ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের চর্চায় যে-কজন মুসলিম সাহিত্য-সাধক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২] সর্বাধিক খ্যাতিমান। লেখকের দীর্ঘ সাহিত্যিকজীবনে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন এ অঞ্চলের ইতিহাস ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ভাঙা-গড়া। বিশেষকরে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি শম্ব সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসময় বহুবিধ বিবর্তন, সংঘাত ও পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। সমাজ ও স্বকালের বিবিধ বিষয় তাই সহজেই প্রযক্ত হয়েছে তাঁর সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে তাঁর বিচরণ ছিল সব্যসাচী লেখকের মতো। তাই বাঙালি মুসলিম লেখকদের অগ্রপথিক হিসেবে তাঁর নাম স্মরণীয়।

মীর মশাররফ হোসেন একাধারে গদ্য, পদ্য, নাটক, প্রহসন এবং আত্মজীবনীমূলক রচনা করেছেন। ফলে ধীরে ধীরে তাঁর রচনায় ক্ষুরধারভাব প্রকাশ হতে থাকে। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘গোরাই ব্রিজ’ ও ‘গৌরী সেতু’র ভাষা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন:

“গ্রন্থখানি পদ্য। পদ্য মন্দ নহে। এই গ্রন্থকার আরও বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার রচনার ন্যায় বিশুদ্ধ বাঙ্গালা অনেক হিন্দুতে লিখিতে পারে না।… মীর মশাররফ হোসেন সাহেবের বাঙ্গালা ভাষানুরাগিতা বাঙ্গালির পক্ষে বড় প্রীতিকর। ভরসা করি, অন্যান্য সুশিক্ষিত মুসলমান তাঁহার দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইবেন।”

মীর মশাররফ হোসেনের ভাষা সম্পর্কে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন:
“মীর সাহেবের পূর্বে মুসলমান লিখিত বঙ্গসাহিত্যে কবিতা ছিল, পড়িবার মতো গদ্য ছিল না। মুসলমান গদ্যলেখকবর্গের মধ্যে এখন পর্যন্তও মীর মশাররফ হোসেন সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক।”

এটা উল্লেখ্য যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের ভিত্তি নির্মাণে বন্ধন-শৃঙ্খলার ব্যবহার করেছিলেন। তখন তার প্রয়োজন ছিল। সেই ভিত্তির উপর বঙ্কিমচন্দ্র গদ্যের শ্রী ফুটিয়ে তুলেছিলেন। মীর মশাররফ হোসেন সেই শ্রীসম্পন্ন গদ্যপটভূমিতে তাঁর গদ্যরচনাকে উপস্থিত করেছিলেন। তাই তাঁর বাক্যসজ্জায়, পদগুচ্ছের অবস্থানে, খণ্ডবাক্যের সজ্জায়, উক্তিধর্মী বাক্য রচনায়, নিত্যসম্বন্ধী ও শব্দযুগলের ব্যবহার বিদ্যাসাগরীয় গদ্যরীতি তথা বঙ্কিমী গদ্যরীতির সফল অনুসৃত লক্ষ করা যায়। এসব ক্ষেত্রে মীর মশাররফ হোসেনের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।

গদ্য রচনাকার হিসেবে মীর মশাররফ হোসেনের প্রধান সফল স্থান বাংলা নাটক এবং ২০ সন রচনায়। ‘রত্নবর্তী’ (১৮৬৯), ‘বসন্তকুমারী’ (১৮৭৩) এবং ‘জমীদার দর্পণ’ (১৮৭৩) তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য নাটক। এছাড়াও তাঁর গন্য ভাষার নমুনা পাওয়া যায় ‘এর উপায় কি’, ‘বিষাদ-সিন্ধু’ (রচনাকাল ১৮৮৫-৯১), ‘সঙ্গীত লহরী (১৮৮৪), ‘গো-জান (১৮৯), ‘বেহুলা গীতাভিনয়’ (১৮৮৯), ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০) ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯) ‘মৌলদ শরীফ’ (১৯০৩), ‘বিবি খোদেজার বিবাহ’ (১৯০৫), ‘আমার জীবনী’ (১৯১০) প্রভৃতি গ্রন্থে।

