কবিতা প্রধানতঃ দুই প্রকার—আত্মনিষ্ঠ বা মন্ময় কবিতা এবং বস্তুনিষ্ঠ বা তন্ময় কবিতা, গাথা কবিতা বস্তুনিষ্ঠ বা তন্ময় কবিতার অন্তর্গত। সাধারণত কোন কাহিনী গীতের মাধ্যমে বর্ণিত হয়ে গাথাকাব্যের আকার ধারণ করে। তাই সংক্ষেপে বলা যায় গাথাকাব্য একটি কাহিনী মূলক বস্তুনিষ্ঠ গীত।
অনেকে ব্যালাড (Ballad) এর সঙ্গে গাথা কবিতার সাদৃশ্য আছে বলে মনে করেন। কিন্তু ব্যালাড-এর সঙ্গে রয়েছে ব্যালে (Ballet) বা নৃত্যের যোগ। ব্যালাড-এ তাই গৌণরূপে কাহিনী থাকলেও তা নৃত্য ও গীতিমূলক। ব্যালাড-এ কাহিনী প্রধান হয়ে ওঠে না। কিন্তু গাথাকাব্য প্রধান কাহিনী এবং তা গীতিমূলক। এখানে গীত আছে কিন্তু কাহিনীর ভাগটাই প্রধান। গীতাশ্রয়ী এই কাহিনী পরিবেশনে গীতরস ফল্গুধারার মত সঞ্চারিত হয়ে থাকে। এখানে ব্যালের মত নৃত্যের স্থান নেই। প্রাচীনকালের পাঞ্চালী জাতীয় গাথা পরিবেশনে গায়কগণের চামরহাতে পদচারণা বা পায়চারীর কথা থাকলেও তা নৃত্যের গোত্রভুক্ত নয়। কাজেই কথাকাব্যের সংজ্ঞা নির্ণয়ে বলা যেতে পারে গীতের মাধ্যমে বা সংক্ষেপে কাহিনী পরিবেশনই গাথাকাব্যের বৈশিষ্ট্য। এবং এ লোকসাহিত্যের অন্তর্গত।
ইদানীং ইউরোপীয় ব্যালাড-এর সঙ্গে বাংলার গীতিকাব্যের একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলেও ভারতীয় সাহিত্যে গাথাকাব্যের একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে। ‘গাতব্য স্তোত্র’ রূপে ‘গাথা’ শব্দটির প্রথম প্রয়োগ বেদে পাওয়া যায়। বৈদিক ভাষার ভগিনীস্থানীয়া ইরানীয় ভাষাতেও ‘গাথা’ শব্দটি অজ্ঞাত নয়। অবশ্য ‘গাথা’ শব্দটি আদিতে ‘ছন্দোবদ্ধ ক্ষুদ্র স্তোত্র বা স্তুতিরূপ গীতি বা শ্লোক বা পদ’ অর্থেই ব্যবহৃত হত। পরে এই অর্থের প্রসার ঘটে। ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’ উক্তি-প্রত্যুক্তির মাধ্যমে একটি পুরাতন উপাখ্যানের সারাংশ ধৃত হয়ে আছে। পালি ও মিশ্র-সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্যেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতার সঙ্গে অনেক স্থলে উপাখ্যানের মূল কথা-বস্তু বিধৃত হয়েছে। ‘থেরগাথা’ ও ‘থেরীগাথা’ গ্রন্থদুটি এর উল্লেখ্য উদাহরণ। প্রাকৃতেও গাথা রচনার রীতি প্রচলিত ছিল। হাল কর্তৃক সংকলিত ‘গাথা-সপ্তশতী’ গ্রন্থটি প্রাকৃতে রচিত এইরূপ ক্ষুদ্রক্ষুদ্র প্রকীর্ণ গাথার সংগ্রহ।
আদিতে ‘গাথা’ অর্থে স্তুতিরূপ পদ বোঝালেও, কালক্রমে অর্থের প্রসার হেতু গাথা বলতে বোঝায় পৌরাণিক বা প্রাচীন কোন লৌকিক উপাখ্যান নিয়ে রচিত ক্ষুদ্র বা নাতিদীর্ঘ কবিতা, যা সুর সংযোগে গীত হওয়ার যোগ্য বা যা সুর করে আবৃত্তি করতে পারা যায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ‘গাথা’ বলতে এই-ই বোঝায়।
গাথা সাহিত্য সাধারণত অশিক্ষিত সাধারণ জনের মৌখিক রচনা। যা লোকের মুখে মুখে গীত হবার জন্যে রচিত হয়েছিল। ধর্মানুষ্ঠানমূলক গীতি, ঐতিহাসিক কিম্বদন্তী এবং লোকমুখে প্রচলিত ও প্রচারিত কিছু কিছু বিক্ষিপ্ত কাহিনী ক্রমে ক্রমে বড় আকারে দানা বেঁধে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের কথায় প্রথমে কতকগুলি ভাব টুকরো টুকরো কাব্য হয়ে সাধারণের মধ্যে ঝাঁক বেঁধে বেড়ায়। তারপর কোন একজন কবি সেই টুকরো কাব্যগুলিকে বড় কাব্যের সূত্রে এক একটা বড় পিণ্ড করে তোলেন। জটিলতা বর্জিত একটি পূর্ণাঙ্গ কাহিনী গ্রাম্য কবিগণ দ্বারা বর্ণিত হয়ে গীতের মাধ্যমে রূপ লাভ করে, গাথাকাব্যের আকার গ্রহণ করে, হয়ে ওঠে একটা কাহিনীমূলক গীতি। কাজেই বলা যায়, গাথাকাব্য বাংলার ছোট ছোট পল্লীসাহিত্যকে বৃহৎ সাহিত্যে বাঁধবার প্রয়াস। তাই সত্যকার