অনেক ক্ষেত্রে লেখক প্লট বা আখ্যানভাগের চাইতে অনেক বেশি নজর দেন চরিত্রের মন, মনন, মেজাজ ও মানসিকতার দিকে প্রতীক সংকেত— অনুষঙ্গের এক ইঙ্গিতময় ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে। যে গল্পে চরিত্র সমূহের অন্তর্মানস, মনের বিচিত্র গতিবিধি, কাহিনির প্রথাগত কাঠামোকে লঙ্ঘন করে এক অন্তর্ময় পরিবেশ রচনা করে আমরা তাকে সাধারণভাবে মনস্তত্ত্বমূলক গল্প বলে থাকি।

‘কঙ্কাল’ গল্পের নায়িকা পুরুষের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখেছে, দেখে মুগ্ধ হয়েছে। বাল্য বিধবার অবদমিত কামনা বাসনা শশীশেখরকে আশ্রয় করে মুক্তির পথ খুঁজেছে এ বিশ্বচরাচরে সর্বত্র বন্ধনের জাল পাতা, প্রেম, ভালোবাসা, প্রীতি, আত্মীয়তা কর্ম ও সমাজ অনুশাসনে এই বন্ধন থেকে কখনো কখনো মানুষ মুক্তি খুঁজেছে। এই মুক্তির অবশ্য দুটো রূপ। কখনো তা সম্পূর্ণ বন্ধন মোচন, কখনও বা এক বন্ধন ছিন্ন করে অন্য বন্ধনে আশ্রয় খোঁজে। এই বিধবা নারীটি সমাজ শৃঙ্খলকে ছিন্ন ভিন্ন করে ডাক্তার শশিশেখরের প্রেমবারি সিঞ্চনে নিজের উত্তপ্ত কামনা-প্রবাহকে শীতল করতে চেয়েছিল।—“….কঙ্কাল গল্পের নায়িকার মানস গঠন অন্য প্রেমময়ী নারীর তুলনায় পৃথক। সে ছাড়তে শেখেনি। কেবল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল। সে বলতে পারে না—

“তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও 

আমি যত দুঃখ পাইগো ?”

তাই ডাক্তারের বিয়ের খবরে সে প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠেছে। দুর্বার হলে বুঝি এমনই হয়। বিশেষ করে যেখানে সমাজ প্রতিবন্ধক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমাহীন আক্রোশে সে ডাক্তারকে হত্যা করে নিজেও আত্মঘাতী হয়েছে। প্রেমে ঈর্যা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তা সীমাহীন হলেই সমস্যা গুরুতর চেহারা নেয়। দুরন্ত কামনার সমুদ্রে ডুব দিয়ে সে ভালোবাসা ও মরণকে পৃথিবীময় ব্যাপ্ত রূপে দেখেছে। মৃত্যুতেও সে তাই হাসতে পারে এবং ভাবতে পারে—“যখন লোকে আসিয়া আমাকে দেখিবে তখন এই হাসিটুকু যেন রঙিন নেশার মতো আমার ঠোটের কাছে লাগিয়া থাকে।” ‘কঙ্কাল’ গল্পে সমাজ সমস্যা থাকলেও অতৃপ্ত কামনায় জর্জরিত নারীর জটিল মনস্তত্ত্বের রূপটাই গল্পটিকে আস্বাদ্য করে তুলেছে।

এই জটিল মনস্তত্ত্বের ছবি ‘মহামায়া’ গল্পের মহামায়া চরিত্রের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। সে রাজীবকে ভালোবাসে তার প্রতি রাজীবের প্রেমকে উপভোগ করে। প্রেমিকের ভিক্ষুক মূর্তি তাকে আরো গরবিনী করে তোলে। সে জানে রাজীবকে সে করুণা করতে পারে—যখন ইচ্ছে যেমন খুশি ঠিক তেমনি ভাবে। মহামায়া আত্মরূপমুগ্ধ নয়। কিন্তু রূপ সচেতন ও আত্মসচেতন। কৌলিন্য প্রথার আচারসর্বস্বতা তার আপদের কারণ। দাদা ভবানীচরণের সামনে রাজীবকে সে যখন বলে “তোমার ঘরেই আমি যাইব।” কিংবা জ্বলন্ত চিতা থেকে উঠে রাজীবের কাছে আশ্রয় নেয়। তখন তার অসন্তোষ ও প্রতিবাদী রূপের প্রকাশ ঘটে।

