গাথাকাব্য হল তন্ময় কবিতার শ্রেণিভুক্ত। গাথা কবিতার ইংরেজি পরিভাষা ব্যালাড (Ballad)। ইতালীয় ভাষায় battare (বালারে) শব্দের অর্থ ছিল নৃত্য। কাজেই উৎপত্তির সময় ব্যালাড এর সাথে নৃত্যের একটি সংযোগ ছিল একথা অবশ্যম্ভাবীভাবে বলা যায়। অর্থাৎ নৃত্য সহযোগে গীত হত এমন জনপ্রিয় কোনো উপকথাকে নাটকীয় ভঙ্গীতে পরিবেশন করতো তাকেই বলা হত গাথা কবিতা। সরল স্বতঃস্ফূর্ত বর্ণনা ও সজীব সংলাপের মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে মুখে মুখে গীত হত গাথা কবিতা। গাথাকবিতার মূল রচয়িতা অজ্ঞাতই থেকে গেছেন। সাহিত্যরূপ হিসাবে ব্যালডকে অভিধানে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে— “A simple spirited poem in short stanzas narrating some popular story.” Shortion oxford dictionary.

ব্যালাড বা মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্যবলী নিম্নরূপ :

(১) ব্যালাডে থাকে এক শিশুসুলভ সারল্য।

(২) সহজ, সরল কথ্য ভাষারীতিই ব্যালাডের স্থান পায়।

(৩) ব্যালাডের বিষয় হল অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর্ণনাত্মক নাটকীয় ও মর্মস্পর্শী। 

(৪) নৈর্ব্যক্তিতা ব্যালাডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্যঞ্জন ও সুখ-দুঃখের কথা সেখানে বেশি ঠাঁই পায় না।

(৫) ব্যালাডের কাহিনি মূলত সংগৃহীত হয় বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় কাহিনি থেকে

(৬) চরিত্রের বাহুল্য ব্যালাডে থাকে না।

(৭) ব্যালাড ছোটো ছোটো স্বল্পসংখ্যক স্তবকে বিভক্ত হয়।

(৮) মূলত গীতোদেশ্যে নিয়েই ব্যালাড রচিত হয়।

বাংলা সাহিত্যের প্রথাগত ও প্রাচীন গাথাকবিতা হল মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা। আনুমানিক ষোড়শ শতকে রচিত ও গীত সেইসব আখ্যায়িকা বিভিন্ন ব্যক্তির রচনা বলে এগুলিতে গায়ক ও কবি মানসে পরিচয় না পেলেও মৈমনসিংহ গীতিকায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনচিত্র মেলে। আমাদের মধ্যযুগের সাহিত্যের মধ্যে লাউ সেন রঞ্জাবতীর কাহিনি, বা নাথ সাহিত্যে মীননাথ গোরক্ষনাথের কাহিনি ও ছিল ব্যালডের স্পর্শক্রান্ত। আর আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ব্যালাডের অনুসন্ধান শুরু করলে প্রথমেই রবীন্দ্রনাথের কথা ও কাহিনি এবং বেশ কিছু রচনার কথা স্মরণে আসবে যেগুলি গাথাকবিতার সমস্ত লক্ষণ বৈশিষ্ট্যই প্রায় বহন করেছে। বিশেষত বন্দিবীর ও পণরক্ষা কবিতাদ্বয়। এছাড়াও জসীমউদ্দীনের ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ কিংবা কবি কুমুদরঞ্জনই মল্লিকের ‘শ্রীধর’ও ব্যালডের অন্তর্ভুক্ত।

