‘গানের আড়াল’ কবিতাটি ‘চক্রবাক’ কাব্য গ্রন্থ থেকে গৃহীত। ‘চক্রবাক’ বিরহের কাব্য—এই বিরহের সুর গানের আড়াল কবিতায় পরিস্ফুট হয়েছে।‘গানের আড়াল’-এ কবির‌ প্রেমিক হৃদয়ের আর্তি ও অভিমান ধরা পড়েছে। এই রোমান্টিক ভাব যথোপযুক্ত ভাষা ও ছন্দের বন্ধনে বেঁধে কবি প্রকাশ করেছেন। ভাষা ভাবের বাণী-বিগ্রহ। কবির চিত্তে যে ভাবের সৃষ্টি হয়, ভাষার মাধ্যমে সেই ভাবকে স্রষ্টা রূপায়িত করেন। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে তাই ভাষার প্রশ্নটি অত্যন্ত মূল্যবান। কাব্যের ভাষা কবির ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী স্বাতন্ত্র্য লাভ করে, কাব্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে যে ভাব তাই কবিভাষা। নজরুলের একটি কবিভাষা ছিল, যার দ্বারা তার কবিতার বৈশিষ্ট্যকে বোঝা যায়। কবি ভাষাকে ভাবের উপযোগী করে তুলেছেন।‌ নজরুল রচনায় আবেগের প্রবলতা উল্লেখযোগ্য। তাই ভাষা কখনো কখনো বাঁধ মানেনি, তা আবেগের টানে কূল ছাপিয়ে গেছে।

নজরুল ভাষাশিল্পের দিক থেকে তাঁর কবিতায় অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। নজরুলের কাব্যে তদ্ভব শব্দের সংখ্যা বেশি। কিছু কিছু কবিতায় আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহার বেশি করেছেন। একজন সমালোচক বলেছেন : ‘বাংলা ভাষায় শব্দভাণ্ডারের অন্তর্গত তৎসম, তদ্ভব, অর্ধ-তৎসম, দেশি ও বিদেশি, এই পাঁচ জাতীয় শব্দেরই নজরুল কাব্যে সুন্দর প্রয়োগ লক্ষণীয়। ‘গানের আড়াল’ কবিতায় নজরুলের ভাববৈশিষ্ট্য বর্তমান। কিন্তু তাঁর অন্যান্য কবিতার মতো শব্দ-বৈচিত্র্য এখানে বিদ্যমান নয়।

‘গানের আড়াল’ রোমান্টিক কবিতা, প্রেমের কবিতা। জনৈক সমালোচক বলেছেন, নজরুলের বিদ্রোহ-ভঙ্গির কবিতায় প্রকাশের অসংযমের মাত্রা বেশি। তাঁর এই ধারার কাব্যে সংহত ধরনের কবিতা লক্ষণীয়। (দ্রষ্টব্য : মধুসূদন বসু-নজরুলের কাব্য-পরিচয় পৃ. ১২৯)। ‘গানের আড়াল’ রোমান্টিক কবিতা বলেই ভাষা ও চিত্রকল্প রোমান্টিকতার বর্ণে অনুরঞ্জিত। ভাষায় আবেগের স্পর্শ লেগে বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে—

‘যে চাঁদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাঁদই শোনে নাই’।

অথবা,

‘সুরের আড়ালে মূৰ্চ্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তাহা বীণ্?

অথবা,

‘আমার বুকের বাণী হ’ল শুধু তব কণ্ঠের ফাঁসি’?

এই সব সংমিশ্র, ভাবগর্ভ উক্তির মধ্যে কাব্যের ভাবধর্মিতা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি আবেগও প্রকাশিত হয়েছে। কবির কবিতার ভাষায় আবেগের বিগলন বেশি, তাই ভাষা বুদ্ধিধর্মী না হয়ে আবেগধর্মী হয়ে উঠেছে—

“যে কাঁটা-লতায় ফুটেছে সে-ফুল, রক্তের ফাটিয়া পড়ি, 

সারা জনমের ক্রন্দন যার ফুটিয়াছে সাখা ভরি’-”

‘গানের আড়াল’–এ কবিতার চরণে সংহতি উল্লেখযোগ্য—

‘আমি শুধু তব কণ্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ নয় !

‘গানের আড়াল’—কবিতায় ভাষা ও ছন্দের মিলন সার্থকভাবে দ্যোতিত হয়েছে। পর্ব বিভাগের মাত্রাসমকত্ব ‘বাংলা ছন্দের বৈশিষ্ট্য’। ‘গানের আড়াল’ কবিতায় ছয় মাত্রার চাল কবিতার মধ্যে যে লয় সৃষ্টি করেছে, তা কবিতাটির ভাবব্যঞ্জনা প্রকাশের পক্ষে যথাযথ।

‘গানের আড়াল’ কবিতার ভাব রোমান্টিক বিরহের ভাব ! কবিপ্রাণের আকুতিকে কবি প্রকাশ করেছেন ভাষা ও ছন্দের সুস্বতি প্রয়োগে। কবিতাটি পাঁচটি স্তবকে বিভক্ত। কবির গানের আড়ালের যে ব্যথা ও যন্ত্রণা তাকে তাঁর বন্ধু সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন নি। কবির মনে নানা প্রশ্ন জেগেছে—

গানের বাণী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা’

গানের বাণীর মধ্যে যে বহিরঙ্গ আবেদন আছে, এখানে তার কথা বলা হয়েছে। বাণীবিলাসকে ছাড়িয়ে গানের যে আবেদন ছড়িয়ে পড়ে সুরের জগতে, এই সুরের আড়ালে যে যন্ত্রণা থাকে, সেই যন্ত্রণাকে বুঝতে পারার মধ্যেই গানের সার্থকতা। কবির দুঃখ যে তার বন্ধু তার গানের বাণীকে বুঝেছে, কিন্তু গানের আড়ালের যে যন্ত্রণাকাতর মন তাকে বোঝে নি। এই উপলব্ধি থেকে কবিমনে এই অভিমান জেগেছে যে ‘আমি শুধু তব কণ্ঠে হার, হৃদয়ের কেহ নয়।” কবির ধারণা এতদিনে সত্য হয়েছে। এই কথা ভেবে “তুমি খেলিয়াছ বাজাইয়া মোর বেদনার ঝুমঝুমি।” কবিতার শেষে কবির সান্ত্বনা যে কবি তার বন্ধুকে গান উপহার দিয়েছেন, এই গান তার বন্ধুর কণ্ঠহার হয়েছে। কিন্তু তা তাঁর হৃদয়ের কাছাকাছি হয়তো পৌঁছিয়েছে, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করেনি। এই ভাষাটিকে কবি সংহত স্তবক বন্দনের মধ্যে প্রকাশ করেছেন। কবি তাই সুরধর্মী ভাষা ও ছন্দে সমন্বিত করে বলেছেন—

ভোলো মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়, 

আমি সুধু তব কণ্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ নয়! 

জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন, এটুিকু শুধু যাচি-

কণ্ঠ পরায়ে হ’য়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি!

চার চরণে গঠিত স্তবকে কবির ভাব উপযুক্ত ভাষা ও ছন্দে গ্রথিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এইসব দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে এ-সত্য ধরা পড়ে যে কবিতাটি ভাব ভাষা ও ছন্দে সুগ্রথিত ঐক্য লাভ করেছে। কবিতার রূপাবয়বে যে ঐক্য সাধিত হয় কবিতার আঙ্গিকনৈপুণ্যে সে ঐক্য ও সংহতি প্রবাহিত হয়।