গাজি মালিক দিল্লির সিংহাসনে বসার পর ‘সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক’নামে পরিচিত হন। কিন্তু ‘তুঘলক’ শব্দটির অবস্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। আমির খসরু ‘তুঘলকনামা’ গ্রন্থে গাজি মালিককে ‘তুঘলক গাজি’ নামে অভিহিত করে লিখেছেন যে, তখন মোঙ্গল নেতারও ‘তুঘলক’ নাম গ্রহণ করত। খসরুর ‘বিবরণী’র ভিত্তিতে বেনারসীপ্রসাদ সাক্সেনা মনে করেন, ‘তুঘলক’ ছিল গিয়াসউদ্দিনের ব্যক্তিগত নাম, কোনো বংশ বা জাতির নাম নয়। প্রমাণ হিসেবে পরবর্তী সুলতানের নামের উল্লেখ করা যায়। তিনি ‘মহম্মদ-বিন-তুঘলক’ নামে পরিচিত ছিলেন যার অর্থ তুঘলকের সন্তান মহম্মদ। সাম্স-ই সিরাজ আফিফ তাঁর ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’ গ্রন্থে এই বংশের প্রথম শাসককে ‘সুলতান তুঘলক’ এবং দ্বিতীয় শাসককে ‘সুলতান মহম্মদ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এমনকি ফিরোজও ‘সুলতান ফিরোজ শাহ’ নামে পরিচিত ছিলেন। অর্থাৎ উপাধি বা বংশের নাম হিসেবে ‘তুঘলক’ শব্দটিকে গ্রহণ করা হয়নি। তবে মধ্যযুগে প্রতিষ্ঠাতার নামে শাসকগোষ্ঠীর সামগ্রিক পরিচয় প্রদানের রীতি অপরিচিত ছিল না। তাই অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মনে করেন, “সম্পূর্ণ সঠিক না হলেও এই বংশকে ‘তুঘলক বংশ’ নামে অভিহিত করা সুবিধাজনক।”

তুঘলকদের উৎপত্তি সম্পর্কেও পণ্ডিতেরা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। ইবন বতুতা ‘রেহালা’ গ্রন্থে তুঘলকদের তুর্কিস্থানের ‘কোরানা’-গোষ্ঠীর লোক বলে অভিহিত করেছেন। এরা সম্ভবত তুর্কিস্থান ও সিন্ধুর মধ্যবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করত। সমসাময়িক ইতালীয় পর্যটক মার্কোপোলো ‘কোরানা’ অর্থে তাতারবংশীয় পিতা ও ভারতীয় মাতার সন্তানকে বুঝিয়েছেন; আবার কেউ কেউ ‘কোরানা’ শব্দটিকে সংস্কৃত শব্দ ‘করনা’-র সমার্থক বলে মনে করেন, যার অর্থ ক্ষত্রিয় পিতা ও শূদ্র মাতার বিবাহজাত সন্তান। অবশ্য গাজি মালিকের বাল্য-ইতিহাস অনুযায়ী তাঁর এই সম্পূর্ণ ভারতীয় সৃষ্টিতত্ত্ব মানা যায় না। ‘তারিখ-ই-রসিদি’ গ্রন্থের ভিত্তিতে ইলিয়াস (Nay Elias) মনে করেন, কোরানা-তুর্কিরা ছিল মোঙ্গলদের একটি শাখা। ফেরিস্তা তুঘলকদের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে লিখেছেন যে, গিয়াসউদ্দিনের পিতা ছিলেন তুর্কি ক্রীতদাস এবং মাতা ছিলেন লাহোরের জনৈকা জাঠ রমণী। এই বিতর্কের ভিত্তিতে মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, ভারতবর্ষ, মধ্য এশিয়া এবং পারস্যে ‘সংকরজাতি’ বোঝাতেই ‘কোরানা’ শব্দটি ব্যবহৃত হত। এবং এই শব্দ দ্বারা মোঙ্গল বা তুর্কি পিতা এবং অ-তুর্কি মাতার মিলনজাত সন্তানকে বোঝাত।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহ গাজি (১৩২০-২৫ খ্রিঃ):

গিয়াসউদ্দিনের বাল্যকাল সম্পর্কেও পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, তিনি তুর্কি পিতা ও হিন্দু মাতার সন্তান ছিলেন। তাই তাঁর চরিত্রের মধ্যে তুর্কির উদ্যম ও শক্তি এবং হিন্দুর সহনশীলতার সমন্বয় ঘটেছিল। আফিফ ও ইবন বতুতার মতে, তিনি প্রথমে জালালউদ্দিন খলজির আমলে সামরিক বৃত্তিতে নিযুক্ত হন। খসরুর মতে, জালালের মৃত্যুর পর গিয়াসউদ্দিন আলাউদ্দিনের ভাই উলুঘ খাঁ’র অধীনে চাকরি নেন। উলুঘ খাঁ’র মৃত্যুর পর তিনি আলাউদ্দিনের অধীনে নিযুক্ত হন এবং মোঙ্গল আক্রমণের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি সাফল্য প্রদর্শন করে সুলতানের সুনজরে আসেন। সম্ভবত মোঙ্গল নেতা ইকবালমন্দের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জনের পর পুরস্কার হিসেবে তিনি দীপালপুরের ইতা লাভ করেন। ইবন বতুতা লিখেছেন : গিয়াসউদ্দিন ঊনত্রিশবার মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। তবে খসরুর মতে, এই সংখ্যা আঠারো এবং এর অনেকগুলিই ছিল ছোটোখাটো সংঘর্ষ। যাই হোক্, বিশ্বস্ত যোদ্ধা হিসেবে গাজি মালিক দিল্লির সুলতানের বিশ্বস্ততা অর্জন নেই। তবে আশ্চর্যের করেছিলেন—এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল যে, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মালিক কাফুর কর্তৃক প্রশাসনিক ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের ঘটনা জেনেও তিনি নিস্পৃহ থাকলেন কেন? যাই হোক, মুবারক শাহের রাজত্বকালেও তাঁর মর্যাদা ও প্রতিপত্তি অব্যাহত থাকে। অবশেষে খসরু কর্তৃক দিল্লির মসনদ অধিকৃত হলে গাজি মালিক বিদ্রোহী হন। এবং খসরুকে হত্যা করে অভিজাতদের অনুরোধক্রমে সিংহাসনে আরোহণ করেন (৮ সেপ্টেম্বর, ১৩২০ খ্রিঃ)।

