প্রশ্নঃ গণতন্ত্রের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সুবিধাসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, গণতন্ত্রের ইতিবাচক দিকসমূহ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘গণতন্ত্র’ একটি বহুল আলােচিত বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অপর কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে এত বেশি আলােচনার ঝড় বা এত বেশি বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় নি। গণতন্ত্র কোন নতুন ব্যবস্থা নয়। প্রাচীন কালে গ্রিস দেশে এ ধারণার সৃষ্টি হয়। সে সুদূর অতীত থেকে বিভিন্ন শতাব্দীতে নতুন নতুন ধ্যানধারণা একে প্রভাবিত করেছে। বর্তমান বিশ্বে এটি একটি জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা।

গণতন্ত্রের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহঃ আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র একটি জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা। এ শাসনব্যবস্থায় কতকগুলাে গুণ পরিলক্ষিত হয়। গুণসমূহ নিম্নরূপ-

১. স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বই গণতন্ত্রের ভিত্তিঃ স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব অনুসারে বলা হয়, প্রত্যেকেই তার নিজের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। এ স্বাভাবিক অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি। এ ব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তি তার শুভাশুভ নির্ধারণের সুযােগ পায়। লাওয়েল (Lowell) বলেছেন, “In a complete democracy no one can complain that he has not a curse to be heard.”

২. দেশপ্রেমের সৃষ্টিঃ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণের সমান সুযােগ থাকে এবং সকলের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। তাই সরকারকে তাদের নিজেদের সরকার হিসেবে ভাবতে শেখে। ফলে জনসাধারণের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি সৃষ্টি হয়।

৩. আইনের শাসনঃ গণতন্ত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল ক্ষেত্রে জনগণই চূড়ান্ত বিচারক। ফলে সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণের পথ রুদ্ধ থাকে।

৪. হিতবাদী তত্ত্বের সমাধানঃ হিতবাদী তত্ত্বে বলা হয়, সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এ মৌলিক উদ্দেশ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। হিতবাদী জেমস মিল বলেছেন, গণতন্ত্র হলাে বর্তমান যুগের সর্বোৎকৃষ্ট উদ্ভাবন।

৫. আদর্শবাদের সমর্থনঃ আদর্শবাদী তত্ত্বে গণতন্ত্রের স্বীকৃতি ও সমাধান পাওয়া যায়। আদর্শবাদে বলা হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় যেখানে ব্যক্তি আত্মবিকাশের সর্বাধিক সুযােগ লাভ করে।

৬. ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠাঃ গণতন্ত্র হলাে ন্যায়নীতিভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এ ব্যবস্থায় সকলের সাথে মতামতের আদানপ্রদানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় এবং সাম্য ও স্বাধীনতা সংরক্ষিত হয়।

৭. সর্বসাধারণের কল্যাণঃ গণতন্ত্রেই সকল রাজনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে। এইচ লাস্কি বলেছেন, জনকল্যাণ সাধন যদি সরকারের লক্ষ্য হয় তবে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের হাতেই থাকা আবশ্যক। তাই গণতন্ত্রে সর্বসাধারণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল বিধানের জন্য সরকারি ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়।

৮. স্বায়ত্তশাসনের সুবিধাঃ স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে জনগণের মানসিক উন্নতি সাধন সম্ভব। আর গণতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসনের অবাধ সুযােগ রয়েছে। জনগণ শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযােগ পায়।

৯. রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তারঃ গণতন্ত্রে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযােগ পায়। এতে জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যাপক সুযােগ ঘটে। জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়।

১০. দায়িত্বশীলতাঃ গণতন্ত্রে শাসিতের কাছে শাসক দায়িত্বশীল থাকে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ জনগণের কাছে দায়ী থাকে। আবার রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে।

১১. স্থায়িত্বঃ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের পিছনে জনগণের ব্যাপক সম্মতি বর্তমান থাকে। সে জন্য গণতান্ত্রিক সরকার স্থায়ী হয়। স্থায়ী গণতান্ত্রিক সরকার সুশাসন নিশ্চিত করে।

১২. স্বৈরাচারিতা রােধঃ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কারণ এ ধরনের শাসনব্যবস্থা হলাে জনমত পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। জনমতের ভয়ে সরকার সাধারণত স্বৈরাচারী হতে পারে না।

১৩. সুশাসন প্রতিষ্ঠাঃ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনব্যবস্থা পরিচালনার চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতেই ন্যস্ত থাকে। উপযােগবাদী তাত্ত্বিক জেমস মিল, জেরিমি বেন্থাম প্রমুখ গণতন্ত্রের সমর্থকরা বলেন, সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক মঙ্গল সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল সুযােগ সুবিধা সকলেই ভােগ করার সুযােগ পায়, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।

১৪. শাসক ও শাসিতের সুসম্পর্কঃ শাসক ও শাসিতের স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান ও সর্বাধিক জনগণের কল্যাণ সাধনের উপর সুশাসন নির্ভর করে। এজন্যই উপযােগবাদী দার্শনিক জেমস মিল (James Mill) বলেছেন, “গণতন্ত্র হলাে বর্তমান যুগের সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা।”

১৫. বিপ্লবের আশঙ্কামুক্তঃ গণতন্ত্রের ক্ষমতার উৎসগুলাে ব্যালট এবং শাসনের ভিত্তি হলাে শাসিতের সম্মতি। সকল সিদ্ধান্ত ও কাজকর্মের পিছনে জনগণের অনুমােদন থাকে। তাই জনমনে ক্ষোভ সঞ্চারিত হতে পারে না। ফলে রাষ্ট্র বিপ্লবের আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকে।

উপসংহারঃ পরিশেষে আমরা বলতে পারি, উপরের আলােচনায় গণতন্ত্রের যেসব সুবিধার কথা উল্লেখ করা হলাে তাতে প্রমাণিত হয় শাসন পরিচালনায় গণতন্ত্রের কোন বিকল্প নেই। কেননা একমাত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় পুরােপুরি জনকল্যাণ রক্ষিত হয়।