উত্তর রৈবিক বাংলা কবিতা আন্দোলনে বিশশতকের চল্লিশের দশক হয়ে উঠেছিল ‘শতাব্দীর রাক্ষসীবেলা’। আক্ষরিকভাবেই সুকান্ত ভট্টাচার্য এই ক্রান্তিলগ্নের কবি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে এলেও মহাকাল যেন অন্য এক মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছিল সেদিন। স্বৈরতন্ত্রের আগ্রাসী আস্ফালনে যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর অসংখ্য নিপীড়িত মানুষগণ অভ্যূত্থানের জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলনে মেতে উঠছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে উঠছে দিকে দিকে। এমন একটি সময়ে ব্রিটিশ সরকারের পোড়ামাটি নীতি, মজুতদার, মুনাফালোভী সুযোগ সন্ধানী আত্মপর ব্যবসায়ীদের লোভ-লালসা, এক কৃত্রিম মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। বাংলাদেশের অসংখ্য সমৃদ্ধ গ্রাম, ও তার জনমানসে আগুন লাগল। লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে অথবা অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল সেদিন। মনুষ্যত্বের এই সর্বব্যাপী অবক্ষয়ের সামনে দাঁড়িয়ে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি মানুষের বিবেক কেঁপে উঠেছিল সেদিন। মানবতাবোধের এই ‘সার্বিক অপচয়ের প্রতিরোধে, মানুষকে সংঘবদ্ধ করবার বৈপ্লবিক সংবেদনা নিয়েই এরা গান-কবিতা-গল্প-কথাসাহিত্য এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুললেন। চল্লিশের দশকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির মৌল প্রেরণাই হয়ে উঠেছিল গনসংবেদী সাধনার অঙ্গীকার। সংবেদনশীল গণসাহিত্য রচনার এই অঙ্গীকার নিয়েই সুকান্ত ভট্টাচার্য লালন করেছিলেন তাঁর কবিসত্তাকে। লিখেছিলেন,

“অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি 

জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি।”

এই বিচিত্র আঘাত ও সংঘাতের মুখে সমস্ত দেশ যখন উত্তাল, খেটে খাওয়া, হতদরিদ্র মানুষগুলি সময়ের প্রবল সঙ্কটলগ্নে দাঁড়িয়ে যখন মহাজাগরণের জন্য উন্মুখ ঠিক সেই সময়েই সুকান্ত গণআন্দোলন ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেয়ে গেছেন তিনি। ‘জনরক্ষা সমিতি’র স্বেচ্ছাসেবকরূপে খাদ্য আন্দোলনে যোগদান, নিরন্ন মানুষদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার মতো কাজগুলিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন সুকান্ত। ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের মন্বন্তরকালীন কবিতা সংকলন ‘আজকাল’ সম্পাদনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। এই দুঃসময়ের প্রবল অভিজ্ঞতায় মননসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন বলেই সুকান্তের কবিতায় দুর্ভিক্ষ প্রবলভাবে এসেছে। ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবেও এসময় বহু জেলায় পাঠানো হয়েছিল সুকান্তকে। মন্বন্তরকালীন কবিতা সংকলন ‘আকাল’-এর ভূমিকায় সুকান্ত এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন তুলেছিলেন। এই প্রশ্ন শুধুমাত্র সমাজ সভ্যতার নামধারী শোষক বর্বরদের বিরুদ্ধে নয়, এই প্রশ্ন নিজের সমস্ত বোধ-বিবেক সত্তার কাছেও “বাংলাদেশের আধুনিক কবিরা কি চিত্তে ও চিন্তায়, ধ্যানে ও জ্ঞানে, প্রকাশে ও প্রেরণায় জনসাধারণের অভাব-অনাহার, পীড়া-পীড়ন আর মৃত্যু-মন্বন্তরকে প্রবলভাবে উপলব্ধি করেন? তাঁরা কি নিজেকে মনে করেন দুর্গত জনের মুখপাত্র ? তাঁদের অনুক্ত ভাষাকে কি করেন নিজের ভাষায় ভাষান্তরিত ?”