ড. ডি. বি. পাণ্ডের মতে, তিনটি কারণে গিয়াসউদ্দিনের ক্ষমতালাভ তাৎপর্যপূর্ণ : 

  • (১) সুলতানি ইতিহাসে এই প্রথম সুলতান সর্বসম্মতিক্রমে মনোনীত হলেন, 

  • (২) জনগণের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকেই দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করা হল এবং 

  • (৩) কোনো রাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য না-থাকা সত্ত্বেও অভিজাতগণ গিয়াসউদ্দিনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানালেন না।

গিয়াসউদ্দিনের সমস্যাদি :

প্রতিপত্তিশালী মালিক ও আমিরগণ কর্তৃক সমর্থিত হয়ে সিংহাসনে বসলেও গিয়াসউদ্দিনকে নানামুখী সমস্যা দ্বারা বিব্রত হতে হয়। মুবারক শাহ এবং খসরুর দুর্বল শাসনকালে দিল্লির কর্তৃত্ব বেশ শিথিল হয়ে পড়েছিল। সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলির অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। সিন্ধুর শাসক অমর থাট্টাও নিম্ন-সিন্ধুর কিছু অংশ দখল করে দিল্লির কর্তৃত্ব একপ্রকার অগ্রাহ্য করেই শাসন চালাচ্ছিলেন। গুজরাটেও দিল্লির কর্তৃত্ব ছিল নামেমাত্র। রাজপুতানা, চিতোর, নাগৌর, জালোর প্রভৃতি স্থানে ক্ষমতা পুনর্দখলে উৎসাহী রাজপুত নেতাদের আক্রমণের তীব্রতা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। পূর্ব ভারতে ‘চিরবিদ্রোহী’ বাংলাদেশের প্রাক্তন শাসক সামউদ্দিন ফিরোজের মৃত্যুর পর এক গৃহযুদ্ধ দ্বারা ফিরোজের অন্যতম পুত্র বাহাদুর শাহ সোনারগাঁও, লখনৌতি দখল করে প্রায় স্বাধীন শাসনের সূচনা করেছিলেন। তিরহূত, জাজনগর (উড়িষ্যা) প্রভৃতি অঞ্চলে হিন্দু জমিদারদের স্বাধীন কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের অবস্থাও খুব আশাপ্রদ ছিল না। আলাউদ্দিন বাৎসরিক কর প্রদানের শর্তে দাক্ষিণাত্যের রাজাদের স্বরাজ্যে বহাল রেখেছিলেন। অবশ্য মুবারক শাহ দেবগিরির ওপর সুলতানের প্রতিনিধি স্থাপন করে ওই রাজ্যে সরাসরি দিল্লির কর্তৃত্ব কায়েম করেছিলেন। কিন্তু মুবারক ও খসরুর মৃত্যুর পর তেলেঙ্গানার শাসক প্রতাপরুদ্র কিংবা হোয়সলরাজা বীরবল্লাল দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করে একপ্রকার স্বাধীনভাবে রাজত্ব চালাতে থাকেন।

রাজনৈতিক সংকটের মতো প্রশাসনিক সংকটও ছিল বেশ ব্যাপক। গিয়াসউদ্দিনের পূর্ববর্তী দুই সুলতান ছিলেন চরম অপদার্থ। তাৎক্ষণিক ক্ষমতার লোভে বিভোর হয়ে এঁরা উদার হস্তে রাজকোষের সঞ্চিত অর্থ বিতরণ করেন আমির, মালিক-সহ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে। ফলে একদিকে যেমন রাজকোষ শূন্য হয়, অন্যদিকে তেমনি সুলতানি কর্তৃত্ব একান্তভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে অভিজাতবর্গ ও সেনাবাহিনীর মর্জির ওপর। আলাউদ্দিনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ-নীতি কিংবা ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা থেকে সরে আসার ফলে রাজা এবং রাজকোষ দুই-ই দুর্বল হয়ে পড়ে। এক কথায় গিয়াসউদ্দিনের সামনে সমস্যা ছিল অনেক এবং তাদের প্রকৃতি ছিল বেশ জটিল। এই কারণে ড. সাক্সেনা লিখেছেন : “The problems which confronted Ghiyasuddin Tughlug were not only vast in their magnitude, but also complicated in their nature.”

বহুমুখী ও বহুব্যাপী সমস্যার সামনে গিয়াসউদ্দিন বিব্রত বা বিভ্রান্ত না হয়ে, ধীরস্থিরভাবে তাদের মুলোৎপাটনে অগ্রসর হন। বয়স্ক হলেও তাঁর চরিত্রে ছিল অপ্রতিরোধ্য উদ্যম, নির্ভুল বিচারবোধ, দৃঢ় প্রত্যয় এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর ঐকান্তিক ইচ্ছা। গিয়াসউদ্দিনের কর্মদক্ষতার প্রশংসা করে বারাণী লিখেছেনঃ “অন্যের যে কাজ সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যায়, সেখানে তিনি কয়েকদিনেই তা সমাধান করতে পারেন।” গিয়াসউদ্দিনের কর্মধারার মধ্যে বারাণী সুলতান আলাউদ্দিনের ছায়া’ দেখে পুলকিত বোধ করেছেন। বস্তুত, বারাণীর মূল্যায়ন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ছিল না। গিয়াসউদ্দিন রণনৈপুণ্যের সাথে রাষ্ট্রপ্রজ্ঞার সমন্বয়সাধন করে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন।

গিয়াসউদ্দিনের অভ্যন্তরীণ-নীতি :

গিয়াসউদ্দিন ছিলেন বাস্তববাদী শাসক। তিনি আলাউদ্দিনের কঠোর নীতি কিংবা মুবারক খলজির অতিনমনীয় শাসননীতি পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন। দৃঢ় অথচ নমনীয় বা ‘Kick and kiss’ নীতি গ্রহণ করে তিনি নিজের হাত শক্ত করেন এবং শত্রুদের দুর্বল করে দেন। প্রথমেই তিনি তাঁর আত্মীয় ও শুভানুধ্যায়ীদের গুরুত্বপূর্ণ রাজপদ ও রাজকীয় উপাধি প্রদান করে সম্মানিত করেন। খলজি আমলের সেনাপতি আমলাদেরও জায়গির বা পদমর্যাদা বহাল রাখেন। এমনকি যাঁরা খসরুকে সাহায্য করেছিলেন, সেই সকল অভিজাতগণকেও তিনি ক্ষমা করেন। খলজিবংশের বিবাহযোগ্য কন্যাদের বিবাহের ব্যবস্থাও তিনি করেন। এইভাবে তিনি নিজের এক উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