‘বসন্তকুমারী’ (১৮৭৩) তিন অঙ্কে, এগারো দৃশ্যে বা রঙ্গভূমিতে রূপকধর্মী বিষাদান্ত কাহিনি অবলম্বনে গৃচত: নাটকে আটটি গান সংকলিত আছে। সংস্কৃত নাটকের অনুসরণে এই নাটকের প্রারম্ভেই আছে প্রস্তাবনা। এই আখ্যান আত পুরাতন লোক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। যুবক (নরেন্দ্র) সপত্নীপুত্রের প্রতি যুবতী বিমাতার (ইন্দ্রপুরের রানি রেবতী) আএম তার প্রতিক্রিয়া এবং নিরপরাধ সপত্নীপুত্রের সর্বনাশ এই জাতীয় গল্পের মোটিভ লোকসাহিত্যে অতি পুরাতন। পুরা ৩০ লোক-সাহিত্যের কাহিনিতে এই ধরনের আখ্যানের প্রচুর সন্ধান পাওয়া যায়।

এ নাটকের কাহিনি দৃঢ় সংবদ্ধ, চরিত্র সৃষ্টি অধিকতর বাস্তবধর্মী এবং সুস্পষ্ট, সংলাপের ভাষা আরো নাট্যধর্মী এব সমুন্নত। রূপকথার রোমান্টিক জীবনের মধ্যেও যে আধুনিক নাটকীয় ভাষায় সংলাপ রচনা সম্ভব হতে পারে এবং রূপকথার মতো একান্ত কল্পনাভিত্তিক রচনাও যে জীবনের চিরন্তন সমস্যার বিষয় প্রকাশ করতে পারে। ‘বসন্তকুমারী’ নাটক তার প্রমাণ। এ নাটকের বিশেষ গুণ অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। এই সুমহান এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গি ‘বসন্তকুমারী’ নাটকের অলংকার। এ নাটকের মধ্যে যে বৃত্তিগুলো প্রাধান্য লাভ করেছে, তা নরনারীর চিরন্তন হৃদয়বৃত্তি। নীচতা, স্বার্থপরতা, অতৃপ্ত জীবন তৃষ্ণা, রূপজমোহ, উদ্দাম লালসা, প্রবৃত্তির উন্মাদনা যা চিরদিন মানুষের জীবনে অনিবার্য ট্র্যাজেডির সৃষ্টি করে।

এ নাটকের নামকরণ বসন্তকুমারী করা হলেও কেন্দ্রীয় চরিত্র রেবর্তী। নাট্যকার বসন্তকুমারীকে প্রধান চরিত্র করতে চাইলেও মনের অজান্তে রেবতীই তার ক্রিয়াকর্ম দ্বারা প্রধান আসন দখল করেছে। চরিত্রানুযায়ী যথাযথ ভাষ্য ব্যবহার এ নাটকে লক্ষ করা যায়।