সাহিত্যিক গাথা বলতে আমরা বুঝি তার মধ্যে আখ্যানভাগ বা বিশেষ একটি ঘটনা থাকবে। গল্পের কাহিনী হবে সরল ও অনাড়ম্বর ভাষায় বর্ণিত। গল্পাংশ বর্ণনায় নাটকীয় সংস্থান সৃষ্টি বিশেষ প্রয়োজনীয়। গাথা কবিতা বস্তু-নিষ্ঠ বলে এতে আত্মগত ভাব-কল্পনা অপেক্ষা জনগণ-নিষ্ঠ ভাব কল্পনার প্রাধান্য বেশি। কোন কোন গাথা কবিতায় যে ‘ধুয়া’ (Refrain) সৃষ্টি করা হয়, তা কবিতার আখ্যানভাগটিকে আমাদের দৃষ্টির সামনে অনলসভাবে জাগ্রত করে রাখে। গাথাকাব্যের গীতিকারদের অনেক সময় চারণ কবিরুপেও উল্লেখ করা হয়।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল, ঘনরাম, রূপরাম প্রভৃতির রচিত ধর্মমঙ্গল, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসা মঙ্গল বা মনসার ভাসান, শিবায়ন প্রভৃতি কাব্য, এমন কি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল এই শ্রেণীর কাব্যের উদাহরণ। ‘গোরক্ষবিজয়’, ‘ময়নামতীর গান’, ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ প্রভৃতিও গাথা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীন গাথাকাব্য বা গাথাগীতি সমূহকে বিষয় অনুসারে নানাভাগে ভাগ করা যায়। যথা (১) ধর্মাশ্রিত, (২) ইতিহাস আশ্রিত, (৩) প্রণয় আশ্রিত, (৪) বারমাস্যা প্রভৃতি।
লৌকিক বা স্থানীয় ধর্মজীবন তথা লৌকিক দেব বা দেবীকে অবলম্বন করেই ধর্মাশ্রিত কাব্য গড়ে উঠত। ইতিহাস ছিল মূলতঃ স্থানীয় কোন ঐতিহাসিক বা জনশ্রুতিমূলক ঘটনা। বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস রচনায় এই জাতীয় গাথাকাব্যগুলি অনেক ক্ষেত্রে আবার তথ্যের পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। বাঙালীর ইতিহাসের অনেক শূন্যস্থান ভরাট করে তুলতে সাহায্য করেছে। প্রণয় আশ্রিত গাথাকাব্যগুলিতে লৌকিক প্রেমকাহিনী বা নরনারীর প্রেমকথাই স্থান পেয়েছে। বারমাস্যাতে বাংলার ছয় ঋতুভেদে বারমাসের জনজীবনের বিবরণ সুন্দরভাবে বর্ণিত। এগুলি মৌখিক সাহিত্যরূপে প্রথমে গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি বিভিন্ন গ্রন্থে তা সংযোজিত হয়েছে। কাজেই এই গাথা সাহিত্যসমূহ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্তরালে যে সমাজজীবন, গ্রামীণ যে মোক্ষজীবন প্রবাহিত হয়ে চলেছিল তার অনেক খণ্ডচিত্র ধারণ করে, মধ্যযুগের বাংলা দেশের সামাজিক ইতিহাস রচনার পরিপূরক আবার তথ্যের ভাণ্ডাররূপে সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আধুনিক কালেও গাথা সাহিত্য রচনায় ছেদ পড়ে নি। তবে তা যুগোপযোগী রঙ ও রূপ ধারণ করে আধুনিক গাথা সাহিত্য হয়ে উঠেছে। আধুনিক কালে গাথাকবিতা রচনায় গীতিকবিতার সঙ্গে গাথার সংমিশ্রণ ঘটেছে বলে কেহ কেহ এগুলিকে ‘গীতিকাব্য’ নামে অভিহিত করতে চেয়েছেন। বাংলায় রবীন্দ্রনাথের ‘সিন্ধু তরঙ্গ’, ‘যেতে নাহি দিব’ প্রভৃতি কবিতার কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়, তাঁর ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যের ‘স্পর্শমণি’, ‘পণরক্ষা’ প্রভৃতি অনেকগুলি গাথা জাতীয় কবিতা আছে। এগুলিতে ইতিহাস, পুরাণ, উপনিষদ গ্রন্থিত হয়েছে। সত্যেন দত্তের ‘ইনসাফ’, কুমুদ মল্লিকের ‘শ্রীধর’ আধুনিক কালের নিদর্শন।
আরো পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, বাংলাদেশের কবি সুরাইয়া খানম্ প্রভৃতি কবি তাদের কিছু কিছু কবিতায় আধুনিক ভাবনাসিক্ত ও নতুন যুগের উপযোগী পুরাতন গাথাকাব্যকে নতুন রীতি ও নতুন প্রকরণে সাজিয়ে তুলেছেন। নিত্য প্রবহমানতার পথে গাঁথা যেন তার প্রবাহিত জলধারার রূপ, রঙ, স্বাদ পালটে চলেছে। তবু সে গাঁথাই।
Leave a comment