গাথা কার্যের সাথে আখ্যান কাব্যের বেশ কিছু সাদৃশ্যও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তবে প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে ব্যালাড নিজেই এক ধরনের আখ্যান কাব্য। প্রচলিত বা কল্পিত কোনো কাহিনিকে বর্ণাত্মক রীতিতে পরিবেশন করাই আখ্যান কাব্যেও মূল উদ্দেশ্য ব্যালাড বা গাথা কবিতা ও আখ্যান কাব্যের মূল পাথক্য হল আখ্যান কাব্যের বেশ কিছু শ্রেণি বিভাগ থাকে (যার অন্তর্গত ব্যালাড ও), যেমন নীতিকাব্য, রূপক কাব্য, ব্যঙ্গ কাব্য ও সর্বোপরি মহাকাব্য। অর্থাৎ আখ্যান কাব্যের পরিধি বিশাল কিন্তু সে তুলনায় ব্যালাডের এত বিস্তৃত কোনও শ্রেণিবিভাগ নেই। তার পরিধি ও কাল এত বিস্তৃত নয়। ব্যালাড সর্বদাই গীতাদ্দেশ্যে নিজেই রচিত হয়, কিন্তু আখ্যান কাব্য সর্বদা সেই উদ্দেশ্যে রচিত হয় না। এছাড়াও ব্যালাড ছোটো ছোটো স্বল্প সংখ্যক কিছু স্তবকে বিভক্ত হয়, কিন্তু আখ্যান কাব্য সর্বদা এই নীতি মেনে চলে না। যেমন আখ্যান কাব্যের অন্যতম প্রকরণ মহাকাব্যে তা যেমন শীর্যদেশে রচিত হয় না। তেমনি তাতে স্বল্প সংখ্যক ছোটো ছোটো স্তবক ও থাকে না। এইসব পার্থক্যটি পরিলক্ষিত হয় গাথাকাব্যের সঙ্গে আখ্যান কাব্যের।

এখন ব্যালাডের সাথে মহাকাব্যের ও বেশ কিছু সাদৃশ্য ও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, যেমন ব্যালাড ও মহাকাব্যে উভয়েই হল আখ্যান কাব্যের দুটি অন্যতম প্রকরণ। কিন্তু ব্যালাড ও মহাকাব্যের সাদৃশ্য ছাড়াও কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় যেমন ব্যালাড সহজ, সরল, কথ্য ভাষার প্রাধান্য সবর্দাই পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু মহাকাব্যের ভাষা সাধারণতঃ হয় গম্ভীর, ভাষায় থাকে ওজস্বিতা। দ্বিতীয়তঃ ব্যালাড মূলত গীতোদ্দেশ্যে রচিত হলেও মহাকাব্য কিন্তু কখনোই গীতোদ্দেশ্যে নিয়ে রচিত হয় না। তৃতীয়ত মহাকাব্যের পটভূমি হয় ব্যাপক বৃহৎ স্বৰ্গ, মর্ত্য পাতাল প্রসারী। কিন্তু ব্যালাড এত ব্যাপক, বৃহৎ পটভূমি থাকে না। কারণ ব্যালাড তো মহাকাব্যের মতো এত বিশাল বিস্তার থাকেই না। ব্যালাড স্বল্প সংখ্যক স্তবকে রচিত। চতুর্থত ও শেষ পার্থক্য হিসাবে বলা চলে শৃঙ্গার বীর ও শান্তরসের একটি প্রধান রস হতে হয় মহাকাব্যের এবং আশীর্বাণ, বা বস্তু নির্দেশ দিয়ে মহাকাব্যের সূচনা ঘটে। কিন্তু ব্যালাড এমন কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম বা নির্দেশ থাকে না।

এখন গাথাকাব্য, থেকে সাহিত্যের ধারা প্রভাবিত কিনা তা সংক্ষেপে আলোচনা করে দেখতে পারি গাথাকবিতার মূল শিকড় যে লোকসংস্কৃতিতে এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ ব্যালাড শব্দের উৎপত্তি প্রসঙ্গে আগেই বলা হয়েছে যে নৃত্য সহযোগে গীত হয় এমন কোনো জনপ্রিয় উপকথাকে নাটকীয় ভঙ্গিতে পরিবেশন করলে তাকেই বলে গাথা কবিতা। সুতরাং জন্মলগ্ন থেকেই গাথা কবিতা উপকথা তথা লোককথার (যা একান্তভাবেই লোক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত) সাথে সম্পৃক্ত। আর তাছাড়া ব্যালাড তো নৃত্য সহকারে গীতোদৃশ্যেই রচিত, আর লোক সাহিত্যের সাথে নৃত্যের একটি সম্বন্ধ আছে ও বাংলা সাহিত্যের প্রাগাধুনিক যুগে সবই ছিল সঙ্গীত, এ দুটি মন্তব্য স্মরণে রেখে বাংলা লোক সাহিত্যকেও ব্যালাড় জাতীয় রচনা কথা বলে। সুতরাং ব্যালাড বা গাথাসাহিত্য নিঃসন্দেহে লোকসাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত।