অথবা, হযরত ওমরের (রা) রাজ্য শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে যা জান লেখ।
অথবা, খলিফা ওমর (রা)-এর শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য আলােচনা কর।
অথবা, শাসক হিসেবে হযরত ওমরের (রা) কৃতিত্ব নিরূপণ কর।
উপস্থাপনাঃ ইসলামের ইতিহাসে হযরত ওমর (রা) বিজেতা হিসেবে যতখানি কৃতিত্বের দাবিদার, শাসক হিসেবেও তিনি ততােধিক গৌরবের অধিকারী। তিনি ছিলেন ইসলামের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সর্বপ্রথম ইসলামী শাসনতন্ত্রের মূলনীতি নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন, যা পরবর্তীকালে বহু বছর যাবৎ কার্যকর ছিল। এজন্য সৈয়দ আমীর আলী বলেন The title was continued by Omar who may be regarded as the practical founder of the political administration of Islam.
ওমর (রা)-এর শাসনব্যবস্থা
হযরত ওমর (রা)- এর প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্য ও কাঠামােঃ
১. শাসনব্যবস্থার মূলনীতিঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, চারটি মূলনীতির ওপর হযরত ওমর (রা)-এর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। তা হলাে- ক. আল কুরআন, খ. আল হাদীস, গ. আল ইজমা ও ঘ. আল কেয়াস।
২. গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাঃ হযরত ওমর (রা) ছিলেন একজন পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসক। তার শাসনব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত ছিল। গণতন্ত্রের ভিত্তিতে তিনি ইসলামী হুকুমত পরিচালনা করতেন। ঐতিহাসিক মাওলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, Under Omar the principle of democracy was carried to a point to which it will yet take the world time attain.
৩. ইসলামী জাতীয়তাবাদঃ ইসলামী জাতীয়তাবাদ অক্ষুন্ন রাখার মানসে তিনি খায়বার থেকে ইহুদিদের এবং নাজরান থেকে খ্রিস্টানদের উচ্ছেদ করে অন্যত্র বসবাসের ব্যবস্থা করেন।
৪. কর্মকর্তাদের আচরণবিধি প্রণয়নঃ হযরত ওমর (রা) মজলিসে শূরার সাথে পরামর্শ করে সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণবিধি প্রণয়ন করেন। এ আচরণ বিধি মােতাবেক কোনাে সরকারি কর্মকর্তার মিহি পােশাক পরিধান, মােলায়েম রুটি খাওয়া, দরজায় দারােয়ান ও উৎকৃষ্ট মানের তুর্কি ঘােড়া ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পরন্ত নিজেদের সরকার দায়িত্বের অংশ হিসেবে রুগ্ণ ব্যক্তিকে দেখতে যাবে এবং মৃতের জানাযায় শরীক হবে।
৫. নগরে মতামত গ্রহণঃ রাজ্য শাসন এবং প্রদেশ ও জেলায় শাসনকর্তা নিয়ােগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের মতামত গ্রহণ করতেন।
৬. শাসনের ব্যাপারে সকলেই সমানঃ হযরত ওমর (রা) শাসন ব্যবস্থাকে ইসলামের সাম্য, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক নীতির ওপর গড়ে তলেছিলেন। শাসক ও শাসিতের মধ্যে তিনি কোনাে ভেদাভেদ রাখেননি কিংবা নিজে সাধারণ প্রজা অপেক্ষা বেশি সুযােগ সুবিধা ভােগ করেননি। তার নিকট সকলেই সমান ছিল।
৭, মজলিসে শূরাঃ শাসনকার্যের সুবিধার জন্য হযরত ওমর (রা) ‘মজলসে শুরা’ নামে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। এ পরিষদ মজলিসে আম ও মজলিসে খাস-এ দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। যেমন
(i) মজলিস-ই আমি (সাধারণ পরিষদ): বয়ােজ্যেষ্ঠ সাহাবা এবং মদিনার গণ্যমান্য লোক নিয়ে মজলিস-ই আম গঠিত ছিল। কোনাে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য মদিনার প্রধান মসজিদে খলিফা এ পরিষদের সভা ডাকতেন।
