ্য এসব ত্রুটি থেকে অপেক্ষাকৃত মুক্ত। সামাজিক নাটকে বাস্তবতার বন্ধন স্বীকার করা বাধ্যতামূলক, এসব নাটকে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের অতিবাস্তব সমস্যার প্রতিই গিরিশচন্দ্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। কলিকাতার নাগরিক জীবনের নিচুতলার বিকৃত জীবনযাত্রা, পাপাচার এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ভাঙ্গন ‘প্রফুল্ল’ নাটকের বর্ণনীয় বিষয়। যৌথ পরিবারের জটিল বিন্যাসের মধ্যে ভিন্নমুখী প্রবণতাসম্পন্ন কয়েকটি চরিত্র নিয়ে গিরিশচন্দ্র এই নাটকে যে ট্র্যাজিডি রচনা করতে চেষ্টা করেছেন অতিনাটকীয়তার কে সত্ত্বেও তা মােটামুটি সফল হয়েছে। কুটবুদ্ধি, রমেশের অপ্রতিহত পাপাচার, আবেগপ্রবণ যােগেশের চারিত্রিক শৈথিল্য, সুরেশের পদস্খলন, কাঙ্গালী জগমণির নারকীয় প্রবৃত্তি এই নাটকের কাহিনীধারাকে জটিলতর করে যােগেশের পরিবারটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার মধ্যে যৌথ পরিবারের প্রীতিক্নিগ্ধ পরিবেশের প্রতীকরূপে মধ্যম ভ্রাতা রমেশের স্ত্রী প্রফুল্ল বিষয় সৌন্দর্যে মণ্ডিত হয়ে দেখা দেয়। স্বামীর হাতে তার মৃত্যুতেই নাটকের জটিল কাহিনীর গ্রন্থিমোেচন হয় স্বয়ং গিরিশচন্দ্রের অভিনয়ের জন্য ‘প্রফুল্ল’ নাটক আমাদের রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায় যােগ করেছে।

অনেকেই মনে করেন, ‘প্রফুল্ল’ বাঙলা ভাষায় রচিত শ্রেষ্ঠ সামাজিক ট্র্যাজেডি। কিন্তু ট্র্যাজেডিতে যে মহৎ চরিত্রের পতনে দর্শকসাধারণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, এই নাটকে তেমন কোন চরিত্র বা অবকাশ সৃষ্টি করা হয়নি। তাই ‘প্রফুল্ল’ কে ট্র্যাজেডি না বলে ‘করুণরসাত্মক’ বা ‘বিষাদান্তক নাটক’ বলে অভিহিত করাই বিধেয়। নাট্য-সাহিত্যের পরিভাষায় ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মতাে ‘প্রফুল্ল’কেও বস্তুত মেলােড্রামা বলা যেতে পারে।

অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “প্রফুল্লকে যথার্থ ট্র্যাজেডি বলা যাবে না। অতিনাটকীয়তা, খুনজখম, মাতলামি প্রভৃতির বাড়াবাড়ির ফলে এর ট্র্যাজিক রস বিশেষভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে ট্র্যাজেডির সান্তুনাহীন হতাশা, শুষ্ক নয়নের অগ্নিজ্বালা গিরিশচন্দ্র কেন, কোন বাঙালী নাট্যকারই আয়ত্ত করতে পারেননি। সুতরাং ‘প্রফুল্ল’ করুণ রসের নাটক হলেও ট্র্যাজেডি হিসাবে বিশেষ সার্থক হয়নি।”

গিরিশচন্দ্র স্থায়িভাবে সাধারণ রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠায় এবং অভিনয় কলার উন্নতিসাধনে অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন; কিন্তু তুলনামূলকভাবে বিচার করলে বলতে হয় তার সাহিত্যিক প্রতিভা খুব উন্নত ছিল না! মধুসূদন-দীনবন্ধু পাশ্চাত্ত্য নাট্যশিল্পের আঙ্গিক আমাদের সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে যতদূর অগ্রসর হয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র সেই উত্তরাধিকার বহন করবার দায়িত্ব বােধ করেন নি। তিনি নাটকের প্রগতিধারাকে ব্যাহত করে তার গতিমুখ ফিরিয়ে দেন যাত্রা-ধরনের রচনারীতির দিকে। অভিনেতা এবং প্রয়ােগবিদ হিশেবে তার শক্তি ছিল অসাধারণ; তাই সাহিত্যিক গুণাগুণ-বিষয়ে সম্পূর্ণ অনবহিতভাবে তিনি অবিশ্রান্ত রচনায় এবং সেইসব নাটকের অভিনয়ে জনবুচিকে যে পথে পরিচালিত করেছেন তা নাট্য-সাহিত্যের সমৃদ্ধির পক্ষে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। জনরুচির দাবি পূরণ করে তিনি ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করেছিলেন, কিন্তু জনরুচিকে উন্নত করবার দায়িত্ব পালনে উৎসাহ বােধ করেন নি। সাহিত্যিক গুণের অভাবের জন্যই তার প্রায় একশটি নাটকের মধ্যে ‘জনা’ এবং ‘প্রফুল্ল’-র মত দু-একখানি নাটক ভিন্ন অপর রচনা সমসাময়িক কালের পরে বিশেষ সমাদর লাভ করেনি।