শিলাইদহ ও সাজাদপুরের জীবনযাত্রায় পল্লি জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অধিকাংশ ছোটোগল্পের প্রেরণার বস্তু। “একসময় ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলার নদীতে নদীতে, দেখেছি বাংলার পল্লির বিচিত্র জীবনযাত্রা, ….এক সময় মাসের পর মাস আমি পল্লি জীবনের গল্প রচনা করে এসেছি।” লেখকের এই বক্তব্য থেকে সহজেই অনুমেয়—যে সমস্ত গল্পের মূল বিষয় পল্লি জীবন ও সমাজ, সেই সকল গল্পের সৌন্দর্য বর্ধনে প্রকৃতির এক বিস্তৃত পটভূমি আবশ্যক। আমাদের অজানা সেই একমাত্র পল্লি জীবনকে কেন্দ্র করেই প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত রূপটি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। বাঙালি জীবনের বাঙালি সমাজের বাস্তব জীবনকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সূত্রে ধরতে যাওয়ার সাথে সাথে প্রকৃতি রাজ্য কী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই সমাজ ও সংসারের প্রতিটি পরতে পরতে তা রবীন্দ্রনাথ তার বিভিন্ন ছোটোগল্পের মধ্যে দিয়ে আমাদের জানিয়েছে, গল্পের প্লট চরিত্র, কাহিনি নির্মাণের ফাঁকে আশ্চর্য কৌশলে পল্লি জীবনের প্রতি অন্তরঙ্গতাকে স্পষ্ট করেছেন, যে প্রকৃতি মাঝে মাঝে গল্পের একটা চরিত্র হিসাবে বিধৃত হয়ে আছে। প্রকৃতির প্রাধান্য স্বীকৃতি পেয়েছে, এমন একটা গল্প হল ‘সুভা’।
‘সুভা’ গল্পটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পাঠ করলে দেখা যাবে প্রকৃতি, এক বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ পল্লিজীবনের প্রতি গভীর আসক্তিবশত প্রকৃতি আসল মাধুর্যময় স্বরূপটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন বলেই এমন নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। শিলাইদহে পদ্মার বোটে অবস্থান কালে একদিকে প্রকৃতি আর একদিকে মানুষ, নিবিড় ভাবে উভয়কে পর্যবেক্ষণের দ্বারা তিনি বোধ করি এ গল্পের প্লট নির্মাণ করেছেন, তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে নিত্য চলমান প্রকৃতির অপূর্ব রূপের প্রেক্ষাপটে চলিষ্ণু জীবনের বৈচিত্র্যময় রূপ আবিষ্কারের নেশায় তাঁর মানস দুয়ারে এক নতুন পথরেখা উন্মুক্ত হয়েছিল। তাই ‘সুভা’ গল্পের প্রকৃতিময়তা ও কাব্য ধর্মিতার এক অনুপম মেল বন্ধন ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলেন। এ গল্পের নেপথ্যে পদ্মার বিচিত্র প্রকৃতি ও মানবজীবন দুই-ই তাকে প্রভাবিত করায় মানুষ ও প্রকৃতির এমন অঙ্গাঙ্গি যোগসূত্র রচিত হয়েছে। ‘সোনার তরী’ কাব্যের বসুন্ধরা কবিতায় তিনি স্পষ্ট বলেছেন—
“প্রবাহিয়া চলে যাই সমস্ত ভূলোকে
প্রান্ত হতে প্রান্ত ভাগে, উত্তরে দক্ষিণে
পূরবে পশ্চিমে।”
পদ্মার এই চলমান গতিকে সচক্ষে প্রত্যক্ষ করেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রকৃতিমূলক ছোটোগল্পের অবতারণা।
তবে একথা মানতেই হয়, পদ্মার এই চলমান গতির মধ্যেই লেখক বোধহয় মানুষের গতিময় জীবনের সন্ধান পেয়েছিলেন, ‘বলাকা’ কাব্যে তিনি পরবর্তীকালে এ সম্পর্কে স্পষ্ট করেছেন। যাই হোক, পল্লির মানুষ প্রকৃতি এবং পদ্মার এই ত্রিবেণী সঙ্গমে কবির এই জগবন্ধু বিশিষ্টরূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। পদ্মাকে উদ্দেশ্য করে তাঁর চৈতালী কাব্যে বলেছিলেন—
