গণ আন্দোলন এবং বিপ্লবে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট দলের ভূমিকা নিয়ে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে একটি তাত্ত্বিক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। গণবিপ্লব সংগঠনে নেতৃত্বের ভূমিকা কি হবে, সেই প্রশ্নে পরস্পর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন লেনিন এবং রোসা লুক্সেমবুর্গ। সাধারণভাবে মার্কসীয় তত্ত্বচর্চাকারীরা এই বিতর্কের একদিকে রাখেন লেনিনকে, যিনি শ্রেণী প্রতিনিধিত্ব, নেতৃত্ব, নির্দিষ্ট শ্রেণীচৈতন্যের প্রবক্তা; অন্য দিকে রোসা, যিনি গণবিপ্লবের স্বতঃস্ফূর্ততা, নিজস্বতার ওপর অধিক আস্থাশীল। সচেতন নেতৃত্ব পরিচালিত শ্রেণী সংগ্রাম এবং বিপ্লবী জনগণের স্ব-উদ্যোগে বিপ্লবী বিস্ফোরণ, রোসার ভাষায়, ‘Mass Strike’ এর মধ্যে এই দৃঢ় প্রত্যয়ী বিভাজন রেখা টানার সবচেয়ে বড় অসুবিধাটা হচ্ছে যে আসলে বিতর্কের জটিলতাটি এখানে ধরা পড়ে না। উপরন্তু বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য বিপ্লবীদল সম্পর্কে লেনিনীয় অবস্থানকে এক অবিসংবাদী তত্ত্বে পরিণত করে, যা প্রশ্নাতীতভাবে মূলধারার মার্কসীয় রাজনীতি চর্চার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। এবং এর বিপরীতে রোসা লেনিনের সঙ্গে বিতর্কে দলীয় সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে যে সমস্ত প্রশ্নগুলির উত্থাপন করেন তার গুরুত্ব অপরিসীম।

বস্তুত শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী সংগঠনের বাস্তব রূপ কি হবে বা সাধারণভাবে কম্যুনিস্ট পার্টির রূপরেখা নিয়ে মার্কস বা এঙ্গেলস কোন নির্দিষ্ট তত্ত্ব গড়ে তোলেন নি। এর কারণ আধুনিক রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে শুরু করে তাঁদের জীবনের শেষের দিকে। এঙ্গেলস ফ্রান্সে শ্রেণীসংগ্রামের মুখবন্ধে রাজনৈতিক দলগুলিকে দেখছেন বিভিন্ন শ্রেণী এবং এর মধ্যেকার বিভিন্ন উপগোষ্ঠীগুলির একধরনের অভিব্যক্তি হিসেবে। তবে শাসক শ্রেণীগুলির যৌথ ক্ষমতার বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব দল গড়ে তোলার প্রয়োজনের ওপর তাঁরা জোর দেন। কারণ শ্রেণী হিসেবে সক্রিয় হতে গেলে একান্ত নিজস্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের আত্মপ্রকাশ করতেই হবে। কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকে গৃহীত প্রস্তাবে তাঁরা শ্রমিকশ্রেণীর দলের মধ্যে দিয়ে। বিপ্লবী তাত্ত্বিক সচেতনতা এবং স্বতঃস্ফূর্ত স্ব-উদ্যোগের পারস্পরিকতার উল্লেখ করেন। ম্যানিফেস্টোতে মার্কস এঙ্গেলস্ তত্ত্বসমৃদ্ধ কম্যুনিস্টদের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রলেতারিয় আন্দোলন, তাঁদের মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠের সচেতন স্ব-নির্ভর আন্দোলন। মার্কস বা এঙ্গেলসের রচনায় আমরা বিপ্লবী দল সম্পর্কে সুষ্পষ্ট কোন ধারণা পাইনা। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সময়কার মার্কসীয় চিন্তায় বিপ্লবীদল সম্পর্কে যে ধারণা বিরাজ করত তা ছিল মূলত এক যান্ত্রিক, অর্থনীতিবাদী ধারণা। এখানে মনে করা হত পুঁজিবাদের বিকাশ এবং তৎসংযুক্ত শ্রমিকশ্রেণীর অনিবার্য বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দলও গড়ে উঠবে। এই যান্ত্রিক মার্কসবাদের বিপরীতে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট দল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে লেনিন পথিকৃৎ। মূলধারার মার্কসবাদী তত্ত্বে লেনিনের এই প্রসঙ্গে অবদান অনস্বীকার্য। আধা-পুঁজিবাদী রুশ সমাজে বিপ্লবী দল গড়ে তোলার তাত্ত্বিক কাঠামো তিনি নির্মাণ করেন তাঁর What is to be Done? (1902) প্রবন্ধে। লেনিনের এই বহুল পঠিত প্রবন্ধটির নামকরণের পেছনে তৎকালীন রুশ দেশের সমাজদার্শনিক এবং সাহিত্যিক নিকোলাই চেরনিশেভস্কির অতি জনপ্রিয় সমনামী উপন্যাসের ভূমিকা খুবই স্পষ্ট। চেরনিশেভস্কির উপন্যাসের মূল কথিকাটি হচ্ছে ‘এক নতুন ধরনের বুদ্ধিজীবীর’ নেতৃত্বে পুরনো সমাজের ধ্বংসসাধন ঘটিয়ে কীভাবে স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে এক কাম্য স্বপ্নের সমাজ গড়ে ওঠে তার বৃত্তান্ত।