‘জমীদার দর্পণ’ নাটকটি বাংলার জমিদারদের অত্যাচারের এক জ্বলন্ত কাহিনি। মীর মশাররফ হোসেনের বহুল পঠিত, আলোচিত ও নন্দিত নাটক এটি। জমিদারের অত্যাচারের ভয়ংকর স্বরূপ প্রকাশ করে খুব স্বল্প রচনাই প্রকাশ পেয়েছে। এ নাটকে লেখকের যে দুঃসাহসিক সত্য ভাষণের প্রয়াস, তা সত্যি বিস্ময়কর। লম্পট জমিদার হারওয়ান আলী উচ্ছৃঙ্খল, নারীলোলুপ। তার বাঘের থাবা নারী মাংসেই তৃপ্ত। দরিদ্র প্রজা আবু মোল্লার সুন্দরী যুবতী স্ত্রী নুরুন্নেহারের প্রতি তার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। সহযোগীদের দিয়ে নুরুন্নেহারকে ধরে এনে তাকে ভোগ করে হত্যা করে। জমিদার অর্থ দ্বারা সাক্ষী বশ করে ফাঁসি হতে রেহাই পায়, আবু মোল্লা স্ত্রীশোকে উন্মাদ হয়ে গ্রাম ত্যাগ করে। অসাম্প্রদায়িক শিল্পী সাম্প্রদায়িকতার তর্ক এড়াতে জমিদার ও প্রজা উভয়ই মুসলমান সমাজ হতে গ্রহণ করেছেন। এ নাটক চরিত্রের বর্ণাঢ্য আয়োজনে সমৃদ্ধ। ভালো আর মন্দ, নিপীড়ক ও দলিত, ভণ্ড ও বিদ্রোহী, স্বদেশি ও বিদেশি ইত্যাদি বিচিত্র মানব-মানবীর আনাগোনা ও কর্মকাণ্ডে নাটকটি ভরপুর। নৃশংসে জমিদার, বিদ্রোহে আবু মোল্লা এবং সারল্যে নুরুন্নেহার চরিত্র সৃষ্টিতে শিল্পীর সমাজ বিশ্লেষণী দষ্টি পরিলক্ষিত হয়।

উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে যে সমস্ত সামাজিক অনাচার সমাজ জীবনকে কলুষিত করে তুলেছিল মদ্যপান ও গণিকা-গমন তাদের অন্যতম। এদেশে প্রাচীনকাল থেকেই এর প্রভাব পরিরক্ষিত হলেও ইংরেজ আমলে তা প্রবল ও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ অবস্থার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের আগেই সাহিত্যে এর প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। পানাসক্তি ও লাম্পট্য দোষ নিয়ে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি অনেক নাটক প্রহসন রচিত হয়। এই ধারায় ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় মশাররফ হোসেনের প্রথম এবং পূর্ণাঙ্গ প্রহসন ‘এর উপায় কি?’। চার দৃশ্যের এ একাঙ্কিকা তথা প্রহসনটির পটভূমি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ। মদ্যাসক্ত ও বেশ্যাসক্ত পুরুষের অনাচার ও উচ্ছৃঙ্খলতার চিত্র এতে অঙ্কিত হয়েছে। গ্রহসনটি রাধাকান্ত ও মুক্তকেশীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। রাধাকান্ত বিত্তবান যুবক। সে গণিকাসেবী এবং মদ্যপ। তার এ চরিত্র সমকালীন বিত্তবানদের ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত।

‘টালা অভিনয়’ প্রহসনটি কোলকাতার টালা অঞ্চলে পাথুরিয়া ঘাটার জমিদারের একখণ্ড জমিকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার (১৮৯৭) বাস্তব পটভূমিতে রচিত। উক্ত জমিতে মুসলমানেরা একটি চালাঘর নির্মাণ করে মসজিদ হিসেবে চালানোর চেষ্টা চালায়। মামলা হয়, আদালতে মুসলমানের দাবি অগ্রাহ্য হয়। অতঃপর মাহারাজার লোকের সাথে মুসলমানের দাঙ্গা। পুলিশের গুলিতে হাঙ্গামাকারিরা এগারোজন নিহত হয়, আহত হয় কুড়ি জন। পুলিশ ৩৪জন আহত
হয়ে হাসপাতালে যায়।

‘টালা-অভিনয়’ প্রহসনে লেখক হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েরই ধর্মের মুখোশপরা কাণ্ডজ্ঞানহীন স্বার্থপর ব্যক্তিদের কটাক্ষপাত করেছেন। তাদেরই উস্কানি ও চক্রান্তে সাধারণ মানুষ উত্তেজিত হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ছদ্মবেশী ইবলিশ মুন্সী এবং নারদ ঠাকুরের দল ধর্মের দোহাই দিয়ে ও ধোকাবাজির আশ্রয় নিয়ে নানা কৌশলে অশিক্ষিত সরল মানুষের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। টালা হাঙ্গামায় মুসলমানদের দায়িত্ব ছিল বেশি। প্রহসনটিতে শিল্পীর নিরপেক্ষতার পরিচয় মেলে। হিন্দু-মুসলমানের মিলন কামনা করে লেখা প্রহসনটি সত্যি উল্লেখযোগ্য।

