বুর্জোয়া ধারণা:

গণতন্ত্র ও বিপ্লবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে মতপার্থক্যের অবধি নেই। এ প্রসঙ্গে মার্কসবাদী ও মার্কসবাদ-বিরোধী তাত্ত্বিকগণ পরস্পর-বিরোধী মতামত পোষণ করেন। এই মতপার্থক্যের কারণ গণতন্ত্র ও বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণাগত পার্থক্যের মধ্যেই নিহিত আছে। আপৃথেকারের মতে, এ বিষয়ে সর্বাধিক প্রচলিত প্রবণতা হল বিপ্লবকে গণতন্ত্রের পরিপন্থী হিসাবে প্রতিপন্ন করা। তাঁর কথায়, “…none is more widespread than that which places revolution as antithetical to democracy.” বলা হয়, বিপ্লব গণতান্ত্রিক আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। গণতন্ত্র শান্তিপূর্ণ পথে সামাজিক ও রাজনীতিক পরিবর্তনের পক্ষপাতী। কিন্তু বিপ্লব হিংসাত্মক পথে সামাজিক ও রাজনীতিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী। হিংসা এবং গণতন্ত্র একে অপরের বিরোধী। এই কারণে চূড়ান্তভাবে বিপ্লবও গণতন্ত্রের বিরোধী হয়। আরও বলা হয় যে, বৈপ্লবিক পন্থা মূলত ষঢ়যন্ত্রমূলক প্রকৃতির। কিন্তু গণতন্ত্র ষড়যন্ত্রমূলক প্রকৃতির বিরোধী। গণতন্ত্রে যাবতীয় কাজকর্ম প্রকাশ্যে এবং প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত হয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হল প্রকাশ্য পদ্ধতি। গণতন্ত্রে কোন রকম গোপনীয়তার স্থান নেই। অপরদিকে বিপ্লবের সঙ্গে হিংসা, গোপনীয়তা ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কযুক্ত। এই কারণে গণতন্ত্র ও বিপ্লব পরস্পরের বিরোধী। বিপ্লব, হিংসা ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের সহাবস্থান সম্ভব নয়। অতএব বিপ্লব ও গণতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয়সাধন বাস্তবে অসম্ভব। গণতন্ত্র ও বিপ্লবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ক উপরিউক্ত ধারণা হল মার্কসবাদ-বিরোধী তাত্ত্বিকদের ধারণা।

প্রতি-বিপ্লবই গণতন্ত্রের বিরোধী:

মার্কসবাদিগণ বুর্জোয়া দার্শনিকদের উপরিউক্ত ধারণাকে স্বীকার করেন না। আপ্‌থেকারের অভিমত অনুসারে বুর্জোয়া তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের এই ধারণা অবাস্তব। তিনি পরিহাস করে বলেছেন: “Such ideas are in line with the hollywood version of revolution, not with the actuality.” প্রতি-বিপ্লবই হল গণতন্ত্রের বিরোধী এবং সেইজন্য তা ষড়যন্ত্রমূলক (“It is counter revolution which is anti-democratic and therefore conspiratorial in character.”)। প্রতিবিপ্লব জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বার্থের পরিপন্থী। প্রতি-বিপ্লব হিংসা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয় এবং সংখ্যাগুরু মানুষের প্রতি অবজ্ঞা পোষণ করে। এই প্রতিবিপ্লব শ্রেষ্ঠতাবাদী ও শোষক প্রকৃতির।

গণতন্ত্র ও বৈপ্লবিক পদ্ধতির মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়:

