‘গানের আড়ালে’ কবিতাটির বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই কবিতায় কবি নজরুলের রোমান্টিক ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। স্পষ্টই প্রতিভাত হয় কবি তাঁর প্রিয়াকে সঙ্গীত শিক্ষা দিতেন এবং সঙ্গীত শিক্ষার অন্তরালে শিক্ষার্থিনীর প্রতি আপন অনুরাগকে লালন করতেন। কবি প্রত্যক্ষভাবে তাঁর গানগুলির মধ্যে সেই অনুরাগকে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন এবং আশা করেছেন কবিপ্রিয়া তা হৃদয়ঙ্গম করে তার প্রতিদান দেবেন। কিন্তু কবির আশা ফলবতী হয় নি, কবির প্রচ্ছন্ন প্রেমকে কবিপ্রিয়া উপলব্ধি করতে পারেন নি। কবি তাঁর। এই ব্যর্থতায় বেদনাহত এবং অভিমানক্ষুদ্ধ। গানের বাণীতে কবি যে প্রেম নিবেদন করেছিলেন তা প্রিয়ার হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে নি-

“আমি শুধু তব কণ্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ নয়।”

সমগ্র কবিতাটিতে কবির প্রচ্ছন্ন এবং গানের সুর ও বাণীতে নিগূঢ় প্রেমের কথাই বলা হয়েছে। কবি তাঁর প্রিয়াকে যে গান শুনিয়েছেন বা শিখিয়েছেন তা কবির মর্মবাণীকে বহন করেছে, হয় তো তা সাধারণীকৃত প্রেমসঙ্গীত কিন্তু কবির বিশেষ অনুরাগের অনুভূতিকে তা বহন করেছে। তাই গানের অন্তরালবর্তী প্রেমের কথা বলা হয়েছে বলেই ‘গানের আড়ালে’ নামকরণের মধ্য দিয়ে কবিতাটির ভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

আলোচ্য কবিতাটিতে কবি নজরুলের প্রেমবিরহের সুরটিই অনুরণিত হয়েছে। নজরুল বিদ্রোহের কবি বা সাম্যবাদের কবি বলেই অধিক পরিচিত; কিন্তু প্রেম ও প্রকৃতিকে বিষয়ীভূত করে তিনি যে কাব্যরচনা করেছেন। তা-ও তাঁর কাব্যসাধনার একটি প্রধান ধারা। তিনি যেমন একদিকে রচনা করেছেন ‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’, ‘ফণি-মনসা’, ‘সর্বহারা’ প্রভৃতি কাব্য, তেমনি অন্যদিকে রচনা করেছেন ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘পূবের হাওয়া’, ‘চক্রবাক’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ প্রভৃতি কাব্য। এদের মধ্যে প্রেমের আনন্দ-উল্লাসের দিকটি যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি প্রেমের দুঃখ-বেদনা ও অভিমানের দিকটিও প্রতিফলিত হয়েছে। বস্তুতঃ প্রেমের দুঃখ-বেদনার কথাই নজরুল বেশি করে বলেছেন।

আলোচ্য কবিতাটি নজরুলের ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ‘চক্রবাক’ কাব্যের প্রধান বিষয় প্রেম ও বিরহ। ‘গানের আড়ালে’ কবিতাটিতে কবির প্রেমসাত দুঃখ, বেদনা ও বিরহ প্রকাশিত হয়েছে যা নজরুলের কবিমানসের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। গানের অন্তরালে সত্যকার প্রেমের অস্তিত্ব কবিপ্রিয়া উপলব্ধি করতে না পারায় প্রেমিক কবির অভিমানক্ষুব্ধ হৃদয়-বেদনাই উৎসারিত হয়েছে। তবে ‘গানের আড়ালে’ কবিতায় উচ্ছ্বাসের আতিশয্য এবং রচনার অসংযম রসপরিণতিতে কিছুটা বাধার সৃষ্টি করে। কিন্তু পরিশীলিত সংযম নজরুলের প্রতিভার পরিপোষক নয়। আবেগও তিনি স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ করেন এবং সেই আবেগের তীব্র বিস্ফোরণ-ই তাঁর অধিকাংশ কবিতার প্রাণ। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের অপরিমার্জিত উৎসার নজরুলের কবিতাকে এক সহজ সৌন্দর্যে মণ্ডিত করে—এই বৈশিষ্ট্য বাংলা সাহিত্যে নজরুলের কবিতাকে এক স্বাতন্ত্র্য দান করেছে।