মার্কসবাদ চর্চার পাশাপাশি এই কথিকার আখ্যান যে তাঁর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল তা তিনি স্বীকারও করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে লেনিনের অবস্থান- উন্নততর জ্ঞান, কর্তৃত্বের নির্দেশ এবং ভবিষ্যত সমাজের স্পষ্ট দিক-নির্ধারণ একমাত্র সচেতন বুদ্ধিজীবিদের করতলগত— অনেকটাই চেরনিশেভস্কির প্রভাব।

বিপ্লবী পার্টি এবং লেনিন

বিপ্লবী পার্টি সম্পর্কে লেনিন তাঁর অবস্থান গড়ে তুলছেন তৎকালীন রুশ দেশে সক্রিয় অন্যান্য মার্কসবাদী গোষ্ঠীগুলির অবস্থানের সমালোচনার মধ্য দিয়ে। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে রুশ জনগণের অসংখ্য স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে “আইনী মার্কসবাদীদের” পাশাপাশি বিপ্লবী জনবাদী গোষ্ঠীগুলিও ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রলেতারিয় নেতৃত্বে অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণীগুলিকে সংগঠিত করার যথাযথ পন্থা গড়ে তুলতে তারা অপারগ। এর জন্য প্রয়োজন রুশ সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, তার শ্রেণী বিন্যাসের নিবিড় বিশ্লেষণ। এই কারণেই লেনিন স্বতন্ত্র সমাজতান্ত্রিক চেতনার উল্লেখ করেছেন। প্রলেতারীয় শ্রেণীর স্ব-উদ্যোগে গড়ে তোলা যাবতীয় আন্দোলন বড় জোর ট্রেড ইউনিয়ন সুলভ আর্থনীতিক দাবিদাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। লেনিন তাঁর অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করছেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অন্যতম তাত্ত্বিক কার্ল কাউটস্কির বক্তব্যকে শিরোধার্য করে। কাউটস্কির মন্তব্য হচ্ছে শ্রমজীবি মানুষজনের পক্ষে নিজের থেকে কখনই আধুনিক সমাজতান্ত্রিক চৈতন্য অর্জন সম্ভব হয় না। আর এই চৈতন্য অর্জন করতে হলে প্রয়োজন ‘গভীর বিজ্ঞানমনস্কতা’ যা তাদের আদৌ নেই। প্রলেতারীয় শ্রেণী যদি স্বতঃস্ফূর্ত তাৎক্ষণিক আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে বুর্জোয়া মতাদর্শেরই চৌহদ্দির মধ্যেই তারা অন্তরীণ থাকবে। তাই কম্যুনিস্টদলের প্রধান ভূমিকা হবে স্বতঃস্ফূত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ঘূর্ণীপাক থেকে শ্রমিকশ্রেণীকে মুক্ত করে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উন্নীত করা। এই ক্ষেত্রে সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি সচেতন পেশাদারী বিপ্লবী সংগঠনের ভূমিকা অপরিসীম। এই দৃঢ় কেন্দ্রীভূত সংগঠিত দল হচ্ছে বিশেষজ্ঞ বিপ্লবীদের সংগঠন, যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গোপনীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য। তবে লেনিন অন্যান্য গণ সংগঠনের গুরুত্ব অস্বীকার করেন নি। তবে বিপ্লবী দলের অনড় নেতৃত্ব সবসময় তার আলাদা অস্তিত্বকে বজায় রাখে। এক কথায় What is to be done? -এ বিপ্লবী দলের মূল ভূমিকা হচ্ছে, লেনিনের মতে, যোজক (Mediator) এর। এই বিপ্লবী তত্ত্ব সমৃদ্ধ বিপ্লবী সংগঠনের মূল কাজ সংকীর্ণ এবং দিশাহীন অর্থনীতিবাদী শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে বাইরে থেকে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক চেতনার সঞ্চার ঘটানো; তাদের চেতনাকে আরও উন্নত স্তরে উন্নীত করা। এবং এই দায়িত্ব পালনে সমর্থ একমাত্র পেশাদার বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিরা। এঁদের পক্ষেই বুর্জোয়া সমাজ এবং বুর্জোয়া শ্রেণীসম্পর্কের সামগ্রিক এবং সঠিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব। এই নতুন ধরনের দলই হচ্ছে শ্রমিক ও অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণীগুলির অগ্রবাহিনী। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অবলম্বন করেই দলীয় সংগঠন গড়ে উঠে।

বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে লেলিন কার্যত এই পেশাদার বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিসমৃদ্ধ সুদৃঢ় সংগঠনের তত্ত্ব গড়ে তোলেন। স্বৈরতান্ত্রিক সন্ত্রাসের পরিবেশেই এই ধরনের সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। উপরত্ত, চূড়ান্ত অর্থনীতিবাদী মার্কসবাদীদের যান্ত্রিক অবস্থানের বিরুদ্ধে লেনিন এই ধরনের অতি সক্রিয় বিপ্লববাদী দলীয় সংগঠনের ধারণা গড়ে তোলেন। অবশ্য পরবর্তীকালে লেনিন দল সম্পর্কে তাঁর এই ধারণার অনেকটাই পরিবর্তন করেন; বিশেষ করে ১৯০৫ এবং ১৯১৭-র বিপ্লবী পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। তবে পরবর্তীকালে স্তালিনের নেতৃত্বে What is to be done ?-এ কম্যুনিস্ট দল সম্পর্কে লেনিনীয় তত্ত্বকে একমাত্র অনুসরণীয় মডেল বলে উপস্থাপিত করা হয়।

রোসার সমালোচনা

বিপ্লবী দল সম্পর্কে লেনিনের তত্ত্বের সমালোচনা করেন রোসা লুক্সেমবুর্গ। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব ও জার্মানীতে গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি শ্রমিক শ্রেণীর চৈতন্যের বিকাশ, তাদের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ইত্যাদির নিরিখে লেনিনের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। তাঁর Social Reform or Revolution-এ ইতিমধ্যে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর স্ব-উদ্যোগে গড়ে তোলা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের গুরুত্বের উল্লেখ করেন। তিনি লেনিনের মত এই ধরনের আন্দোলনকে সংকীর্ণ অর্থনীতিবাদী বলতে রাজী নন। বরং তাঁর মতে এই ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মধ্য দিয়েই শ্রমিক শ্রেণী সচেতনতা অর্জন করে, সমাজতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন হয়ে শ্রেণী হিসেবে সংগঠিত হতে থাকে। এই দিক থেকেই তিনি বিপ্লবী দল সম্পর্কে লেনিনের ধারণার এক দীর্ঘ সমালোচনা করেন। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত তার Organisational Question of Russian Social Democracy প্রবন্ধে শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনী হিসেবে দলকে উপস্থাপিত করার লেনিনীয় প্রকল্পের বিরোধিতা করেন। রোসার মতে বিপ্লবী নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যেকার সম্পর্ক হচ্ছে দ্বান্দ্বিক, দ্বিবাচনিক। এই সম্পর্ক কখনই যান্ত্রিক একতরফা নয় বা দল একতরফাভাবে বাইরের থেকে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দিশা জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারে না। লেনিন নির্দেশিত সুদৃঢ়ভাবে সংগঠিত দলের ধারণা আসলে এক ধরনের প্রবরবাদেরই জন্ম দেয়। এর মধ্য দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, আমলাতান্ত্রিকতার শিকার হয় গণ আন্দোলন। মুষ্টিমেয় বিপ্লবী বুদ্ধিজীবির তাত্ত্বিক অভিভাবকত্বে গণ আন্দোলন তার নিজস্বতা এবং