উত্তরঃ পলাশীতে মুসলমানদের পরাজয়ের সাথে সাথে ইংরেজ আমলের প্রারম্ভে মুসলিমদের সর্বৈব অবক্ষয় নেমে আসে। মুসলমানদের হাতে তখন উৎকৃষ্ট কোন সাহিত্য রচিত হয় নি। তখন আরবি, ফারসি, হিন্দি, বাংলা প্রভৃতি ভাষার সংমিশ্রণে আজগুবি সাহিত্যের চর্চা চলে, যা দোভাষী পুঁথি সাহিত্য নামে পরিচিত। এই দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের চারটি শাখা- প্রণয়কাব্য, যুদ্ধকাব্য, ধর্মবিষয়ক এবং পীর পাঁচালি। ‘গাজী কালু চম্পাবতী’ পীর পাঁচালি ধরনের একটি পুঁথি।
বনপীর, মানিকপীর ইত্যাদির চেয়ে ‘গাজী কালু চম্পাবতী’ অনেক বেশি জনপ্রিয়। বৈষয়িক জীবন, সমাজ, শাস্ত্র ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যান হচ্ছে ‘গাজী কাল চম্পাবতী’। এ উপাখ্যানের রচয়িতা হচ্ছেন উনিশ শতকের শায়ের আব্দুল গফুর, আব্দুর রহিম এবং বিশ শতকের সৈয়দ হালু মিয়া৷
‘গাজী কালু চম্পাবতী’ উপাখ্যানটি এরূপ- বিরাটনগররাজ শাহ সিকান্দারের পুত্র জুলহাস পাতালপুরীর রাজকন্যা পাঁচতুলাকে বিয়ে করে সেখাইে রয়ে গেল। সিকান্দারের রানী বালরাজকন্যা অজুপা ভেলায় ভেসে আসা এক শিশুকে অপত্য স্নেহে পালন করতে থাকে। এ শিশুর নাম কালু। কিছুকাল পরে রানীর একটি ছেলে হল। তার নাম রাখল বড় খাঁ গাজী। গাজী-কালু একই সাথে মানুষ হতে থাকল। দুজনের মধ্যে খুব ভাব এবং দুজনই ধর্মপ্রাণ। বয়স দশ বছর যখন গাজীর তখন বাদশাহ সিকান্দার তাকে রাজকার্য দেখতে বা শিখতে বললে গাজী রাজত্বে অনীহা প্রকাশ করে। গাজী এবং কালু দুজনেই সংসার বিবাগী স্বভাবের। একদিন কালুকে নিয়ে ঘর ছাড়ল গাজী। গাজী ইতোমধ্যে খওয়াজ খিজিরের ও গঙ্গা দুর্গা শিবের স্নেহপ্রাপ্ত হয়ে অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয় এবং সে বাঘ-কুমির, জ্বিন- পরীর মান্য হয়ে যায়। কেরামতির মাধ্যমে তারা গিয়ে পৌঁছায় সুন্দরবনে। ফকিরেরা কখনো এক স্থানে থাকতে পারে না, তাই তারা চলতে চলতে ক্ষুধার্ত হয়ে দু ভাই রাজবাড়িতে গেল খাদ্য পাবার আশায়, কিন্তু হিন্দু রাজা মুসলমানকে আহার্য দিতে রাজি হল না। তারা অপমানিত হয়ে ফিরে এল। অপমানিত গাজীর মনে জাগল প্রতিশোধস্পৃহা। গাজী মনে মনে বলে, এ রাজার ঘরে আগুন যদি লেগে যায়, রাজার সব লোক যদি ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়, রানীকে যদি অন্যে ধরে নিয়ে যায়, তবে সে খুশি হবে। সত্যিই তাই ঘটল। ঘর পুড়ল, রানীকে জিনে নিয়ে এক মসজিদে রাখল, সব হিন্দু মুসলমান হয়ে গেল।