“হে পদ্মা আমার
তোমায় আমায় দেখা শত শতবার …
সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমায়
তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরাণ ।”
গল্পের আঙ্গিক বিন্যাসে এসকল প্রেক্ষাপট বা লেখকের কবিমানস যে বিশেষ সহায়ক ছিল তা স্বীকার করতে হয়।
অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন—“সত্যই রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য সমস্ত শ্রেণির রচনার ন্যায় তাঁহার ছোটোগল্পগুলিও কাব্যধর্মী, কাব্যের বিশেষ গুণ বলিতে যাহা বুঝি—যেমন কল্পনার প্রাচুর্য, অলংকার বহুলতা প্রভৃতি—তাঁহার অন্যান্য শ্রেণির রচনার মতো ছোটোগল্পে অবশ্যই আছে।” নির্দ্বিধায় বলা যায় ‘সুভা’ গল্পটি এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, বাণীকণ্ঠের দুই মেয়ে সুকেশিনী ও সুহাসিনীর পর তৃতীয় বার যে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল তার নাম রাখা হয় সুভাষিনী। অর্থাৎ ‘সুভা’, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সুভাষিনী হওয়া সত্ত্বেও সে আজন্ম বোবা হয়েই রইল, এই বোবা মেয়েকে নিয়ে বাবা, মা পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজন যে উৎকণ্ঠা এবং অবজ্ঞা মিশ্রিত ব্যবহার গল্পের মাঝে প্রকট হয়ে উঠেছে তা সত্যিই অস্বস্তিকর। বোবা মেয়ে সুভা বিধাতার অভিশাপ মাথায় নিয়ে আপন ভাগ্য মেয়ে নিয়ে স্নেহ, প্রেম, প্রীতি ভালোবাসায় বঞ্চিত হয়ে স্নেহময়ী রূপিণীর প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নেয়। দৈনন্দিন জীবনে এই প্রকৃতির সঙ্গে ভাব বিনিময়ই সুভার নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। এই প্রকৃতির বুকেই তার নিশ্চিন্ত আশ্রয় হল।
‘সুভার’ চরিত্র রূপায়ণে লেখক বর্ণনা করেছেন—“এই বাক্যহীন মনুষ্যের মধ্যে বৃহৎ প্রকৃতির মতো একটা বিজন মহত্ত্ব আছে…..সে নির্জন দ্বিপ্রহরের মতো শব্দহীন এবং . সঙ্গীহীন”। সুভাদের গ্রাম চণ্ডীপুরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে একটা স্রোতস্বিনী, সে সুযোগ পেলেই মনুষ্য সান্নিধ্য এড়িয়ে এই স্রোতস্বিনীর তীরে এসে বিশ্রাম নিত। এও বেশ ভালো, মানুষ হয়ে মানুষের কাছে এই বোবার জন্যেই বারে বারে লাঞ্ছিত, ভৎসিত, হওয়ার চেয়ে এই নির্জন প্রকৃতির একেবারে নিকট সান্নিধ্যে চুপি চুপি বসে ভাব বিনিময় বড়ো সুখকর এখনে নদীর কলধ্বনি, পাখির ডাক, মাঝির গান, লোকালয়ে কোলাহল সমস্তই এই নীর প্রান্ত এসে আছড়ে পড়ে। “প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ ও বিচিত্র গতি, ইহাও বোবার ভাষা—বড়ো বড়ো চক্ষুপল্লব বিশিষ্ট সুভার যে ভাষা তাহারই একটা বিশ্বব্যাপী বিস্তার; ঝিল্লির পূর্ণ তৃণভূমি হইতে শব্দাতীত নক্ষত্রলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত ভঙ্গি সংগীত ক্রন্দন এবং দীর্ঘ নিশ্বাস।” বোবা হয়ে জন্মানোয় সুভার অন্তরে ছিল অশেষ দুঃখ বিষাদ। সংসারে এর জন্য এসে প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল, তাকে সঙ্গে দিতে তার যাবতীয় হৃদয় মথিত ব্যথা বেদনা পরিস্ফুট করার জন্য প্রকৃতির প্রেক্ষাপট রচনা করে লেখক সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রকৃতিকে এত নিবিড়ভাবে জানতে না পারলে হয়তো ‘সুভার’ মনের যন্ত্রণা, কাতরতা আমাদের কাছে অধরাই থেকে যেত। প্রকৃতি যেমন নীরব উদাসীন কোনও কিছুতে প্রতিবাদ নেই, সুভাও তেমন, বসুন্ধরার উদাসীনা দ্বিপ্রহরের মতো—“একটি বোবা মেয়ে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত—একজন সুবিস্তীর্ণ রৌদ্রে আর একজন ক্ষুদ্র তরুচ্ছায়ায়।” প্রকৃতি ও মানবের কী আশ্চর্য মেলবন্ধন।