স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলে। অভ্যুত্থানের মুহূর্তে শ্রমিক শ্রেণীর সামগ্রিক অভিপ্রায়ের বদলে গুরুত্ব পায় বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের ‘অভ্রান্ত’ নির্দেশ আর তত্ত্ব শিক্ষা। এর বিপরীতে রোসা গুরুত্ব দেন শ্রমিক ও অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণীর স্ব-উদ্যোগের ওপর, তাদের একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতার ওপর। তাদের একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই তারা শিক্ষা নেয়, সচেতন হয়ে ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করে। রোসার মতে শ্রমিকশ্রেণীর নিজেদের অভিজ্ঞতাজাত সচেতনতা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ‘অভ্রান্ত সিদ্ধান্ত অপেক্ষা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে বিপ্লবী দলের এক্ষেত্রে একমাত্র কাজ হচ্ছে আন্দোলনকে উদ্দীপিত করা, সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণের অধীনস্থ করা নয়। কারণ দলীয় নেতৃত্বের হাতে বিপ্লবকে বাস্তবায়িত করার কোন রেডিমেড পূর্ব প্রতিচ্ছবি থাকতে পারে না। এবং এই কারণেই লেনিন কথিত সচেতন অগ্রবাহিনী—আপামর জনগণ, এই বিভাজনে রোসা বিশ্বাসী নন। তিনি মনে করেন সমাজতান্ত্রিক সচেতনতা বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের ‘আবিস্কার’ নয়, প্রত্যক্ষ আন্দোলনের অভিজ্ঞতাই এই সচেতনার উৎস। তাই প্রত্যক্ষ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা, তার ভুল ভ্রান্তি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের ‘অমোঘ’ অব্যর্থ নীতি-নির্দেশের চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

পরবর্তী সমস্ত লেখাপত্রে রোসা বিপ্লবীদল এবং গণ বিপ্লব নিয়ে তাঁর উপরিউক্ত অবস্থানে স্থির থেকেছেন। স্ব-উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রলেতারীয় অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত মুহূর্তকে তিনি চিহ্নিত করেছেন মাস স্ট্রাইক হিসেবে। ১৯০৬ সালে লেখা Mass Strike, Party and Trade Unions প্রবন্ধে প্রলেতারীয় অভ্যুত্থানের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁর মন্তব্য ১৯০৫ সালের রুশ শ্রমজীবী জনগণের অভ্যুত্থান এটাই প্রমাণ করে যে কৃত্রিম ভাবে কোন বিপ্লব সৃষ্টি করা যায় না। বরং বিপ্লব হচ্ছে একটি অনিবার্য ঐতিহাসিক ঘটনা। এখানে অর্থনৈতিক সংগ্রাম মোটেও রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপান্তরিত হয় না। বিপ্লবের মুহূর্তে অর্থনীতি থেকে রাজনীতিক আলাদা করা যায় না, এখানে কার্য-কারণ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। সুতরাং একমাত্র পেশাদারী সচেতন বিপ্লবীরাই যে দিশাহীন শ্রমিকশ্রেণীর অর্থনৈতিক সংগ্রামকে ‘পুরোপুরি রাজনৈতিক অভ্যুত্থানে’ উন্নীত করতে পারে, রোসা তা মানতে রাজী নন। রোসার মতে এই ধরনের তাত্ত্বিক অবস্থান বিপ্লবের সজীব বৈচিত্র্যকে নিষ্ক্রিয় যান্ত্রিকতায় পর্যবশিত করে।

