প্রশ্নঃ গারাে উপজাতির সাংস্কৃতিক জীবনধারা আলােচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের যেকোনাে একটি উপজাতির জীবন সম্পর্কে আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ উপজাতীদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তন ও বিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। বাংলাদেশে প্রায় ২০টির মত উপজাতীয় সমাজ বাস করে। বাংলাদেশে আমরা যাদেরকে উপজাতি বলি ইংরেজ আসার পূর্বে তাদের কোনাে লিখিত ভাষা ছিল না। ১৯৩১ সালের পূর্ব পর্যন্ত তাদেরকে এনিমিস্ট বলা হতাে। ১৯৩১ সালের আদমশুমারির সময় তাদেরকে প্রথমবারের মত দেখা হয় আদিম উপজাতি হিসাবে। এর মধ্যে গারো উপজাতি অন্যতম।

উপজাতির সংজ্ঞাঃ উপজাতির কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী উপজাতি নিয়ে আলােচনা করেছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে কেউ উপজাতিকে সংজ্ঞায়িত করেননি। সাধারণত উপজাতি বলতে বুঝায় এমন একটি জনগােষ্ঠী যারা মােটামুটিভাবে একটি অঞ্চলে সংগঠিত এবং যাদের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং যার সদস্যরা মনে করেন যে, তারা একই সাংস্কৃতিক এককের অন্তর্ভূক্ত।

বাংলাদেশে গারাে উপজাতির সাংস্কৃতিক জীবনধারাঃ হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত জীবনধারায় ব্যাপৃত নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বসবাসরত জনগােষ্ঠির নাম উপজাতি। বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে গারাে উপজাতি অন্যতম। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ হাজার গারো বাস করে। চলমান বিশ্বের আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে গারাে উপজাতির সাংস্কৃতিক জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। নিম্নে বাংলাদেশের গারাে উপজাতির সাংস্কৃতিক জীবনধারা আলােচনা করা হলােঃ

(১) গারাে নামকরণ ও বাসস্থানঃ বনে-জঙ্গলে আর পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করে বিধায় সমতলবাসী বাঙালিরা এই উপজাতিকে গারাে নামে আখ্যায়িত করে। এখন অবশ্য এই উপজাতিকে চেনার জন্যই গারাে নাম ব্যবহার করা হয়। গারােরা অবশ্য নিজেদেরকে মান্দি বলে পরিচয় দেয়। অনেকের মতে গারাে পাহাড়ের নামানুসারে তাদের নাম গারাে রাখা হয়েছে। গারাে উপজাতির অধিকাংশ লােক ভারতের আসাম জেলায় এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় বসবাস করে। ঢাকা, রংপুর ও সিলেট চা বাগানেও কিছু গারাে উপজাতি দেখতে পাওয়া যায়।

(২) গারোদের নরগােষ্ঠীগত পরিচয়ঃ অধ্যাপক রিজলির মতে, আসাম রাজ্যে গারােদের আদি আবাসভূমি ছিল। চেহারাগত বৈশিষ্ট্যে এরা আসামের খাসিয়া, নাগা ও মনিপুরীদের উত্তরাধিকারী বলে মনে করা হয়। ডঃ টন গারােদের মঙ্গোলীয় বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা মঙ্গোলয়েড নরগােষ্ঠীর অনেক বৈশিষ্ট্যই তাদের মধ্যে বিদ্যমান।

(৩) গারোদের জনসংখ্যাঃ বাংলাদেশে প্রায় ৮০,০০০-এর মত গারাে বসবাস করে। এর মধ্যে মধুপুর গড়ে ২০,০০০ এবং ময়মনসিংহে ৫০,০০০ গারাে বাস করে।

(৪) গারােদের ভাষাঃ গারোদের ভাষার স্থানীয় নাম গারাে ভাষা বা মান্দি ভাষা। এ ভাষা আবার দুই প্রকার। যথা- ‘মান্দি কুসিক’ বা সকল মানুষের ভাষা ও ‘আচ্ছিক কুসিক’ বা পাহাড়িদের ভাষা। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, তাদের ভাষা মূলত সিনাে-টিবােটান ভাষা বংশের অন্তর্গত। তাদের ভাষায় কোন লিপি বা অক্ষর নেই। তবে বাংলাদেশী গারােরা বর্তমানে বাংলা হরফে গারো ভাষা লিখছে।

(৫) গারােদের ধর্মঃ গারােদের ধর্মের নাম সংসারেক। ঐতিহ্যগতভাবে তারা সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী। তারা যে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করে তার নাম মিতে বা মাইতে। গারােদের ধারণা কিছু মাইতে দয়ালু, পরােপকারী, আবার কিছু মাহতে নির্দয় ও শত্রুভাবাপন্ন। জীবহত্যা, নৃত্যানুষ্ঠান ও মদ্যপান গারােদের ধর্মের সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। গারােরা পুনজন্মে বিশ্বাসী। তারা হিন্দুদের মতাে মাইতেদের পূজা দিয়ে খুশি রাখতে চায়। বর্তমানে বাংলাদেশের ৯০% গারােই ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান।