কৈশোরের অস্তিমলগ্নে যৌবনের অলক্ষ্য পদধ্বনীতে সচকিত হয়ে সুভা যখন ব্যাকুল, সেই প্রেক্ষাপটে লেখক বর্ণনা করেছেন—”যৌবনের রহস্যে পুলকে বিষাদে অসীম নির্জনতার একেবারে শেষ সীমা পর্যন্ত এমনকি তাহা অতিক্রম করিয়াও থমথম করিতেছে, একটি কথা কহিতে পারিতেছে না। এই নিস্তব্ধ ব্যাকুল প্রকৃতির প্রান্তে একটি নিস্তব্ধ ব্যাকুল বালিকা দাঁড়াইয়া।” পিতা মাতার দুর্ভাবনার শেষ হতে চলেছে। সুভাকে এবার বিবাহের জন্য পল্লির পাট চুকিয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে শহরে যেতে হবে, পল্লির সঙ্গে এই আকস্মিক নির্বাসন ‘সুভা’ বিহ্বল ব্যথিত, আশংকিত—আসন্ন বিচ্ছেদে—বড়ো বিমর্ষ—“সেদিন শুক্লা দ্বাদশীর রাত্রি। সুভা শয়নগৃহ হইতে বাহির হইয়া তাহার সেই চির পরিচিত নদী ঘাটে শম্প শয্যায় লুটাইয়া পড়িল—যেন ধরণিকে, এই প্রকাণ্ড মুক মানব মাতাকে দুই বাহুতে ধরিয়া বলিতে চাহে—তুমি আমাকে যাইতে দিও না মা, আমার মতো দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখ।” প্রকৃতি মাতার কোল থেকে বিবাহ উপলক্ষে সুভাকে বিচ্ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে এক ট্র্যাজিক রস সঞ্চারিত হয়েছে। তাই ‘সুভা গল্পের আবেষ্টনের মধ্যে প্রকৃতির লোকের এই দুর্নিবার আধিপত্য স্থাপিত হয়েছে।
‘সুভা’ গল্পের আবেষ্টনের মধ্যে একপ্রকার কাব্যিক ব্যঞ্জনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। এ গল্পের আয়ত স্বল্প, পরিমিত বক্তব্য, সংহত বাক্য, সংজমী শব্দ সংযোজনায় অনুপম সুর সন্নিবেশিত হয়েছে। সুভা বাল্যকাল থেকে বোবা হয়ে থাকায়, তার ভালো লাগা, মন্দ লাগা, সুখ দুঃখ, সাধ আল্লাদ কী ? সে প্রকাশ করতে যেমন অক্ষম ছিল, আমরা বুঝতেও তেমন অক্ষম ছিলাম, এই কারণেই বোধহয় বোবা মেয়ে সুভাকে সম্পূর্ণরূপে আবিষ্কার করার জন্যে লেখক প্রকৃতির দ্বারস্থ হয়েছে। প্রকৃতি যেমন সর্বদা নীরব মূক, অথচ তার বাহ্য রূপ দেখে আমরা সমস্ত প্রত্যক্ষ করি ঠিক তেমনি সুভাকে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে গড়ে তার আসল স্বরূপকে উদ্ঘাটন করেছেন। আর এরই জন্যে বোধহয় লেখক কাব্যের আশ্রয় নিয়েছেন। ভাবের আভাসে সুভার ওষ্ঠাধর কবি কিশলয়ের মতো কেঁপে ওঠে—অস্তমান চন্দ্রের মতো অনিমেয় চোখ বিদ্যুতের মতো চঞ্চল পদবিক্ষেপে এবং কখনো কখনো বাক্যহীনা প্রকৃতির মতো বিজন, মহত্ত্ব নিয়ে তার মৌন রূপ নীরব ও বিষণ্নতায় আশ্লীষ্ট। এরই জন্যে কবিত্বে আশ্রয় লওয়া লেখকের যথাযথ হয়েছে। হয়তো এরই জন্মে কাব্যিক অভিব্যঞ্জনায় গল্পের রস পরিণাম এইভাবে চিহ্নিত হতে পারে— “Our Sweetest Songs are those that tell of Saddestthought.”তবু এরই জন্যে ‘সুভা’ গল্পটি বিশ্ব সাহিত্যে আপন স্থান চিহ্নিত সক্ষম হবে। যার প্রেক্ষাপটে একমাত্র প্রকৃতিই মুখ্য।
Leave a comment