‘সমৃদ্ধ রাজকোষ শক্তিশালী রাজতন্ত্রের প্রধান উপাদান’—এই সত্য অনুধাবন করতে গিয়াসউদ্দিনের দেরি হয়নি। তাই ক্ষমতা সংহত করার পরেই তিনি ভেঙে পড়া রাজকোষকে সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ নেন। খসরুর আমলে বিশাল পরিমাণ অর্থ তাঁর বশংবদ ব্যক্তিদের দান করা হয়েছিল। গিয়াসউদ্দিন এক নির্দেশ জারি করে তা ফিরিয়ে দিতে বলেন। তিনি বলেন, “রাজকোষের সম্পদ কেবলমাত্র জনকল্যাণে ব্যয় করা উচিত।” কিন্তু খসরু ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতোই তা অকাতরে দান করেছেন। যাই হোক, অনেকেই স্বেচ্ছায় প্রাপ্ত অর্থ ফিরিয়ে দেন। অনেকের কাছ থেকে জোর করে তা আদায় করা হয়। শেখ নিজামউদ্দিনের মতো কেউ কেউ তা প্রত্যর্পণের অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন। ক্ষুব্ধ হলেও ধর্মীয় কারণে গিয়াসউদ্দিন এই ব্যতিক্রম মেনে নেন।

কৃষিক্ষেত্রে উৎসাহবৃদ্ধির জন্য গিয়াসউদ্দিন আলাউদ্দিনের ভূমিব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ঘটান। বারাণীর মতে, এক্ষেত্রেও গিয়াসউদ্দিন আলাউদ্দিনের কঠোর নীতির পরিবর্তে ‘মধ্যপন্থা’ গ্রহণ করেন। তখন ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার সাথে জড়িত ছিল তিনটি শ্রেণি—সাধারণ কৃষক (বলাহার), গ্রামপ্রধান (মুকদ্দম) এবং প্রাদেশিক শাসক (মুকতি)। আলাউদ্দিনের ভূমিব্যবস্থা উক্ত তিনটি শ্রেণিকেই ক্ষতিগ্রস্ত ও নিরুৎসাহী করেছিল। রাজস্বের হার অত্যধিক হবার ফলে কৃষক চাষ আবাদের বিকল্প জীবিকা অনুসন্ধানে অধিক আগ্রহী ছিল। মুকদ্দমদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেবার ফলে রাজস্ব সংগ্রহের কাজে তারা নিরুৎসাহিত ছিল। আর মধ্যস্বত্বভোগীদের অবর্তমানে মাক্তাদের পক্ষে ভূমিরাজস্ব যথাযথভাবে আদায় করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল। গিয়াসউদ্দিন ভূমিব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে এই তিন শ্রেণিকেই ন্যায়ানুগভাবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবার ব্যবস্থা করেন। তিনি জমি-জরিপের (হুকুম-ই মাসাহাত) ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণের পরিবর্তে কৃষি জমিতে রাজস্ব কর্মীর উপস্থিতিতে উৎপন্ন ফসল ভাগ করার (হুকুম-ই-হাসিল) ব্যবস্থা চালু করেন। এর ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় রাজস্ব প্রদানের বাধ্যবাধকতা থেকে কৃষক মুক্তি পায়। আলাউদ্দিন উৎপাদনের ৫০ শতাংশ ভূমিরাজস্ব হিসেবে আদায়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। গিয়াসউদ্দিন এই হার কমিয়ে দেন। সম্ভবত তিনি চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ স্বাভাবিক রাজস্ব নির্ধারণ করেন। এর ওপরে কালক্রমে সর্বাধিক শতকরা ১/১০ বা ১/১১ ভাগ বৃদ্ধির অনুমোদন দেন। কারণ গিয়াসউদ্দিন উপলব্ধি করেছিলেন যে, কৃষকের ওপর আকস্মিক রাজস্বের চাপ বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং দেশের অগ্রগতি থমকে যাবে। তাই বারবার সুলতান রাজস্ব কর্মীদের সাবধান করে দেন যে, তারা যেন আকস্মিক রাজস্বের হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি না করে। কৃষকের উন্নতি এবং উৎসাহ যাতে কোনোভাবেই নষ্ট না হয়, সেদিকে সুলতানের তীক্ষ্ণদৃষ্টি ছিল।