(ii) মজলিস-ই খাসি (বিশেষ পরিষদ): দৈনন্দিন এন্তেজাম ও আলাপ আলােচনার জন্য তিনি এ মজলিস-ই খাসের পরামর্শ নিতেন। এ পরিষদে কেবল মুহাজিরদের মধ্য হতে কতিপয় প্রতিনিধি উপস্থিত হতেন।
হযরত ওমর (রা)- এর শাসনতান্ত্রিক সংস্কারঃ
ওমর (রা)-এর শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযােগ্য দিকগুলাে হলাে-
১. কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থাঃ হযরত ওমর (রা) কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সরকারের সর্বাধিনায়ক হন। তিনি বিভিন্ন উচ্চ পদে যােগ্যতম সাহাবীদের নিয়ােগ করে সাম্য ও ন্যায়নীতিভিত্তিক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
২. প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থাঃ শাসনকার্যের সুবিধার জন্য হযরত ওমর (রা) সমগ্র সাম্রাজ্যকে ১৪টি প্রদেশে এবং প্রদেশগুলােকে জেলায় বিভক্ত করেন। প্রদেশের শাসনকর্তার উপাধি ছিল আমীর, আর জেলার শাসক ছিলেন ওয়ালী বা নায়েব।
৩. পুলিশ বিভাগ প্রতিষ্ঠাঃ জনগণের জান মাল রক্ষা ও অপরাধ বৃত্তি প্রতিরােধকল্পে হযরত ওমর (রা) সর্বপ্রথম একটি সুগঠিত পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। এ বাহিনীর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে ‘দিওয়ানুল আহদাত’ নামে একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
৪. জেলখানা নির্মাণঃ খলিফা ৪০০০ দিরহামে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার বাড়ি ক্রয় করে একে জেলখানায় রূপান্তর করেন। এছাড়া প্রত্যেক প্রদেশ এবং জেলা শহরেও একটি করে জেলখানা নির্মাণের নির্দেশ প্রদান করেন।
৫. গুপ্তচর বিভাগ প্রতিষ্ঠাঃ আল্লামা শিবলী নােমানী বলেন, শাসন ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার জন্য খলিফা ওমর (রা) গুপ্তচর বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কার্যাবলি সম্পর্কে সম্যক ধারণালাভের উদ্দেশ্যে তিনি গুপ্তচর নিযুক্ত করতেন।
গ. স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠাঃ খলিফা ওমর (রা) বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। কাযীরা পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ফয়সালা অনুসারে বিচার করতেন। কাযী তার কর্তব্য সম্পাদনের নিমিত্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতা পেতেন।
হযরত ওমর (রা)-এর রাষ্ট্রীয় আয় ও ব্যয়ঃ
হযরত ওমর (রা) রাষ্ট্রীয় আয়ের কয়েকটি উৎস নির্ধারণ করেন। যেমন-
১. রাজস্ব ব্যবস্থাঃ হযরত ওমর (রা) পূর্ববর্তী সকল রাজস্বনীতি বাতিল করে কুরআন সুন্নাহর নীতিতে রাজস্বব্যবস্থা চালু করেন। সুষ্ঠু অবকাঠামাে নির্মাণ এবং রাষ্ট্রের আর্থিক উন্নতির জন্য তিনি রাজস্ব আয়ের শ্রেণিবিন্যাস করেন। যাকাত, খারাজ, জিযিয়া, গনীমত, ফায় ও উশর ছিল এ ব্যবস্থার প্রধান উৎস।
২. বায়তুল মালঃ সাম্রাজ্যের রাজস্ব সংগ্রহ করার জন্য ওমর (রা) ‘বায়তুল মাল’ নামে একটি রাজস্ব কোষাগার প্রতিষ্ঠা করে আবদুল্লাহ ইবনে আরকামকে এর প্রধান কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন।
৩. মুদ্রা সংস্কারঃ ঐতিহাসিক মুইর বলেন, ওমর (রা)-এর সময় ইসলামী সাম্রাজ্যে অনেক মুদ্রার অনুপ্রবেশ ঘটে। তাই তিনি দিনার ও দিরহামের মধ্যে ১ঃ ১০ অনুপাত নির্ধারণ করে দেন।
৪. ভূমিকর নির্ধারণঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, হযরত ওমর (রা) জমি জরিপ করে উৎপাদিকা শক্তি অনুসারে ভূমিকর নির্ধারণ করেন।
৫, দিওয়ানুল খারাজঃ সাম্রাজ্যের আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব রাখার জন্য হযরত ওমর (রা) ‘দিওয়ানুল খারাজ’ নামে একটি নতুন রাজস্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখাই ছিল এর প্রধান কাজ।