গণচেতনার জাগরণের এই বিচিত্র জিজ্ঞাসার উত্তরও দিয়েছেন কবি। সুকান্ত এই ভূমিকায় বলেছেন, “তেরোশো পঞ্চাশ সম্বন্ধে কোনো বাঙালিকে কিছু বলতে যাওয়া অপচেষ্টা ছাড়া আর কি হতে পারে ? কেননা তেরোশো পঞ্চাশ কেবল ইতিহাসের একটা সাল নয়, নিজের একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস, সে ইতিহাস একটা দেশ শ্মশান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস, ঘরভাঙা-গ্রামছাড়ার ইতিহাস, দোরে দোরে কান্না আর পথে পথে মৃত্যুর ইতিহাস, আমাদের অক্ষমতার ইতিহাস। তাই যাঁরা প্রকৃত কবির মতো, স্বদেশ বৎসলের মতো পঞ্চাশ সালের দুর্ভিক্ষের বিভ্রান্ত জনমনকে দিলেন সান্ত্বনা, অন্ধকারে বসে গাইলেন সূর্যোদয়ের গান, তাঁরা আমাদের অভিনন্দনীয়।” সমকালীনতার এই প্রবল প্রভাবে চল্লিশের দশকের সমস্ত কবি শিল্পী-সাহিত্যিকের রচনাই হয়ে উঠেছিল গনসংবেদী। দুর্ভিক্ষের এই প্রখর সময়ে সচেতন সুকান্তের লেখনীতেও বারবার উঠে এসেছে দুর্ভিক্ষের ছবি, প্রেক্ষিত এবং তা থেকে উত্তরণের আশ্চর্য আলোকসম্পাতি অভিযাত্রার কথা। ক্ষুধার জ্বালা তাই প্রথম থেকেই আবর্তিত হয়েছে সুকান্তের কবিতায়। এমনকি রবীন্দ্রস্মরণ অনুষ্ঠানের কবিতা প্রসঙ্গে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল এই ক্ষুধা –

“আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায় “

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ভাঙনের প্রবল অভিঘাতে জর্জরিত হতে হতে সুকান্ত ভট্টাচার্য কবি হয়ে ওঠেন। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত মানুষের তীব্র হাহাকার ও বেদনাই রূপায়িত হয়েছে সমস্ত কাব্যজীবন ধরে। মানবসভ্যতার বিকাশ ও পরিবর্তনের ইতিবৃত্তকে বুঝতে হলে বেশ কয়েকটি স্তর বিন্যাসের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সামন্ততন্ত্রের পরিকাঠামো ভেঙে ধনতন্ত্রের উত্থান ঘটে। এই ধনতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট স্থায়ী ভিত্তি প্রসারিত হয় গণতান্ত্রিক চেতনার সম্প্রসারণে। আবার ধনতন্ত্রের পতনে শ্রমিক শ্রেণির অভ্যুত্থানে গড়ে ওঠে সমাজতন্ত্র, যা সর্বহারাদের এক নায়কতন্ত্রের বিন্যাসটিকে রূপ দেয়। আবার এই ভাবনার চূড়ান্ত প্রকাশ সাম্যবাদে। যার আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজের আদর্শগত সংজ্ঞাকে অস্বীকার করে ব্যক্তিগত মালিকানার যাবতীয় ধারণা ভেঙে ফেলে শুধুমাত্র কমিউনের মাধ্যমে মানবজীবন চালনা করা। আবার গণতন্ত্রের এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ক্রমে ক্রমে পুঁজিবাদী সমাজসভ্যতার হাত ধরে জন্ম নিল ফ্যাসীবাদ বা স্বৈরচারী একনায়কতন্ত্র। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রগুলির একনায়কতন্ত্রই এই যুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই পটভূমিই তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মানসলোকে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে, সেইসঙ্গে ছিল ভারত ছাড় আন্দোলন (১৯০২) কমিউনিস্ট পার্টির জনযুদ্ধ বা ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনের মতো ঘটনাবলী। কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হিসাবে কবিতাকে ছেড়ে দিয়ে নয়, কবিতাকে নিয়েই তিনি সাম্রাজ্যবাদ তথা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে যোগ দেন। সুকান্তের এ লড়াই আসলে পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট মনের বিপ্লব। একাজে যোগ দিতে গিয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতি তাকে অসহায় সমর্থনও জানাতে হয়েছিল। পরাধীন ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী জনচেতনা থেকে কমিউনিস্টদের এই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দ্বন্দ্বও নানা ভাবে ভাষায় রূপায়িত হয়েছিল। কিন্তু গণসংবেদনশীল কবিতা রচনার ধারাটি কখনও বন্ধ হয়ে যায়নি সুকান্তের। বলা যায় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি, মন্বন্তর, দাঙ্গার কালো আগুনে পুড়তে পুড়তেই সুকান্ত তার কবিতাকে গণসংবেদনের হাতিয়ার করে তুলেছিলেন। ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের ‘বোধন’ কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম নয়।

