নামকরণের মধ্য দিয়ে সবকিছুকে সুচিহ্নিত করার অভ্যাস মানুষের সুপ্রাচীন অভ্যাস। কিন্তু নামকরণ সঠিক হওয়া বাঞ্ছনীয় কারণ অপ্রিয় পাত্রে সুধা ঢেলে লাভ নেই। প্রকৃত পাত্রে সুধা ঢালা প্রয়োজন। ব্যক্তির নামকরণের ক্ষেত্রে একরকম আর সাহিত্যের ক্ষেত্রে আর একরকম। সাহিত্যে বক্তব্যের বিষয়ের একটা ইঙ্গিত নামকরণের মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে এবং যেহেতু সাহিত্যিক তাঁর রচনা শেষ করার পরই রচনার নামকরণ করেন সেহেতু সেই নামকরণ বিষয়গত বা ভাবগত সার্থকতা অসার্থকতার প্রশ্ন এসেই যায়। নামকরণ অনেক ধরনের হয়— চরিত্রগত নামকরণ, ঘটনাগত নামকরণ, নায়ক নায়িকগত নামকরণ।
রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পে কোনো চরিত্র বা বিষয় প্রধান হয়ে ওঠেনি। এখানে একটি রাত্রির পরম অভিজ্ঞতা বা অনুভবকে তুলে ধরাই যদিও গল্পটির উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্যের কথা মনে রেখেই প্রথম দিকে আখ্যানধর্মী কাহিনির সূত্রপাত হয়েছিল, তবু গল্পটি বিষয়কেন্দ্রিক নয়, ভাবকেন্দ্রিক। সমস্ত ব্যবহারিক ও লৌকিক অর্থ তাৎপর্যকে ছাড়িয়ে গল্পটি বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং অনুভূতির এক সৌন্দর্যলোকে পাঠকমনকে পৌঁছে দিয়েছে। “একটি শান্ত, ত্যাগে জীবনের ‘পরম লগনকে’ লাভ করবার রোমান্টিক তৃপ্তিতে অপরূপ সুরঝংকার এতে বেজে উঠেছে।” লৌকিক প্রয়োজনের কোনো চরিতার্থতা এতে নেই— এর মধ্যে বাঁশির সুরের আনন্দময় মুক্তি। সুতরাং আমরা বলতে পারি গল্পটি কাব্যধর্মী।
জীবনের পরম মুহূর্তটিকে উপস্থাপন করতে গিয়ে গল্পকথার প্রয়োজনে কিছু কিছু ঘটনার বিন্যাস এখানে থাকলেও ঘটনার পরিণামে গল্পটি শেষ হয়নি। শেষ হয়েছে নায়ক মনের অনুপম এক অনুভূতিকে আশ্রয় করে। এক পরম মুহূর্তের প্রাপ্তি সমস্ত গল্পটিকে পরিণতিতে পৌঁছে দিয়েছে। আর নায়ক মনে সেই পরম মুহূর্তটি এসেছে বিশেষ এক রাত্রির এক বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে। নায়কের কথায় “আর সমস্ত জলমগ্ন হইয়া গেছে, কেবল হাত পাঁচ-ছয়-দ্বীপের ওপর আমরা দুটি প্রাণী আসিয়া দাঁড়াইলাম। তখন প্রলয়কাল, তখন আকাশে তারা, আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ নিবিয়া গেছে … কেবল দুই জনে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিলাম, পদতলে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ উন্মত্ত মৃত্যুস্রোত গর্জন করিয়া ছুটিয়া চলিল … এখন কেবল আর একটা ঢেউ আসিলেই পৃথিবীর এই প্রান্তটুকু হইতে বিচ্ছেদের এই বৃত্তটুকু হইতে আসিয়া আমরা দুজনে এক হইয়া যাই। সে ঢেউ না আসুক।…আমি এই একরাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।”
এখানে গল্পটির মহামুহূর্ত। এরপর রাত্রি শেষ হয়ে গেল। ঝড় থেমে গেল। জল নেমে গেল। সুরবালাও কোনো কথা না বলে বাড়ি চলে গেল। কিন্তু ওই রাত্রি নায়কের মনের তন্ত্রীতে যে সুর জাগিয়ে গেল, সেই খণ্ডকালের সুরের মধ্যেই লাগল অনন্তের স্পর্শ। সেই একরাত্রির পরম অনুভব নায়কের জীবনে সমস্ত দিন ও রাত্রির সামান্যতাকে অসামান্য তাৎপর্যে মণ্ডিত করে তুলল। নায়ক তাই গল্পের শেষ অংশে বলেছে “আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অন্ত রাত্রির উদয় হইয়াছিল। আমার সমস্ত পরমায়ুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।”
তাই বলতে হয় ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়ক-নায়িকাকে পাবার জন্য তাঁর মনকে উদ্দীপিত করেনি। প্রেমের খণ্ড ক্ষুদ্রতা বিলীন হয়ে গেছে। দেহ প্রেমের বাসনা-বিহীন ক্ষণমিলন হয়ে উঠেছে চিরকালের মহিমায় ভাস্বর। এখানে কোথাও মৃত্যু কোথাও বিচ্ছেদ নেই। নায়ক মনের এই পরম উপলব্ধিতেই তার মনের অশান্তি, অতৃপ্তি, সমস্ত ক্ষোভের অবসান হয়েছে। তাই মহাপ্রলয়ের শেষরাত্রির অবসানে নবসূর্য উদয়ের প্রাকৃক্ষণে ওই পাওয়ার আনন্দে তার মন ভরে উঠেছে। আর এই প্রশান্তি, এই দুর্লভ অনুভবের মনে এনে দিয়েছে ওই একরাত্রির ঘটনা। তাই অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য “একরাত্রি ছাড়া এ গল্পের নামান্তর কল্পনা করা চলে না—Only one night but the eternal night” তাই এই নামকরণ সার্থক ও ব্যঞ্ছনাধর্মী।
Leave a comment