বস্তুত গণতন্ত্র ও বৈপ্লবিক পদ্ধতির মধ্যে কোন বিরোধ নেই। বরং উভয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান। বস্তুত বিপ্লব থেকে এই গণতন্ত্রের ধারণাটির উদ্ভব হয়েছে। আপথেকার বলেছেন: “The concept of democracy is born of revolution.” গণতন্ত্র বলতে যদি জনসাধারণের ব্যাপক ভূমিকাকে বোঝায় তাহলে বিপ্লবের মধ্যে এই গণতন্ত্রের নির্যাস নিহিত আছে। বৈপ্লধিক প্রক্রিয়া এবং তার পরিণতি গণতন্ত্র বিরোধী তো নয়ই বরং গণতন্ত্রের মৌলিক আদর্শের পরিপোষক। বিপ্লবের প্রকৃতি যত মৌলিক হবে, গণতন্ত্রও তত গভীর ও ব্যাপক হবে। সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের ধারণাও প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হবে। আপথেকার বলেছেন: “…the whole revolutionary process and culmination, far from being country to democracy, represents its quintessence. And the more fundamental the nature of the revolutionary process, the more democratic it will be…..” মৌলিক বিপ্লব সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষের নিবিড়তম সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের ফলে বিস্তৃত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কারণে বিপ্লব হল স্বদেশজাত এবং সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্রসম্মত। সকল ক্ষেত্রে গণসার্বভৌমিকতার পরিপূর্ণ রূপায়ণ বর্তমান ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এরকম অবস্থায় বৈপ্লবিক পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ও ষড়যন্ত্র-বিরোধী প্রকৃতি অত্যন্ত স্পষ্ট। আপথেকারের মতানুসারে, অতীতের সকল ঐতিহাসিক বিকাশের মধ্যে বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াই হল সর্বাধিক গণতন্ত্রসম্মত। বর্তমানে ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের এই অন্তর্বর্তীকালীন যুগে, অনুপ্রেরণা, সংগঠন এবং উদ্দেশ্য ও তার রূপায়ণের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া পুরোপুরি গণতান্ত্রিক থাকে। তিনি বলেছেন: “To conclude the revolutionary process was the most democratic of all historical developments in the past, and in the present era, the era of the transition from capitalism to socialism, the revolutionary process remains throughly democratic, in inspiration, in organisation, in purpose, and in mode of accomplishment.”

শোষক শ্রেণীই বিপ্লবকে গণতন্ত্র-বিরোধী বলে:

প্রকৃতপক্ষে শোষণকারী শাসকশ্রেণীগুলি বৈপ্লবিক আন্দোলনকে গণতন্ত্র-বিরোধী আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। এবং এই অজুহাতে তারা যাবতীয় বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার বিরূপ সমালোচনা করে থাকে। বৈপ্লবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ শ্রমজীবী জনতাকে দমন করার জন্য শাসকশ্রেণী বিপ্লবকে গণতন্ত্র-বিরোধী ও অবৈধ ঘোষণার ব্যাপারে যত্নবান হয়। শোষক শাসকশ্রেণীর মধ্যে এক অন্তর্নিহিত শ্রেষ্ঠতাবাদ থাকে এবং জনসাধারণ সম্পর্কে অবজ্ঞার ধারণা থাকে। জনগণ সম্পর্কে তারা পিতৃত্বমূলক ধারণা পোষণ করে। তারা এটাই জাহির করতে চায় যে, জনগণের পক্ষে কোনটা ভাল আর কোন্‌টা মন্দ সে-বিষয়ে তারা সম্যকভাবে অবহিত। শোষণের স্বার্থে শাসকশ্রেণী তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে আদর্শ হিসাবে চালু রাখতে চায়। তাই তারা এই অবস্থার বিরুদ্ধে যে-কোন বৈপ্লবিক আন্দোলনকে গণতন্ত্র -বিরোধী আখ্যা দিয়ে নিন্দাবাদের চেষ্টা করে থাকে।

গণতন্ত্র সম্পর্কে বুর্জোয়া ধারণা ও মার্কসীয় ধারণা পৃথক:

যাইহোক, উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে বিপ্লব ও গণতন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে ব্যাপক মতানৈক্য বর্তমান। এরকম তীব্র মতপার্থক্যের মূল কারণ গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রচলিত বুর্জোয়া ধারণা ও মার্কসীয় ধারণার মধ্যে নিহিত আছে। গণতন্ত্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত বুর্জোয়া চিন্তাধারার উৎস হল বুর্জোয়া শ্রেণী ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন শক্তির উন্নতি, উৎপাদন-উপাদানের কেন্দ্রীভবন, অব্যাহত শ্রমিক-শোষণ প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। এবং এই সবের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র বুর্জোয়া-শ্রেণীর স্বার্থে তাদের হাতে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে থাকে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে উৎপাদন ব্যবস্থা বাস্তবে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এবং এই মুষ্টিমেয় মালিকশ্রেণীর আর্থনীতিক স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই প্রশাসন যন্ত্র পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে বুর্জোয়া রাষ্ট্র হল পুঁজিপতিদের একনায়কতন্ত্রের সামিল। তারপর সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উপনীত হওয়ার পরে এই রাষ্ট্রব্যবস্থা একচেটিয়া পুঁজিগঠনে আত্মনিয়োগ করে। এবং পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতার সামিল হয়।