১৩৫০-এর প্রবল প্রেক্ষাপটে মন্বন্তর, মারী ও মড়কে ছিন্নভিন্ন বাংলার বুকে যে মর্মান্তিক দৃশ্যের ক্রম ও চিরস্থায়ী পরিণতি সূচিত হয়েছিল সেই সমূহ বিপর্যয়কে ভাষারূপ দিয়েছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘বোধন’ কবিতায়। প্রাকৃতিক বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র কারণ তো ছিলই, কিন্তু তদপেক্ষা অধিক হয়ে উঠেছিল মজুতদার কালোবাজারী ও মুনাফালোভীদের শস্য বাজেয়াপ্ত করে কৃত্রিম অন্নাভাব তৈরি করার চক্রান্ত। মন্বন্তরের প্রবল ছবির পাশাপাশি এই সমস্ত অর্থলোলুপ মানুষগুলির লোভ বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ছবিও সুকান্ত তার ‘বোধন’ কবিতাটিতে দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন শস্য গোপন করে মানুষকে চিরস্থায়ী মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় যারা তাদের কাছে কৃপা ভিক্ষা করাও এক ধরনের পাপ, তা আসলে নিশ্চিত মৃত্যুকেই আবাহন করার নামান্তর।

“ধূর্ত প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষগ্রাস

তাদের করেছ ক্ষমা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ।”

লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে যারা লোভের প্রাসাদ গড়ার ষড়যন্ত্র করে চলেছে তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষদের শ্রেণিগত বিভাজনকে স্পষ্ট করার জন্যই কবি বলেছেন,

‘তুমি তো প্রহর গোনো

তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি 

তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি

তোমাকে বিদ্রূপ করে……”

আমাদের মনে হয় এ কবিতায় সুকান্ত মন্বন্তরের চিত্র এঁকেই থেমে থাকতে চাননি। মানুষের অসহায়তা ও নিঃশ্চষ্ট মনোভাবকে আঘাত করবার জন্য এই সংহতিহীন দীর্ণ মানবিক অবক্ষয়ের ছবিও এঁকেছেন। মানুষের অন্তলীন চেতনাকে জাগ্রত করে রাখবার জন্য, ক্ষমাহীন দৃষ্টিতে নির্মম অমানবিকতাকে আঘাত করবার জন্য সাধারণ শ্রমিক-কৃষককে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলেছেন তিনি। বিদেশি শাসক ও ক্ষমতাসীন সরকারের নির্লজ্জ মানসিকতা, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বিবেকহীন বর্বরতায় লক্ষ লক্ষ প্রাণ ও বাংলার সমৃদ্ধ গ্রামগুলি কীভাবে শ্মশানে পরিণত হয়ে গেছে, সেই কথাই বাণীময় হয়ে উঠেছে সুকান্তের স্লোগানধর্মী উচ্চারণে,

“লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম

অনেক দিয়েছি; উজাড় গ্রাম

সুদ ও আসলে আজকে তাই

যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই।”

গণচেতনার বলিষ্ঠ জাগরণ ও চেতনার নব উন্মেষ না ঘটলে এমন উচ্চারণ সম্ভব নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সাথে সাথে, বিদেশি শাসকের কূটকৌশল আমাদের সাধারণ জনমানসে সৃষ্টি করে চলেছে সাম্প্রদায়িক সমস্যা, মানসিকতার বৈষম্য। সময়ের এই করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসবার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বদলে বিচ্ছিন্ন শিকার হয়ে পড়ছে মানুষ। সমস্তরকম দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠে কবি সর্বহারা জনতার মুখে তুলে দিয়েছেন দুর্ভিক্ষের ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ভীষণ সংকল্প,

স্বদেশ প্রেমের ব্যঙ্গমা পাখি 

মারণমন্ত্র বলে শোনো তা কি?

এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র?

করো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্র 

শোনরে মালিক, শোনরে মজুতদার

তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের

হাড় হিসাব কি দিবি তার?”

চেতনার এই জাগরণ ঘটিয়ে আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলার সংগ্রামী আহ্বান এর আগেও সুকান্তের কবিতায় দেখা গেছে,

“পণ করো, দৈত্যের অঙ্গে

হানবো বজ্রাঘাত, মিলব সবাই একসঙ্গে

সংগ্রাম শুরু করো মুক্তির 

দিন নেই তর্ক ও যুক্তির।”

সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় গণসংবেদী চেতনার দাবানল জ্বলে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে যারা শোষিত লাঞ্ছিত ক্ষুধিত সেইসব শ্রমিক কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে তাদের রক্তে জ্বেলে দিয়েছেন তিনি প্রতিবাদ-প্রতিশোধের আগুন। স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যতের প্রান্তরেখা ছুঁয়ে ছুঁয়ে স্বজন হারানোর নিরবচ্ছিন্ন বেদনা শ্মশানের চিতার আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে চেতনায়। অসহায় মানুষের ক্ষোভ বঞ্চনাকে তীক্ষ্ণ সংবেদনশীল মন নিয়ে ব্যক্ত করেছেন তিনি,

প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা

ভেঙেছিস ঘরবাড়ি 

সে কথা কি আমি জীবনে মরণে

কখনও ভুলিতে পারি ?

আদিম হিংস্ৰ মানবিকতার যদি আমি কেউ হই

স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের 

চিতা আমি তুলবই।

তীব্র প্রাণোন্মাদনায় সর্বস্বান্ত জনগণের পুঞ্জিত দীর্ঘশ্বাস, ক্রোধকে এমন সার্থক উপস্থাপনা আর কেউ কখনও দিতে পারেনি। এখানেই থেমে থাকেননি, কবি, তাঁর আত্মগত আমির বৈপ্লবিক চেতনাকে সমষ্টি চেতনায় সম্প্রসারিত করে তিনি বলেছেন, যারা এই জনজাগরণে অংশ নেবে না, যাদের ভিতর এখনও ভীরুতা আর কাপুরুষতা বাসা বেঁধে আছে, মানবাত্মার চরম লাঞ্ছনায় সেইসব অন্যায়কারীদের সঙ্গে অন্যায় সহ্য করবার মাধ্যমে যারা হাত মিলিয়েছে তারাও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাবে না। এদেশের মাটি জল বাতাস যাদের প্রাণে শক্তি, বাহুতে বল জুগিয়েছে এদেশের সেই প্রকৃতিই অসম্ভব প্রতিকূলতায় স্বার্থান্বেষী বর্বর মানুষগুলির সাথে সাথে ভীরু কাপুরুষ, মৃঢ় মানুষগুলির ওপরও সমান আঘাতে বজ্র হয়ে নেমে আসবে। তাইতো কবির ক্রোধদীপ্ত উচ্চারণ,

“তা যদি না হয়, মাথার উপরে ভয়ঙ্কর 

বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর

তা যদি না হয়, বুঝব তুমি তো মানুষ নও 

গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও। 

ভারতবর্ষ মাটি দেয়নি কো, দেয়নি জল 

দেয়নি তোমার মুখেতে অন্ন বাহুতে বল

পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে তাই

ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই।

অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্যের কবিতাটির এই শেষাংশটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে “রৌদ্ররসের যোগ্য এমন অনুভব বাংলা কাব্যে দুর্লভ। এ আমির মধ্যে আছে বিরাট জনচিত্তের অপরিসীম আত্মসম্বিৎ।” কবিতাটির মধ্যে সমকালীন যুগের বিস্তারিত জনচিত্তের পুঞ্জিভূত ক্রোধ প্রতিফলিত হয়েছে। সেইসঙ্গে এসেছে সংগ্রামী মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, গণজাগরণে অংশ নিতে পারার বৈপ্লবিক অগ্নিমন্ত্রের সার্বিক দীক্ষা। ‘বোধন’ কবিতাটি তাই গণসংবেদী চেতনার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত একথা বলা যায়।