লেনিনের উত্তর

এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করে লেনিন তাঁর নিজস্ব অবস্থানের যাথার্থতা যুক্তি এবং পাল্টাযুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। লেনিনীয় সংগঠনের ‘অতিকেন্দ্রিক ঝোঁকের যে সমালোচনা রোসা করেছেন লেনিন তা অস্বীকার করেছেন। তাঁর মন্তব্য দলের কেন্দ্রীয় কমিটি কোনমতেই ওপর থেকে স্থানীয় কমিটিগুলিকে সংগঠিত করে না। বরং ছবিটা অন্যরকম। লেনিন এই প্রসঙ্গে রোসাকে অনুরোধ করেছেন যে তিনি যদি স্থানীয় কমিটিগুলির প্রস্তাবগুলি দেখেন তাহলে লক্ষ্য করবেন যে অধিকাংশ সদস্যরাই কেন্দ্রীয় কমিটির হাতে যাবতীয় ক্ষমতা থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। অথচ রোসা এই জন বিতর্ককে লক্ষ্য করেন নি, বরং সব সময় অতি-সক্রিয় কেন্দ্রীয় কমিটি আর নিষ্ক্রিয় স্থানীয় কমিটির উল্লেখ করে সমালোচনা করে গেছেন। দলের অতি-কেন্দ্রিক ঝোঁকের কথা লেনিন অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে দলীয় কংগ্রেসেই ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবং রুশ শ্রমজীবিশ্রেণীই বারবার এই সিদ্ধান্তকে পালন করার কথা বলেছে। তাই রোসার যাবতীয় সমালোচনা অনেকটাই মনগড়া, বাস্তবের সঙ্গে এর কোন মিলই নেই। লেনিনের মন্তব্য অনুযায়ী বিপ্লবীদলের মূলভিত্তি হচ্ছে দলীয় কংগ্রেস এবং তিনি বারবার এর ওপর জোর দিয়েছেন। অথচ রোসা এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন। আসলে রোসা কিছু মনগড়া কথা লেনিনের মুখে বসিয়ে দিয়েছেন। ফলতঃ রোসা বলশেভিক দল গড়ে ওঠার সংগ্রাম, তার বাস্তব অভিজ্ঞতার দিকে নজরই দেননি। রোসার যাবতীয় অভিযোগ অনেকটাই বিমূর্ত, অবাস্তব।

রোসার বিরুদ্ধে লেনিন পাল্টা সমালোচনা করে বলেছেন যে আসলে তিনি ব্যাপক গণভিত্তি সম্পন্ন পার্টি কংগ্রেসের দীর্ঘ বিতর্ক আলাপ-আলোচনা, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ইত্যাদির দিকে নজর দেননি। নির্বাচন এবং ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্য দিয়েই এই প্রলেতারীয় বিপ্লবী দল গড়ে উঠেছে। এবং এর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু গোষ্ঠির যাবতীয় কার্যকলাপ (রোসা যার সমর্থক) অনেকটাই নৈরাজ্যবাদী। আসলে দলীয় আমলাতান্ত্রিকতা, অতিকেন্দ্রিকতার ধুয়ো তোলা এই সংখ্যালঘুরা সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। লেনিনের মতে রোসা যে অবস্থান নিচ্ছেন তা এক ধরনের বিকৃত মার্কসবাদ। দলীয় কংগ্রেসের দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, তাত্ত্বিক বিতর্ক, সংগ্রাম, ভোটাভুটি ইত্যাদি তার নজরে পড়ে না। তিনি যে অভিযোগগুলি তুলেছেন তা আসলে একধরনের বিমূর্ত অবাস্তব চিন্তাজাত, বাস্তবের সঙ্গে তার কোন মিল নেই।