‘টালা অভিনয়’ প্রহসনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ও বৈশিষ্ট্য হলো নিম্ন শ্রেণির মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও দাঙ্গা সম্পর্কে মীরের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে। মশাররফের এ প্রহসনের চরিত্রগুলো পূর্ণায়ব নয়- ছায়ামাত্র। উদ্দেশ্য সংলগ্ন হয়েই এদের প্রকাশ। এ রচনার ভাষাভঙ্গি প্রয়োগের ক্ষেত্রে মিশ্র ভাষারীতি ব্যবহার লক্ষ করা যায়। সাধু ও চলিত ক্রিয়াপদের গুরুচণ্ডালী প্রয়োগও লক্ষণীয়।

মশাররফ হোসেনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বিষাদ-সিন্ধু’। মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’র কাহিনি মহররমের ধর্মীয় আখ্যান অবলম্বনে মহাকাব্যিক ব্যপ্তিতে রচনা করেছেন। এটি প্রকাশের পর ‘ভারতী’ পত্রিকার সমালোচনায় বলা হয়েছিল ‘ইহা মহরমের একখানি উপন্যাস ইতিহাস’। বস্তুত ইসলাম ধর্ম কথাকে সর্বজনীন সাহিত্যরসে সঞ্জীবিত করেছিলেন শিল্পী; ভাবে ভাষায় ‘বিষাদসিন্ধু’ তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ পরিচয় বহন করে। লেখক নিজে বলেন-

“শাস্ত্রানুসারে পাপ ভয়ে ও সমাজের দৃঢ় বন্ধনের বাধ্য হইয়া বিষাদসিন্ধুর মধ্যে কতকগুলি জাতীয় শব্দ ব্যবহার করিতে হইল।”

এখন বুঝা যায় ইসলামের ধর্মকথা নিয়ে গ্রন্থ রচনা করতে বসেও শিল্পী প্রাগ ইসলামিক আদর্শের বদলে নিখিল বাঙালির রসচেতনার প্রতিই অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। আর সেই জন্যই বাংলা ভাষায় সাধারণভাবে অপ্রচলিত, অমুসলমান’ বাঙালির অজ্ঞাত ইসলামি ধর্মীয় শব্দ প্রয়োগেরও সাহিত্যিক কৈফিয়ত দিয়েছেন। কেবল বাঙালি মুসলমানদের নবজাগরণের, বাংলা সাহিত্যে এই মাটির ভাব গন্ধভরা ভাষা শিল্পের স্বভাব রূপকার ছিলেন মশাররফ হোসেন। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে তাঁর রসাবলি এই অদ্বিতীয় মূল্যে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বিষাদ-সিন্ধু’র পর মশাররফ হোসেন এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০) ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯)। এ গ্রন্থ দুটিতে মশাররফ হোসেন সমকাল-সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। এ দুটি রচনায় সমাজ সংস্কতির নকশা ফুটে উঠেছে। নিচে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করার প্রয়াস পাব।

‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’য় লেখকের ব্যক্তিগত পটভূমি সুবিস্তৃত হলেও একমাত্র নয়। পারিবারিক এবং বাস্তব ঘটনার রূপ এ গ্রন্থে ধরা পড়েছে। কুষ্টিয়া অঞ্চলে নীলকরের অবাধ অত্যাচারের কাহিনি-চিত্র উদঘাটন করাই ছিল এ রচনার লক্ষ। অকপট সত্যভাষণের অসাধারণ গুণের অধিকারী হওয়ার জন্যই মশাররফ হোসেন তাঁর গ্রন্থে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সত্য কথা বলতে দ্বিধা করেননি। ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ গ্রন্থে কোথাও বিন্দুমাত্র স্ববিরোধী খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোনো কোনো সমালোচক এ গ্রন্থে মশাররফ হোসেন এর পিতার প্রতি লেখকের পক্ষপাতিত্বের যে অভিযোগ এনেছেন, তার বড়ো কারণ সম্ভবত বইটি না পড়ে এমনকি না দেখেই মন্তব্য করেছেন। মীর সাহেব এ গ্রন্থে বার বার বলেছেন, তাঁর পিতা ইংরেজভক্ত এবং শুধু নীলকর কেনী নয়, সব ইংরেজ নীলকরদের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। সম্পত্তির লোভে তাঁর পিতাকে জামাই সাগোলাম আজম যখন বিষ খাওয়ায় তখন একমাত্র কেনীর সাহায্যেই তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কেনীর সঙ্গে তাঁর ‘বিশেষ প্রণয় ছিল’। তিনি লাঠিয়াল দিয়ে কেনীকে সাহায্য করেছেন একথাও মশাররফ হোসেন বলেছেন। (উল্লেখ্য এ কেনী সাহেব ছিলেন কুষ্টিয়া অঞ্চলের কুখ্যাত নীলকর টি.আই. কেনী) তাঁর পিতার মনে দেশবাসীদের জন্য গভীর মমতাও ছিল। প্যারী সুন্দরী কেনীকে ‘জব্দ’ করলে মীরের পিতা বলেছেন- “ধন্য বাঙ্গালীর মেয়ে, সাবাস সাবাস! সাহেবকে একেবারে অস্থির করিয়া তুলিয়াছে।” প্যারীর মুখ দিয়ে লেখক প্রকৃত সত্যকে তুলে
ধরেছেন: “যে উপায়ে হউক রাজ্য রক্ষা করিতে হইবে। ও বেলাতী কুকুর, এদেশের সকলকেই দংশন করবে।”

‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ গ্রন্থে মশাররফ হোসেন এর মানস বিশেষভাবে প্রকটিত হয়েছে। এখানে তিনি
রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ জটিলতার মধ্যেও পড়েছেন। (তাঁর বাবা নীলকরের সাহায্যকারী, কেনীর বন্ধু, ঘোর আমুদে, বাইজীভক্ত, সাঁওতাল জমিদারী জামাই এর যড়যন্ত্রে হারিয়ে ফেলেছেন, পিতার রক্ষিতা মাতাকে বিষ প্রয়োগ করেছে অন্যদিকে কৃষকগণ এবং কয়েকজন জমিদার নীলকরদের ও নীল চাষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে; সম্পত্তি আত্মসাৎকারী জামাই গোলামাজ্জম ঝোপ বুঝে কোপ মেরে নেতা সেজেছেন।) মশাররফ হোসেন এর পিতা নীলকরের সমর্থক, লেখক নীলচাষের উচ্ছেদে, কৃষক কেন্দ্রের বিদ্রোহে উল্লসিত। কেনীয় অত্যাচারকে তিনি ঘৃণার সঙ্গে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। গ্রন্থটিতে সর্বত্রই সাধারণ মানুষের প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থন এবং পিতৃবন্ধু অত্যাচারী কেনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা দ্বিধাহীনভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন। সাহসী, সত্যভাষী, মানব-দরদী মহান এক সাহিত্যিকরূপেই মশাররফ হোসেন এ গ্রন্থে নিজের মহিমা এবং
সমাজসচেতনতাকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন।