(৬) গারােদের সামাজিক সংগঠনঃ গারাে সমাজ প্রধানত মাতৃসূত্রীয়। তাদের সবচেয়ে বৃহৎ মাতৃসূত্রীয় গােত্রের নাম ‘চাটচী’। যারা চাটচীভুক্ত তারা সকলেই একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করে। চাটটী গােত্র আবার ক্ষুদ্র গােত্র ‘মাচং’-এ বিভক্ত। আবার মাচং-এর অধীনে ‘মাহারী’ নামক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গােত্র রয়েছে।

(৭) পরিবার ও বিবাহ ব্যবস্থাঃ গারােদের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথা বিদ্যমান। পরিবারের ক্ষমতা স্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত থাকে। পরিবারের সম্পত্তির মালিক স্ত্রী। গারাে সমাজে বংশধারা মাতা থেকে মেয়েতে বর্তায়। গারাে সমাজে আন্তর্বিবাহ নীতি বিরুদ্ধ। বিবাহের পর নবদম্পতি স্ত্রীর মাতার গৃহে বসবাস করে। তবে ইদানীং কিছু শিক্ষিত গারাে দম্পতি স্বামীগৃহে বাস করে। গারাে সমাজে যুগল বিবাহ বেশি লক্ষ্য করা যায়। তবে বহু স্ত্রী বিবাহ একেবারে অজানা নয়। গারাে সমাজে প্যারালাল কাজিন বিবাহ নিষিদ্ধ কিন্তু ক্রস কাজিন বিবাহ নীতিসিদ্ধ। গারাে বিবাহে কন্যাকে কোনাে পণ দিতে হয় না এবং স্বামীও যৌতুক পায় না। তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ খুবই কম।

(৮) গারােদের শিক্ষাঃ বাংলাদেশি গারােরা খ্রিষ্টান মিশনারীগুলােতে শিক্ষা লাভ করছে। বাংলাদেশি গারােরা বাংলা হরফে গারাে ভাষা শিখছে। বর্তমানে ২৯% গারাে শিক্ষিত।

(৯) গারােদের অর্থনীতিঃ সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ১৯৫০ সালের পর থেকে গারােরা জুমচাষ ত্যাগ করে হালচাষ কৃষির সাহায্যে ধান, নানা জাতের সবজি ও আনারস উৎপাদন করছে। গারাে সমাজে বর্তমানে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ হিসাবে ব্যক্তি মালিকানা ও মুদ্রা অর্থনীতির প্রভাবের কথা বলা যায়।

(১০) গারােদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াঃ গারােদের বিশ্বাস আত্মা অমর। মৃত্যুর পর আত্মা চিকমাং নামক স্থানে চলে যায়। গারােরা মৃতদেহকে গােসল দিয়ে বাঁশের তৈরি মেঝেতে কমপক্ষে একদিন একরাত রেখে দেয় এবং মরদেহের মাথার কাছে নানা খাদ্য রাখে। দ্বিতীয় রাতে মৃতদেহ পােড়ান হয়। দিনে মৃতদেহ পােড়ানাের নিয়ম নেই। মৃতদেহ পােড়ানাে ছাই জঙ্গলে ফেলে দেয়া হয় এবং হাড়গুলাে বাড়ির কাছে পুঁতে রাখা হয়।

(১১) পােশাক ও আনন্দঃ গারােদের পােশাকে বিশেষ বাহুল্য নেই। পুরুষেরা ধুতি পরে, মেয়েরা লুঙ্গির মতাে করে কাপড় পরে, ব্লাউজের মতাে কাপড় বুকে পরে। গারােরা প্রেম-গীতি এবং নাচ-গানে খুবই উন্নত।

(১২) গারােদের খাদ্যঃ বাংলাদেশী গারােরা হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল, শূকর প্রভৃতি প্রাণি খায়। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী তাদের বিড়াল খাওয়া নিষিদ্ধ। মদ তাদের অপরিহার্য পানীয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, গারাে উপজাতি সমাজ এখন আর বিচ্ছিন্ন জনপদ নয়। এখন তারা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শাসনাধীন। সভ্যতার আলাে গারাে সমাজেও পৌঁছাতে শুরু করেছে। ফলে তাদের সাংস্কৃতিক জীবনধারায়ও পরিবর্তন, পরিমার্জন শুরু হয়েছে। তারা যেসকল কুসংস্কার বিশ্বাস করতাে ও পালন করতাে এখন তা অনেকটাই শিথিল।