দক্ষিণরায়ের ভক্ত দক্ষিণ রাজ্যের রাজা মুকুটরায়ের কন্যা চম্পাবতী। এক রাতে পরীরা ঘুমন্ত গাজীকে চম্পাবতীর মহলে নিয়ে গেল। রাত্রে চম্পা ও গাজীর ঘুম ভাঙার পর তাদের মধ্যে পরিচয় হল। গাজীকে মুসলমান জেনে চম্পা ক্রুব্ধ হল বটে, কিন্তু ভাগ্যকে মেনে নিয়ে উভয়ের অঙ্গুরি বিনিময় করে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। পরীরা শেষ রাতে ঘুমন্ত গাজীকে সোনাপুরে রেখে আসে। সকালে চম্পা তার মাকে রাতের ঘটনা জানায়। শিবের কৃপায় চম্পাবতী সর্বক্ষণ গাজীকে প্রত্যক্ষ করছিল। এদিকে বিরহ ব্যাকুল গাজীও অধৈর্য হয়ে কালুকে নিয়ে গেল রাজধানী ব্রাহ্মণনগরে। কান্তিপুরে কদমতলায় আস্তানা গেঁড়ে গাজী কালুকে ঘটক করে পাঠাল। কিন্তু চম্পার বাবা রুষ্ট হয়ে ঘটক কালুকে বন্দী করে রাখে। বাঘের পীর গাজী তখন ভেড়ার অবয়বে সুন্দরবনের বাঘ বাহিনী লেলিয়ে দেয় ব্রাহ্মণনগরে । রাজা মুকুটরায় দক্ষিণরায়কে স্মরণ করে। ফলে দক্ষিণরায়ের সাথে গাজীর ভীষণ যুদ্ধ হয়। দক্ষিণরায় গঙ্গার অনুগত কুমির বাহিনীর সাহায্য চায়, কিন্তু গাজীর বিরুদ্ধে গঙ্গা সাহায্য করতে সাহস পায় না। কিন্তু গোপনে কুমির নামিয়ে দিল। কুমিরের দাপটে বাঘ হটতে লাগল। তখন গাজী প্রচণ্ড রোদ কামনা করল, রোদের অসহ্য তাপে কুমির ডুবল জলে। গৌরীর বরে দক্ষিণরায়ের পক্ষে এল ভূত-প্রেত-পিশাচ। এদের ভয়ে বাঘ পালালো। এবার যুদ্ধ শুরু হল দক্ষিণরায়ের সাথে গাজীর। সে যুদ্ধে গদা, আষা, খড়ম, ছুরি ইত্যাদি ছোঁড়াছুঁড়ি হয় । অবশেষে রায় পরাজিত হয়ে মাফ চায়৷
এবার রাজা মুকুটরায় নামে যুদ্ধে। জীয়ককুণ্ডের সাহায্যে মৃত সৈনিকদের জীবিত করার ব্যবস্থা করবার আগেই গাজীর বাঘেরা বুদ্ধি করে সে কুণ্ডে গোমাংস ফেলে অপবিত্র করে দিল। নিরুপায় রাজা পরাজিত হয়ে গাজীর সাথে চম্পাবতীর বিয়ে দিল।
ইসলাম প্রচারক গাজীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করে হিন্দু সমাজে ইসলামের প্রচার ও প্রসার এ উপাখ্যানের উদ্দেশ্য। তাছাড়া তুর্কি বিজয়ের পর হিন্দু সামন্তের সাথে ইসলাম প্রচারক দরবেশদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরোক্ষ সাক্ষ্যও বহন করে এ উপাখ্যান। ‘গাজী কালু চম্পাবতী’ কাহিনী নিয়ে একাধিক কবি পুঁথি রচনা করেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ পুঁথিগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। গাজী কালু চম্পাবতী কাহিনী নিয়ে আব্দুল হাকিম, আব্দুল গফুর, সৈয়দ হামজা প্রমুখ কবি পুঁথি রচনা করেছেন।
Leave a comment