আলাউদ্দিন যেভাবে মুকদ্দম প্রভৃতি গ্রাম-প্রধানের মান অবনমন করে সাধারণ কৃষকের সমপর্যায়ভুক্ত করেছিলেন, তা গিয়াসউদ্দিনের মনঃপুত ছিল না। তিনি মনে করতেন, দীর্ঘকাল ধরে রাজস্ব আদায়ের কাজে লিপ্ত, দায়িত্বসচেতন এবং ক্ষমতাবান এই গোষ্ঠীর সহায়তা ব্যতীত রাজস্ব প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে চালানো সম্ভব নয়। তাই তিনি পুনরায় নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে মুকদ্দমদের হাতে রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। গ্রাম-প্রধানদের নিজেদের আবাদি জমিকে করমুক্ত করে দেওয়া হয়। অবশ্য কৃষক বা গ্রাম-প্রধান উভয়ের ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা এমনভাবে বৃদ্ধি করা হয়, যাতে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য থাকে; কিন্তু এমন সম্পদ যাতে সৃষ্টি না হয় যা কৃষকদের কর্মবিমুখ করে তুলতে পারে বা গ্রাম-প্রধানদের বিদ্রোহাত্মক কাজে লিপ্ত হতে উৎসাহ দেয়। প্রাদেশিক শাসক বা মাক্তাদের ক্ষেত্রেও গিয়াসউদ্দিন রাজস্ব-বিলিব্যবস্থা (Practice of farming) মেনে নেন। অবশ্য এই ব্যবস্থার কুফল সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। কিন্তু প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, যেমন মাক্তারা, রাজস্ব-বিলিব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেই কাজ করতেন। বারাণীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, গিয়াসউদ্দিন নির্দিষ্ট শর্তে Farming ব্যবস্থা চালু করেন। মাক্তারা প্রদেশের আদায়ীকৃত রাজস্বের ১/১৫ রেখে বাকিটা কেন্দ্রীয় কোষাগারে পাঠাতে বাধ্য ছিল। কারকুন বা মুতাশরিফ প্রমুখ প্রতিনিধি হাজার প্রতি ৫ টঙ্কা কমিশন হিসেবে নিলেও নিতে পারতেন। তবে এর বেশি রাখলে সুলতান তাদের কঠোর শাস্তি দিতেন। উৎপাদনবৃদ্ধির জন্য গিয়াসউদ্দিন নতুন নতুন এলাকাকে কৃষিকার্যের অধীনে আনার জন্য চাষিদের উৎসাহ দেন। একাধিক খাল খনন করে জলসেচের ব্যবস্থা করেন এবং অনাবৃষ্টির সময় কৃষকদের ‘তাকাবি’ ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। গিয়াসউদ্দিনের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সুফল খুব শীঘ্রই অনুভূত হয়। ড. সাক্সেনা লিখেছেন : “এর ফলে রাজকোষ এতই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যে, সুলতানের পক্ষে সামরিক কর্মসূচি দ্বারা রাজনৈতিক আধিপত্য প্রসারের লক্ষ্যে এগোনো সহজ হয়ে ওঠে।” ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারের কাজে গিয়াসউদ্দিনের নমনীয় বাস্তববাদী পরিকল্পনার প্রশংসা করে ড. শৰ্মা (S. R. Sharma) লিখেছেন : “We do not come across such tender consideration for the country until the days of Sher Shah Suri two centuries later.”

দেশের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণেও গিয়াসউদ্দিন তৎপরতা দেখান। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি নতুন রাস্তা নির্মাণ করেন এবং পুরোনো রাস্তার সংস্কারসাধন করেন। ডাকযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকেও তিনি দৃষ্টি দেন। ইবন বতুতা লিখেছেন: “তখন ২০০ মাইল দূরের চিঠি চব্বিশ ঘণ্টায় যথাস্থানে পৌঁছে যেত। বিচারবিভাগকেও তিনি ঢেলে সাজান। সাধারণ অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি নিষিদ্ধ করে দেন। বিচারকদের দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য তিনি সদাসচেতন ছিলেন।” ঐতিহাসিকদের মতে, গিয়াসউদ্দিনের আমলে বিচারবিভাগের দক্ষতা এমন স্তরে পৌঁছেছিল যে, “নেকড়ে মেষশাবককে আক্রমণ করতে ভয় করত কিংবা হরিণ সিংহের পাশে একই ঝরনায় জল পান করতে পারত।”

গিয়াসউদ্দিনের সামরিক অভিযান :

গিয়াসউদ্দিন জীবন শুরু করেছিলেন একজন সৈনিক হিসেবে।‌পরবর্তী কালে সীমান্তরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে তিনি সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন। তাই সুলতানি কর্তৃত্ব দখল করার পরে তিনি বিশেষ গুরুত্বের সাথে সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। মুবারক শাহ এবং খসরু শাহের আমলে সুলতানি-বাহিনীর শৃঙ্খলা এবং দক্ষতার ব্যাপক অবনতি ঘটেছিল। গিয়াসউদ্দিন সামরিক বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলাস্থাপন ও কর্মদক্ষতাবৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। আলাউদ্দিনের আমলের ‘দাগ’ ও ‘হুলিয়া’ প্রথা কঠোরভাবে বলবৎ করেন, এবং সামরিক বাহিনীর বেতন ও সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেন। বারাণীর মতে, গিয়াসউদ্দিনের সামরিক নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের সার্বিকভাবে সন্তুষ্ট রাখা। এমনকি তাদের পিতামাতার থেকেও সুলতান সৈন্যদের সুখসমৃদ্ধির জন্য বেশি কাতর ছিলেন। যাই হোক, দু-বছরের মধ্যেই তিনি সেনাবাহিনীর দক্ষতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন এবং অভিযান পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

গিয়াসউদ্দিন ১৩২১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ফকরউদ্দিন মহম্মদ জুনা খাঁ (উলুঘ খাঁ)-র নেতৃত্বে বরঙ্গলের বিরুদ্ধে এক অভিযান পাঠান। বরঙ্গল আলাউদ্দিনের আমলে দিল্লির অধীনতা স্বীকার করে বাৎসরিক করপ্রদানে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর দিল্লির দুর্বল শাসকদের আমলে বরঙ্গলের রাজা প্রতাপরুদ্রদেব দিল্লির বশ্যতা অগ্রাহ্য করেন এবং কর পাঠানো বন্ধ করে দেন। গিয়াসউদ্দিন পূর্ব অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য জুনা খাঁ কে সসৈন্যে বরঙ্গল আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। জুনা খাঁ দেবগিরি হয়ে বরঙ্গলে উপস্থিত হন এবং বরঙ্গলদুর্গ অবরোধ করেন। এই দুর্গটি ছিল প্রায় দুর্ভেদ্য। তাই ছয় মাস অবরোধ করেও জুনা খাঁ দুর্গ দখল করতে ব্যর্থ হন। প্রতাপরুদ্রদেব দীর্ঘকাল অবরুদ্ধ থাকার ফলে ধৈর্যহীন হয়ে পড়েন। তিনি আশা করেছিলেন, অতীতের মতোই করদানে স্বীকৃত হলে দিল্লি অবরোধ তুলে নেবে। তাই তিনি জুনা খাঁর কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু জুনার লক্ষ্য ছিল তেলেঙ্গানা রাজ্য দিল্লি-সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা। তাই তিনি অবরোধ চালিয়ে যেতে থাকেন। এদিকে দীর্ঘকাল অবরোধে লিপ্ত থাকার ফলে সুলতানি বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে এবং বিদ্রোহাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তবে এই বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে মতভেদ আছে। বারাণীর মতে, ছয় মাসের নিষ্ফল অবরোধে সুলতানি বাহিনী ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছিল। তাদেরই কয়েকজন নেতা যাদের প্রধান ছিলেন উবাইদ, সুলতানের মৃত্যুসংবাদ-প্রচার করে বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। পক্ষান্তরে ইবন বতুতা মনে করেন, জুনা খাঁ নিজেই সিংহাসন দখলের জন্য এই অপপ্রচারের সাহায্য নেন। স্যার উলসী হেগ এই মত সমর্থন করেন। কিন্তু আগা মেহদী হোসেন প্রমুখ ইবন বতুতার বক্তব্যকে সমর্থনযোগ্য বলে মনে করেন না। যাই হোক, বরঙ্গলের বিরুদ্ধে প্রথম অবরোধ ব্যর্থ হয় এবং জুনা খাঁ দিল্লি ফিরে আসেন। কিন্তু চার মাসের মধ্যেই আবার জুনা খাঁর নেতৃত্বে বরঙ্গলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযান প্রেরণ করেন। জুনা ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে বরঙ্গলে উপস্থিত হন। এবারেও প্রতাপরুদ্রদেব প্রবল বাধা দেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। সপরিবারে তাঁকে বন্দি করে দিল্লিতে আনা হয়। প্রতাপরুদ্রদেবের ভাগ্যে কী জুটেছিল—সে বিষয়ে মতভেদ আছে। ড. সাক্সেনার মতে, দিল্লিতে পৌঁছেই অপমানে দগ্ধ রাই প্রতাপরুদ্র আত্মহত্যা করে জীবন বিসর্জন দেন। তবে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, প্রতাপরুদ্রদেব সুলতানের নজরবন্দি হিসেবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে বাধ্য হন। যাই হোক, বরঙ্গল দিল্লির অন্তর্ভুক্ত হয়। জুনা খাঁ সেখানকার শাসক নিযুক্ত হন।