এই প্রসঙ্গে লেনিন বলশেভিক দল গড়ে ওঠার পেছনে যে দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতা রয়েছে তার নির্দিষ্ট খতিয়ান দিয়েছেন।

রোসা-লেনিন বিতর্ক অনুধাবন করলে লক্ষ্য করা যায় যে, রোসার অভিযোগের উত্তরে লেনিনের অবস্থান মনে হয় অনেকটাই সাবধানী এবং আত্মরক্ষামূলক। দলের অতিকেন্দ্রিক ঝোঁকের বিরুদ্ধে রোসার অভিযোগকে তিনি খারিজ করার পাশাপাশি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে বিপ্লবী নেতৃত্ব এবং সংগঠনের ওপর জোর দিয়েছেন। তবে এই প্রসঙ্গে এটা মনে রাখতে হবে যে, কমিউনিস্ট দল সম্পর্কে লেনিন তাঁর অবস্থান অনেকবারই পাল্টেছেন। ১৯০৫ সালের পরবর্তীকালে রাশিয়ার বিপ্লবী পরিস্থিতির চাপে নেতৃত্ব এবং জনগণের মধ্যেকার দূরত্ব অনেকটাই কমে যায়। পরবর্তীকালে লেনিনও স্বীকার করেন যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন গোপন দলীয় সংগঠন নিস্তরঙ্গ বন্ধ জলাভূমিতে পরিণত হয়। তাই তিনি ব্যাপক গণভিত্তিক বিপ্লবী দল গড়ে তোলার কথা বলেন এবং কেন্দ্রিয় কমিটির বদলে দলীয় কংগ্রেসের ক্ষমতা বৃদ্ধির দাবী তোলেন। এতদসত্ত্বেও লেনিন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেশাদারী বিপ্লবী অগ্রগামী বাহিনীই যে শ্রমজীবি মানুষজনের একমাত্র দিশারী, এই তাত্ত্বিক অবস্থানে অবিচল ছিলেন। ১৯২১ সালে রুশ কম্যুনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসে এই মর্মে দুটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়। সেখানে যাবতীয় বিরোধী মতামত, দলের ভূমিকা নিয়ে ভিন্ন অবস্থান গড়ে তোলার দাবীকেও পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়। রোসা কিন্তু তাঁর পরবর্তী লেখা ‘দি রাশিয়ান রেভোল্যুশান’-এ এই লেনিনবাদী অবস্থানের সমালোচনা করে মন্তব্য করেছেন যে, অতিকেন্দ্রিক অগ্রগামী দলের সর্বব্যাপী অস্তিত্ব জনগণকে নিষ্ক্রিয় এবং নিস্তেজ করে দেয়। কারণ জনগণের মুক্তির সঠিক পথ নির্দেশ একমাত্র দিতে পারে তাদের অগ্রগামী দল। এর বিপরীতে রোসা অবাধ গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে। কারণ তাঁর কাছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে অবাধ গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নটিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

লেনিনবাদীদের অনেকেই অবশ্য রোসার এই অবস্থানের সমালোচনা করেন। লুকাচ মন্তব্য করেন যে রোসা বিপ্লব পরবর্তী রুশ পরিস্থিতি অনুধাবন না করেই সমালোচনা করেছেন। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার জটিল পরিস্থিতি, প্রতি-বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ, সমাজতন্ত্র নির্মাণকালীন সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে রোসার অবাধ গণতন্ত্রের দাবী এক ধরনের তাত্ত্বিক বিলাসিতা। বরং এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে দৃঢ় সংগঠন এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন সর্বাধিক।