‘বিষাদ-সিন্ধু’র পর মশাররফ হোসেন এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯)। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ মশাররফ হোসেন এর অন্যতম আত্মজীবনীমূলক রচনা। এতে তাঁর পরিণত বয়সের কর্মজীবনের বিবরণ লিপিবদ্ধ
করা হয়েছে। স্বজীবনীমূলক রচনা হলেও গাজী মিয়ার বস্তানী ব্যঙ্গ বিদ্রূপাত্মক রচনা। কাহিনির আবেদনকে ব্যাপকতা দানের উদ্দেশ্যে, কোনো কোনো চরিত্রের চোখে ধুলো দেওয়ার মতলবে এবং সম্ভবত নিজের নিরাপত্তার জন্য লেখক এ গ্রন্থের স্থান ও পাত্র-পাত্রীর জন্য বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। এই কাল্পনিক নাম ব্যবহার আত্মজীবনীর আদর্শের পরিপন্থী। কিন্তু মশাররফ হোসেন এর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে পরিচয় থাকলে ছদ্মনামের অন্তরালে কারা কি ভূমিকায় আছেন, তা বুঝতে বা চিনতে অসুবিধে হয় না। কর্মস্থল দেলদুয়ারের অভিজ্ঞতা বস্তানী রচনার প্রধান উৎস। ‘যমদ্বার’ হলো দেলদুয়ার আর পয়জারন্নেসা হলেন করিমুন্নেসা চৌধুরানী। গাজী মিয়া ও ভেড়াকান্ত লেখক স্বয়ং।

‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ শুরু হয়েছে অরাজকপুরের হাকিম ভোলানাথ এবং কুঞ্জনিকেতনের বেগম সাহেবার বর্ণনার মধ্য
দিয়ে। এখানে লেখক বিচিত্র নামকরণের মাধ্যমে কাহিনির গতিবিধি এবং অগ্রসরমানতার প্রস্তাবনা করেছেন। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র উদ্দেশ্য প্রবণতা গ্রন্থে বর্ণিত পাত্র-পাত্রী ও স্থানের নাম থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায়। জমিদারের নাম সাবলেট চৌধুরী, পয়জারন্নেসা, সোনাবিবি, মনিবিবি ইত্যাদি।

‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ মশাররফ হোসেন এর কর্মস্থল দেলদুয়ারের তিক্ত অভিজ্ঞতা ‘বস্তানী’ রচনার প্রধান উৎস বলে ধরে নেওয়া যায়। গ্রন্থে বর্ণিত ‘যমদ্বার’ হলো দেলদুয়ার আর ‘পয়জারন্নেসা’ হলেন করিমুন্নেসা চৌধুরানী। উল্লেখ্য মশাররফ হোসেন এরই অধীনে দেলদুয়ার স্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। সুতরাং স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র কাহিনি ও ঘটনাংশের পটভূমি দেলদুয়ার স্টেট, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ। ইতোপূর্বে রচিত ‘নববাবু বিলাস, আলালের ঘরের দুলাল’, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ ইত্যাদি নকশা-জাতীয় গ্রন্থে প্রধানত হিন্দু সমাজের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মশাররফ হোসেন এর ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র বর্ণিত সমাজ হিন্দু মুসলমানের মিশ্র সমাজ।

তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জবানী’তে মশাররফ হোসেন উল্লেখ করেছেন যে, ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র অনেক ঘটনা তাঁর জীবন থেকে আহরিত। মশাররফ হোসেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে করিমন্নেসা খানমের জমিদারিতে ম্যানেজার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মনিবের বিরাগভাজন হয়ে পরে তাকে চাকরিস্থল পরিত্যাগ করতে হয়েছিল। এই কর্মস্থল দেলদুয়ারের অভিজ্ঞতাই তাঁর বস্তানী রচনার প্রধান উৎস।

পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ মীরমশাররফ হোসেন। তিনি উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু বিচারে তার সাহিত্য সাফল্যের দাবিদার এবং তা মুসলমান লেখকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি ভাষারীতির দিক থেকে বিশিষ্টতার অধিকারী। তার ভাষায় মোহিনী শক্তি ঈর্ষণীয়। তিনি সবদিক দিয়ে নিঃসন্দেহে সফলতার দাবিদার।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।