বরঙ্গল অভিযানের অঙ্গ হিসাবে জুনা খাঁ উড়িষ্যার জাজনগর রাজ্য আক্রমণ করেন (১৩২৪ খ্রিঃ)। জাজনগরের রাজা ভানুদেব (১৩০৬-২৮ খ্রিঃ) বরঙ্গলের রাজা প্রতাপরুদ্রকে সাহায্যদান এবং গণ্ডোয়ানার শাসকের সাথে মিত্রতাস্থাপনের জন্য সুলতানের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সুলতানি বাহিনী জাজনগরে উপস্থিত হলে ভানুদেব প্রচণ্ড বাধা দেন। কিন্তু সুলতানি বাহিনীর কাছে তিনি পরাজিত হন। জুনা খাঁ জাজনগর থেকে প্রচুর ধনসম্পদ এবং ৫০টি যুদ্ধহস্তী সংগ্রহ করেন। এই সাফল্যের জন্য গিয়াসউদ্দিন জুনা খাঁকে নতুন সম্মানে ভূষিত করেন। একটি সমসাময়িক মুদ্রা থেকে জানা যায় যে, তাঁকে জগতের নেতা (Khan of the World) নামে সম্মানিত করা হয়েছিল।

প্রায় একই সময়ে উত্তর সীমান্তে মোঙ্গল হানা এবং গুজরাটের স্থানীয় শাসক কর্তৃক বিদ্রোহের ঘটনা গিয়াসউদ্দিনের সামনে বিপদের বার্তা বয়ে আনে। শের মুঘুল-এর নেতৃত্বে মোঙ্গলরা সিন্ধু অতিক্রম করে ভারতে ঢুকে পড়ে। সীমানার শাসক গুরুসাস্প সুলতানের কাছে সাহায্যের আবেদন জানালে, গিয়াসউদ্দিন মালিক সাদির নেতৃত্বে সেনাসাহায্য প্রেরণ করেন। গুরুসাস্প ও সাদি খাঁ মোঙ্গলদের পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। বহু মোঙ্গলকে বন্দি করা হয়। সাদি খাঁ গুজরাটের বিদ্রোহ দমন করেন। তবে বিদ্রোহীদের হাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

চিরবিদ্রোহী বাংলাদেশকে দিল্লির অধীনস্থ করার একটা সুযোগ গিয়াসউদ্দিনের সামনে উপস্থিত হলে সুলতান স্বয়ং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। আগা মেহদী হোসেন-এর মতে, গিয়াসউদ্দিন দাক্ষিণাত্য বিজয়ের তুলনায় বাংলাদেশে কর্তৃত্ব স্থাপনকে বেশি গুরুত্ব দেন। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, সুলতান কাইকোবাদের আমলে তাঁর পিতা তথা বলবনের পুত্র বুগ্রা খাঁ বাংলাদেশে একপ্রকার স্বাধীন শাসনের সূচনা করেছিলেন। বুরা খাঁ’র বংশধর ফিরোজ শা ১৩২২ খ্রিস্টাব্দে মারা গেলে তাঁর চার পুত্র শিহাবউদ্দিন, নাসিরুদ্দিন, গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর ও কুতলু খাঁ ক্ষমতাদখলের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। গিয়াসউদ্দিন ইতিপূর্বেই সোনার গাঁও-এর শাসক হিসেবে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন। ফলে তিনি কুতলুকে হত্যা করে এবং অপর দুই ভাইকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশের ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করেন। ইবন বতুতার মতে, এই বিপদকালে শিহাবউদ্দিন ও নাসিরুদ্দিন সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই সুযোগে বাংলাদেশের ওপর দিল্লির কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গিয়াসউদ্দিন স্বয়ং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সসৈন্যে অগ্রসর হন। দিল্লির নিরাপত্তার ভার থাকে জুনা খাঁর ওপর। গিয়াসউদ্দিন খুব সহজেই গিয়াসউদ্দিন বাহাদুরকে পরাজিত ও বন্দি করেন। তাঁকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নাসিরুদ্দিনকে লখনৌতির শাসক নিযুক্ত করা হয়। সাতগাঁও এবং সোনারগাঁও এর শাসনভার দেওয়া হয় তাতার খাঁর হাতে।

বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে গিয়াসউদ্দিন তিরহূত (ত্রিহৃত) আক্রমণ করেন। তিরহুতের রাজাও দীর্ঘকাল দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করে আসছিলেন। সুলতানের আগমন সংবাদে ভীত হয়ে তিনি জঙ্গলে আশ্রয় নেন। তিরহুতের শাসনভার আহমেদ খাঁর হাতে ন্যস্ত করে সুলতান দিল্লির পথে অগ্রসর হন।

গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যু – ষড়যন্ত্র অথবা দুর্ঘটনা :

বাংলাদেশ থেকে নবনির্মিত রাজধানী তুঘলকাবাদের উদ্দেশ্যে প্রত্যাবর্তনের মাঝে আফগানপুর নামক এক ছোট্ট গ্রামে সদ্যনির্মিত একটি কাঠের অস্থায়ী প্রাসাদে গিয়াসউদ্দিনের রাত্রিকালীন বিরতির ব্যবস্থা করা হয়। সম্ভবত, সুলতানের আদেশে তাঁর পুত্র জুনা খাঁ’র তত্ত্বাবধানে এই অস্থায়ী প্রাসাদ নির্মিত হয়। প্রচলিত রীতি ছিল যে, সুলতান সফল অভিযান শেষে রাজধানীতে প্রবেশ করতেন শুভমুহূর্তে। তাই প্রয়োজনে রাজধানীর সন্নিকটে কোনো স্থানে কিছুটা সময় অতিবাহিত করতেন। তাই আফগানপুরে সুলতানের অস্থায়ী বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সুলতান পাত্রমিত্রদের সাথে রাত্রিকালীন আহার সমাপ্ত করেন। অতঃপর অধিকাংশ অভিজাত হাত-মুখ ধোয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যান। এই সময় অকস্মাৎ প্রাসাদটি ভেঙে পড়ে এবং সুলতান স্বয়ং ও অন্য দু-চার জন ব্যক্তি ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে নিহত হন। প্রাসাদটি কেন ভেঙে পড়ল এবং এর পেছনে জুনা খাঁর কোনো দুরভিসন্ধি ছিল কিনা—এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকদের মধ্যে পরিষ্কার মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। জিয়াউদ্দিন বারাণী লিখেছেন : এক আকস্মিক বজ্রাঘাতে অস্থায়ী মণ্ডপটি ধসে পড়েছিল। কিন্তু ইবন বতুতা ভিন্ন কথা বলেন। দুর্ঘটনার কয়েকবছর পরে (১৩৩৩ খ্রিঃ) তিনি ভারতে আসেন। তবে সুলতানের সহযোগী এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শেখ রুকনউদ্দিনের কাছ থেকে বিবরণটি শুনেছেন বলে দাবি করেন। ইবন বতুতা লিখেছেন : “আহার সমাপনের পর জুনা খাঁ প্রার্থনার জন্য অন্যান্যদের ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুরোধ করেন এবং সুলতানকে বাংলাদেশ থেকে দখল করা হাতির কুচকাওয়াজ দেখার অনুরোধ করেন। এই হাতির চাপে মণ্ডপটি ভেঙে পড়ে এবং সুলতান চাপা পড়েন। তাঁর আর্ত চিৎকার শোনা সত্ত্বেও জুনা খাঁ ইচ্ছাকৃতভাবে উদ্ধারকার্যে দেরি করেন।

ইয়াহিয়া বিন আহমেদ-এর ‘তারিখ-ই মুবারকশাহি, নিজামউদ্দিন আহমেদের ‘তাবাকৎ-ই আব্বরী’ এবং বদাউনির ‘মুক্তাখাব-উৎ-তোয়ারিখ’ গ্রন্থসমূহে ইবন বতুতার মতকেই সমর্থন করা হয়েছে এবং এই দুর্ঘটনার পেছনে জুনা খাঁ’র দূরভিসন্ধির ছাপ স্বীকার করা হয়েছে। নিজামউদ্দিন মনে করেন, ফিরোজ শাহ ক্ষুব্ধ হবেন এই ভয়ে বারাণী সত্য গোপন করে মনগড়া বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর মতে, সুলতানের বাংলা অভিযানের সময় নিজামউদ্দিন আউলিয়া এবং জুনা খাঁ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। নিজামউদ্দিনের প্রতি সুলতান অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারণ সুলতান আগের দান করা সম্পত্তি ফেরত চাইলে নিজামউদ্দিন তা দিতে অস্বীকার করেছিলেন। তাই ক্ষুব্ধ সম্রাট বাংলা থেকে দিল্লি ফেরার আগেই সুফিসন্তকে দিল্লিত্যাগের নির্দেশ দেন। এ কথা শুনে সন্ত নাকি বলেছিলেন : ‘দিল্লি বহু দূর (দিল্লি হনুজ দূর অস্ত্)। অর্থাৎ তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, সুলতান দিল্লিতে ফিরতে পারবেন না।

পক্ষান্তরে ফেরিস্তা, হিন্দু ঐতিহাসিক রাই বৃন্দাবন প্রমুখ মনে করেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলেই দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল এবং এজন্য জুনা খাঁ কে দায়ী করা যায় না। গবেষক মজিক (Mazik) মনে করেন, শেখ নিজামউদ্দিনের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা অকল্পনীয়, অসম্ভব এবং মহান সুফিসাধকের চরিত্রবৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যহীন।

এ সম্পর্কে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যেও মতভেদ স্পষ্ট। স্যার উলসী হেগ মনে করেন, বারাণীর বিবরণ সত্য গোপনের ব্যর্থ প্রয়াসমাত্র এবং তাই দুর্বল। মিঃ হেগ বারাণী কর্তৃক ‘স্বর্গ থেকে বজ্রপাত’ বাক্যটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, এটি হওয়া উচিত ছিল ‘আকাশ থেকে বজ্রপাত’। তিনি সত্যগোপন করতে চেয়েছেন বলেই এ ধরনের কল্পিত শব্দ (স্বর্গ) ব্যবহার করেছেন। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদও এই মত পোষণ করেন। তিনি লিখেছেন : “That the sultan’s death was the result of pre meditation and conspiracy and not of accident.” কিন্তু ড. মেহদী হোসেন, ড. বেণিপ্রসাদ সাক্সেনা প্রমুখ ভিন্ন মত পোষণ করেন। ড. হোসেন আইন-ই-মুলুক রচিত ‘ইনসা-ই-মবরু’গ্রন্থ থেকে প্রমাণ করেছেন যে, ১৩২৫-এর ১৫ই মে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যখন ঝড় বিদ্যুৎ-বজ্রপাত যে-কোনো সময় ঘটা সম্ভব। তিনি লিখেছেনঃ “In tropical countries on a summer’s afternoon storms offen occur.” আসলে ইসামীর কাব্যগ্রন্থ ‘ফুতুহ-উস্-সালাতিন’ বারাণীর ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি থেকে বেশি জনপ্রিয় ছিল। বাকি সমস্ত রচনাই পরবর্তীকালের। স্বভাবতই এই সকল লেখক ইসামীর বক্তব্যকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক বলে গ্রহণ করেছেন। ‘মালিকজাদা আহমদ-বিন্-আয়াজ যিনি মণ্ডপ নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন, সুলতানি লাভ করার পর জুনা খাঁ কর্তৃক তাঁর পদোন্নয়নের ঘটনাকে ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু যুক্তি ও পরিস্থিতির বিচারে ষড়যন্ত্রের তত্ত্বকে স্বীকার করা যায় না। মেহদী হোসেন ও ড. নিজামী মনে করেন, প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে কয়েকজন লেখকের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শেষ কথা হতে পারে না। ঘটনার অগ্রগতি ও পরিণতি এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণ, এক্ষেত্রে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।