রোসা-লেনিন বিতর্ক সম্পর্কে বলা যায় যে, রোসা কমিউনিস্ট দলের ভূমিকা প্রসঙ্গে যে সমস্ত প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাস্তব পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী লেনিন যে কমিউনিস্ট দলের ভূমিকার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তা অনস্বীকার্য। বিপ্লবী দলের লেনিন কথিত এলিটবাদী অবস্থানের খানিকটা শিথিলতা লক্ষ্য করা যায় পরবর্তী কালে; বিশেষ করে ১৯০৫ সাল থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যে লেনিনের যাবতীয় লেখাপত্রে এটা স্পষ্ট। তথাপি বিপ্লবী দল তথা অগ্রগামী গোষ্ঠীর অবিসংবাদী ভূমিকায় অবিচল আস্থা থেকে লেনিন বা তাঁর অনুগামীরা অনেকেই সরে আসেন নি। বরং বিপ্লবী দলের আদর্শায়িত রূপ হিসেবে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এই মডেল উপস্থাপিত হয়েছে। যতই বিপ্লবপূর্ব বা বিপ্লবপরবর্তী রুশ দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দোহাই দেওয়া হোক না কেন লেনিনবাদী মডেল যে সমস্ত পরিবেশেই প্রযোজ্য তার দাবী করা হয় সর্বত্র। এর ফলাফল লক্ষ্য করা যায় মার্কসীয় রাজনীতিক কর্মকাণ্ডে আর মতাদর্শের মধ্যে। ইতিহাস বিবর্তনের অমোঘ ক্রমপরিণতির তত্ত্ব সজ্জিত গোড়া মার্কসবাদ এলিটবাদী বিপ্লবী দলের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত প্রকাশ পায়, অনুগামীদের প্রতিনিয়ত ব্যস্ত রাখে তা বাস্তবায়িত করার কাজে। এই পরিস্থিতিতে জনগণের অস্তিত্ব বজায় থাকে পূর্বনির্ধারিত ইতিহাস অগ্রগতির নির্বাক বাহক হিসেবে। কারণ ইতিহাস সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়ে গেছে ‘সঠিক চৈতন্যে’র কেন্দ্র অগ্রগামী বাহিনীর মধ্যে। জনগণকে সঠিক পথে চালিত করার যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব লেনিনবাদী দল গ্রহণ করে তার মান্যতা অনেকটাই বাড়িয়ে তোলে ‘মার্কসীয় বৈজ্ঞানিকতা’। এর কোনরকম অন্যথা হবার কোন পরিসর অগ্রগামী বাহিনী পরিচালিত বিপ্লবে গড়ে ওঠে না। যদিও বা তা গড়েও ওঠে তা অগ্রগামী বাহিনীর কাছে অবৈজ্ঞানিক, পিছিয়ে পড়া বা অসুস্থ চৈতন্যর প্রকাশ। অর্থাৎ বিপ্লবী সচেতনতার একমাত্র আধার অগ্রগামী বাহিনীর নেতৃত্বের বাইরে সংগঠিত যাবতীয় উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা ‘বিশৃঙ্খলতার নামান্তর। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের তাত্ত্বিক অবস্থানের অনেকটাই লেনিনের পার্টি সম্পর্কে তত্ত্বের মধ্যে প্রতিফলিত যাকে রোসা তাঁর বিখ্যাত মাসস্ট্রাইক প্রবন্ধে চিহ্নিত করেছেন ‘পুলিসী দৃষ্টিভঙ্গি’ হিসেবে। তাই রোসার কাছে লেনিনের ‘অতি-কেন্দ্রিক’ পার্টির ধারণা বিপ্লবী সৃজনশীলতার বিনাশ ঘটায়, গণবিপ্লবের যাবতীয় সম্ভাবনা সংকীর্ণ পরিসরে বাঁধা পড়ে যায়। এই প্রবণতার সমালোচনা করেন রোসা তাঁর বিভিন্ন রচনায়।

গত কয়েক দশক জুড়ে বিপ্লবী পার্টি সম্পর্কে লেনিনীয় অবস্থানের অবিসংবাদিতা নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। স্বচালনবাদী পার্টির ধারণা যে বিপ্লবী জনগণের সৃজনশীলতা, উদ্যোগে ডাঁটার টান নিয়ে আসে তা আমরা সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অভিজ্ঞতায় দেখেছি। তাই সম্প্রতিককালে রোসার বিপ্লব তত্ত্বের গুরুত্ব নতুন করে অনুভূত হচ্ছে।