আবার রাজীবের বিয়ের প্রস্তাবে তার অসম্মতি প্রকাশ কুলীন প্রথার সমর্থনকারিনী এবং দম্ভের প্রকাশক। কুল গৌরব এবং কুলত্যাগ-এর দ্বন্দ্বে মহামায়া হয়তো নিজেই নিজের ভিতর জর্জরিত ছিল। প্রেম ও করুণার পার্থক্য তার অজানা ছিল বলেই রাজীবের প্রণয়ের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি। মহামায়ার রূপ সম্পর্কে লেখক বলেছেন—“ “যেন শরৎকালের রৌদ্রের মতো কাঁচা সোনার প্রতিমা। সেই রৌদ্রের মতোই দীপ্ত এবং নীরব এবং তাহার দৃষ্টি দিবালোকের ন্যায় উন্মুক্ত এবং নির্ভীক।” এরকম নারীর রূপদগ্ধ চেহারা কীভাবে গ্রহণ করবে এমন সংশয় মহামায়ার মধ্যে থাকাটাই স্বাভাবিক। জ্বলন্ত চিতা থেকে মহামায়া রাজীবের কাছে আসে এবং ঘোমটার আড়াল দিয়ে শর্তসাপেক্ষ থাকতে আরম্ভ করে। একদিন বর্ষাকালে মেঘের আড়ালে চাঁদ দেখা দিলে রাজীবের মনের বাঁধন খুলে যায়। যা না পাওয়ার সেদিন তাই পেতে চাইল নিবিড়ভাবে। ঘোমটার আড়াল সরিয়ে, নিষেধের দেয়াল ভেঙে রাজীব তাই সেদিন দেখলো মহামায়াকে এবং নিজেই নিজের হাতে চির বিচ্ছেদের প্রাচীর তৈরি করে। মহামায়ার চলে যাওয়া জীবন থেকে পলায়ন নয়, জীবনকে ভালোবেসে জীবনের অন্যতর অর্থ খোঁজা।

‘শাস্তি’র চন্দরা মনস্তত্ত্বের জটিলতায় পাঠককে ভাবিয়েছে। গল্পের প্রধান বিষয় বাড়ির বড়ো বউ রাধা হত্যা এবং হত্যার দোষ চাপে ছোটো বউ চন্দরার উপর। সামান্য এক নিম্নবিত্ত পল্লিবধূর ব্যক্তিত্ব অপ্রত্যাশিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। কারণ স্বাভাবিকতার ভিতটি লেখক নিজেই তৈরি করেছেন। গল্পের দ্বিতীয় ভাগে তার পরিচয় আছে—ছিদাম রামলোচন চক্রবর্তীর কাছে চন্দরাকে দোষী বলে ঘোষণা করেছে দাদার প্রতি তীব্র ভালোবাসায় নয়। যদিও সে বলেছে—“ঠাকুর বউ গেলে বউ পাইব কিন্তু আমার ভাই ফাঁসি গেলে আর তো ভাই পাইব না।” যুবতী চন্দরা সম্পর্কে ছিদামের অস্বস্তির কারণ চন্দরা চটুল ও চঞ্চলা প্রকৃতির। অথচ ছিদাম নিজের ঘরে যুবতী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য বধূদের প্রতি উদাসীন ছিল না। তাই চন্দরার ভাবনা ‘আমার স্বামীটির চতুর্দিকেই নজর’ । ছিদাম, চন্দরাকে যথেষ্টই ভালোবাসতো। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনায় ছিদাম, চন্দরাকে দোষী সাজিয়ে বলল দোষ স্বীকার করে নিতে। আশ্বাস দিয়ে বলে—“তোর কোনো ভয় নাই আমরা তোকে বাঁচাইয়া দিব।” মূর্তির মতো চন্দরা সব শোনে কিন্তু কিছু বলে না। ভিতরে ভিতরে প্রতিবাদের প্রাচীর গড়ে তোলে। সেই প্রাচীর ভেদ করে দাম্পত্য জীবনের কোনো সুখস্মৃতি প্রবেশের পথ পায় না। জীবনের কাছে বঞ্চনা পেয়েছে বলে মৃত্যু তার কাছে বন্ধু হয়ে গেছে। তাই জর্জ সাহেবকে বলেছে—“তোমাদের যাহা খুশি তাই করো, আমার তো আর সহ্য হয় না।” মনের অসীম জোের নিয়ে মৃত্যুর আগে মাকে দেখতে চেয়েছে স্বামীকে নয়। স্বামী তাকে দেখতে চাইলে তীব্র ঘৃণায় বলেছে ‘মরণ’ কথাটি। তার এই মানসিক জোর দেখে পাঠককূল অবাক হয়ে যায়।

পরিশেষে বলা যায় যে মানুষের মন সাহিত্যের বিষয় হলেও তা চিরকালই অধরা থেকে গেছে। আসলে মানুষ নিজেকেই চিনতে পারেনি। সেই সূত্রেই পরিচিত জগতের মধ্যে এক অপরিচিত ভাবনা অকস্মাৎ আবির্ভূত হয়ে জটিলতার সৃষ্টি করে। এই জটিলতাই হল মনস্তত্ত্বের উপপাদ্য বিষয় যা বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সবসময় সম্ভব হয় না। এর মূলে আছে মনের বিচিত্র গতি। আবার সে মন যদি হয় নারী মনের তত্ত্ব।