(১) সুলতান গিয়াসউদ্দিনের সাথে তাঁর পুত্র জুনা খাঁ’র কখনোই আস্থা বা বিশ্বাসহানির ঘটনা ঘটেনি। গাজি মালিক বিদ্রোহী হলে জুনা খাঁ দিল্লি থেকে ছুটে গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। গাজি মালিক গিয়াসউদ্দিন শাহ হবার পর জুনা খাঁ’কে সম্মানসূচক ‘উলুঘ খাঁ’ উপাধি প্রদান করেছিলেন। একাধিক বৃহৎ অভিযানে সুলতান পুত্রের হাতে সৈনাপত্য অর্পণ করেছিলেন। এমনকি পরবর্তী সুলতান হিসেবে কেউ কখনোই জুনা খাঁ’র দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানাননি। তাহ জুনা পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেন কেন?

(২) সেনাপতি ও যোদ্ধা হিসেবে গিয়াসউদ্দিন ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। সেনাবাহিনী তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে যে রাজি ছিল না—একথা ইবন বতুতা নিজেই লিখেছেন। তেলেঙ্গানা অভিযানকালে সুলতানের মৃত্যুসংবাদ এবং জুনা খাঁ’র সিদ্ধান্তের সাথে সেনাবাহিনী সহমত হতে অস্বীকার করে এবং তাঁকে ত্যাগ করেই দিল্লি প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় সেই প্রিয় সুলতানকে অকারণে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে তারা জুনা খাঁ’র সহায়তা করতে রাজি হবে কেন?

(৩) ইবন বতুতা শেখ রুকনউদ্দিনের কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ শুনেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। রুকনউদ্দিনের সাথে মহম্মদ তুঘলকের (জুনা খাঁ) সু-সম্পর্ক ছিল। তিনি একজন বিদেশির কাছে বর্তমান সুলতানের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেবেন—এ কথা স্বীকার করা কষ্টকর। ড. সাক্সেনা লিখেছেন: “Perhaps Ibn-Battuta’s memory failed him or he deliberately and maliciously associated a saint’s name to lend an air of authenticity to his otherwise incredible statement.”

(৪) সুলতান হওয়ার পরেও জুনা খাঁ’র সাথে তাঁর মায়ের মধুর সম্পর্ক ছিল। পিতৃহত্তা হলে তা সম্ভবত থাকত না।

(৫) মহম্মদ-বিন্-তুঘলক নিজের আত্মজীবনীতে আলাউদ্দিন খলজিকে ‘বিশ্বাসঘাতক, হস্তারক ও সিংহাসন জবরদখলকারী’ বলে অভিহিত করেছেন। নিজে একই কাজ করলে এত দৃঢ়তার সঙ্গে আলাউদ্দিনের বিরূপ সমালোচনা করতে পারতেন না।

(৬) মহম্মদ তুঘলকের শিক্ষাদীক্ষা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে একটা অপ্রয়োজনীয় এবং যুক্তিহীন ষড়যন্ত্রের নায়করূপে তাঁকে কল্পনা করা কষ্টকর। বস্তুত, নবনির্মিত প্রাসাদটি ছিল দুর্বল। ইসামী বা বারাণীর এই বিবরণ সত্য। অস্থায়ীভাবে নির্মিত একটা প্রাসাদ খুব শক্ত না-হওয়া কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে তার ভেঙে পড়ার সঙ্গে জুনা খাঁর নাম যুক্ত করার বিষয়টি অযৌক্তিক এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দ্বারা সমর্থিত নয়, তাই বর্জনীয়।

গিয়াসউদ্দিনের কৃতিত্বের মূল্যায়ন :

গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাসনদায়িত্বে ছিলেন পাঁচ বছরেরও কম সময় (মৃত্যুঃ মার্চ/মে ১৩২৫ খ্রিঃ)। কিন্তু এই সামান্য সময়কালেই তিনি যোদ্ধা ও প্রশাসক হিসেবে কৃতিত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বলবনের মতোই অতি সামান্য অবস্থা থেকে তিনি ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু নিজের অস্তিত্ব দৃঢ় করার জন্য তাঁকে বলবনের মতো কোনো ‘দৈব-অনুগ্রহ’ বা ‘বংশমর্যাদা’র আবরণে নিজেকে আড়াল করে রাখতে হয়নি। গিয়াসউদ্দিনের সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল তাঁর চারিত্রিক সততা, কর্মে আন্তরিকতা এবং প্রজাকল্যাণের একান্ত ইচ্ছাবোধ। ড. এ. পি. পাণ্ডে সুলতান জালালউদ্দিন, বলবন ও আলাউদ্দিনের সাথে গিয়াসউদ্দিনের তুলনা করে লিখেছেন : “He avoided their faults and incorporated their merits, ” সামান্য সৈনিক থেকে সুলতানের আসনে অধিষ্ঠিত হলেও তাঁর মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়নি। অহংবোধ তাঁর দৃষ্টির স্বচ্ছতা আচ্ছন্ন করতে পারেনি। বারাণী লিখেছেনঃ “তাঁর ব্যক্তিজীবন ছিল স্বচ্ছ এবং পবিত্র। মধ্যযুগীয় যে-সকল পাপ অধিকাংশ সুলতানকে গ্রাস করেছিল, তা থেকে গিয়াসউদ্দিন ছিলেন মুক্ত।” ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, “তিনি ছিলেন কোমল হৃদয় ও প্রজাদরদী শাসক।”

গিয়াসউদ্দিনের সিংহাসনে আরোহণকালে দিল্লি-সুলতানির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল শিথিল এবং রাজকোষ ছিল প্রায় শূন্য। স্থানীয় শাসকদের স্বাধীনতাকামিতা এবং মুবারক শাহ ও খসরু শাহ’র অমিতব্যয়িতার ফলে সামাজিক অখণ্ডতা বিপন্ন হয়েছিল এবং অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। গিয়াসউদ্দিন অত্যন্ত ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সাথে রাজনৈতিক সংহতি ও রাজকোষের সমৃদ্ধি ফিরিয়ে এনে প্রমাণ করে দেন যে, অভিজাতবর্গ তাঁকে সিংহাসনে মনোনীত করে ভুল করেননি। ভূমিব্যবস্থার ক্ষেত্রে তিনি আলাউদ্দিনের কঠোর নীতির পরিবর্তে ‘মধ্যপন্থা’ অনুসরণ করে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। এর ফলে সরকারি আয়ের পথ যেমন সুগম হয়, তেমনি কৃষকশ্রেণিও উপকৃত হয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় কৃষকদের রাজস্বপ্রদানের দায় থেকে অব্যহতি দিয়ে তিনি মানবিকতা ও কল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন। মুকদ্দম এবং মুক্তিদের রাজস্বব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করে গিয়াসউদ্দিন তাদের সামাজিক মর্যাদা এবং বংশানুক্রমিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বারাণী যথার্থই বলেছেন যে, আলাউদ্দিন রক্তপাত, ষড়যন্ত্র এবং নিপীড়নের মাধ্যমে যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন; গিয়াসউদ্দিন তুঘলক মাত্র চার বছরে মিথ্যাচার, কঠোরতা বা হত্যাকাণ্ড ছাড়াই তা অর্জন করেছিলেন। বংশমর্যাদার প্রতি তাঁর কোনো ভ্রান্ত আনুগত্যবোধ ছিল না। গিয়াসউদ্দিন সরকারি কর্মীনিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতা বা যোগ্যতাকে প্রধান মাপকাঠি হিসেবে গুরুত্ব দিতেন। তাঁর সামরিক বাহিনী এবং সাধারণ প্রশাসনে বহু হিন্দু নিযুক্তি হয়েছিল মূলত তাদের দক্ষতা ও সততার জন্যই।

গিয়াসউদ্দিনের ব্যক্তিজীবন ছিল মধ্যযুগীয় কলুষতামুক্ত। তাঁর চরিত্র ছিল স্বচ্ছ, তাঁর আচরণ ছিল নৈতিকতাপূর্ণ। কবি আমির খসরু সুন্দরভাবে লিখেছেন : “He never did any thing that was not replete with wisdom and sense. He might be said to wear a hundred doctors hoods under his crown.” বিদ্যা ও বিদ্বানের প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তাঁর রাজসভায় বহু জ্ঞানীগুণী ও পণ্ডিতের সমাবেশ ছিল। শিল্পানুরাগী হিসেবেও গিয়াসউদ্দিনের সুনাম ছিল। সিংহাসনে আরোহণের পরেই তিনি দিল্লির সন্নিকটে একটি নতুন প্রাসাদময় শহর নির্মাণ শুরু করেন। তেলেঙ্গানা বিজয়ের বছরে এটির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। এই নতুন শহরের নাম দেন ‘তুঘলকাবাদ’। তুঘলকাবাদের অদুরে তিনি নিজের একটি অনন্যসুন্দর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। লাল পাথর আর সাদা মার্বেলে তৈরি এই স্মৃতিসৌধ আজও শিল্পরসিকদের আকর্ষণ করে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, সুদক্ষ ও বিশ্বস্ত সৈনিক গিয়াসউদ্দিন শাসক হিসেবেও ছিলেন নমনীয়, প্রজাদরদী এবং ন্যায়বাদী। তিনি মৌল উদ্ভাবক হয়তো ছিলেন না, কিন্তু সংরক্ষক হিসেবে ছিলেন সফল। ড. বেনারসীপ্রসাদের ভাষায় বলা যায় : “In short, the founder of the Tughluq dynasty was a sovereign of wide sympathies, of firm determination and sound judgement.”

ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ প্রমুখ গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের নানা গুণের কথা স্বীকার করেও মনে করেন যে, হিন্দুদের প্রতি আচরণে তিনি সমদর্শী ছিলেন না। ড. মজুমদারের মতে, “গিয়াসউদ্দিন যুগের প্রভাব অস্বীকার করতে পারেননি, সাধারণ প্রশাসনে তিনি অন্ধের মতোই কোরানের আইন অনুসরণ করতেন।” তাঁর আমলে হিন্দুদের অবস্থা বিশ্লেষণ করে ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন: “হিন্দুদের প্রতি কঠোর আচরণ করা হত এবং রাজনীতিতে মর্যাদাহীনতার গ্লানি ভোগ করতে হত”(“Hindus were treated with a great severity and were made to feel their position of inferiority in the body politic. “)। হিন্দুদের প্রতি তাঁর আচরণের মূল লক্ষ্য ছিল এমন কিছু করা, যাতে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে চাষ-আবাদ বন্ধ না করে, আবার এমন কিছু না করে যাতে তারা সম্পদশালী হয়ে উদ্‌বেলিত হতে পারে। এক্ষেত্রে আলাউদ্দিনের সাথে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের নীতিগত প্রভেদ খুব বেশি ছিল না। অর্থাৎ ব্যক্তি হিসেবে গিয়াসউদ্দিন উদারমনা হলেও, রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের সময় তিনি ধর্মীয় অনুশাসনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। ড. মজুমদারের মতেঃ “This was clearly based upon discrimination between Muslims and Hindus, and the later were relegated to an inferior position without any political status or civil rights in the land of their birth. ” অবশ্য এই যুগনির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেও বলা যায় যে, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ছিলেন ‘উদার হৃদয়’ ও ‘প্রজাদরদী’ প্রশাসক।