৬. কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণঃ সরকারি কর্মচারীদের যােগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও মেধানুসারে তিনি বেতন নির্ধারণ করে দেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার দিরহাম পর্যন্ত ভাতা দেয়া হতাে। তাছাড়া তারা গনীমতের অংশও পেতেন।
৭. আদম শুমারিঃ পৃথিবীর ইতিহাসে হযরত ওমর (রা)-ই সর্বপ্রথম আদম শুমারি প্রবর্তন করেন। তিনি রাজস্ব আদায়ে প্রশাসনিক সুব্যবস্থার জন্য সাম্রাজ্যের লােক গণনা করে আদম শুমারির ভিত্তিতে ভাগ বণ্টন তালিকা তৈরি করেন।
হযরত ওমর (রা)-এর সামরিক বিভাগঃ
১. সাম্রাজ্যকে জেলায় বিভক্তকরণঃ রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনী মােতায়েন রাখার জন্য খলিফা হযরত ওমর (রা) সামাজ্যকে নয়টি সামরিক জেলায় বিভক্ত করেন। যেমন- ১. মদিনা, ২. কুফা, ৩, বসরা, ৪, সুসতাত, ৫. মিসর, ৬. দামেস্ক, ৭. হিমস, ৮. প্যালেস্টাইন ও ৯. মােসেল।
২. সৈনিকের শ্রেণিবিভাগঃ খলিফা ওমর (রা) সেনাবাহিনীকে পদাতিক, অশ্বারােহী, তীরন্দাজ, বাহক, সেবক প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত করেন।
৩. সৈনিকদের বেতনঃ সৈন্যদের বেতন বাতা নির্ধারিত ছিল এবং সরকারিভাবে তাদের পােশাক-পরিচ্ছদ সরবরাহ করা হতাে।
হযরত ওমর (রা)-এর ভূমি সংস্কারঃ
১. জমিদারি প্রথার উচ্ছেদঃ হযরত ওমর (রা) প্রাচীন শােষণমূলক ভূস্বত্ব ও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধন করেছিলেন। এর ফলে কৃষকদের অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল।
২. কৃষকদের মাঝে জমি বণ্টনঃ হযরত ওমর (রা) বিজিত দেশের জমিদারি এস্টেট রাষ্ট্রীয় দখলে এনে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করেছেন। এছাড়াও অনাবাদি জমি ভূমিহীন গরিব কৃষকদের মাঝে চাষ করার জন্য ভাগ করে দেন।
৩. বিজিত এলাকায় মুসলমানদের জমি খরিদ ও কৃষি কার্য নিষিদ্ধকরণঃ বিজিত এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা কৃষি কাজে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। আরবের লােকেরা কৃষিকাজে ছিল অনভিজ্ঞ। কৃষি কাজের উন্নতিকল্পে আরব মুসলমানদেরকে বিজিত এলাকায় জমি খরিদ ও কৃষি কাজ না করার নির্দেশ দেন, জাতে জমি নষ্ট না হয় এবং উৎপাদন কাজ ব্যাহত না হয়।
হযরত ওমর (রা)-এর জনহিতকর কার্যাবলিঃ
১. হিজরী সাল প্রবর্তনঃ ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন, হযরত ওমর (রা) হিজরী সাল প্রবর্তন করে ইসলামী ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করেন।
২. শহর নির্মাণঃ যরত ওমর (রা)-এর খেলাফতকালে বসরা, কুফা ও ফেস্তাত নামে তিনটি আধুনিক নতুন শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
৩ ইবাদতখানা নির্মাণঃ আল্লামা শিবলী নােমানী বলেন, তার আমলে অনেক মসজিদ, মক্তব, মাদরাসা এমনকি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও ইবাদতখানা নির্মিত হয়।
৪. দাসপ্রথার বিলােপ সাধনঃ ঐতিহাসিক মােহাম্মদ আলী বলেন, দাসপ্রথা বিলােপে গৃহীত পদক্ষেপ হযরত ওমর (রা)-এর অন্যতম কৃতিত্ব।
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনঃ শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে হযরত ওমর (রা) সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মাদরাসা ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার ব্যাপক উন্নত সাধন করেন।
৬. যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নঃ সাম্রাজ্যের জনকল্যাণে বহুমখী কর্মসূচির মধ্যে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন ছিল অন্যতম। নতুন শহর আবাদ করার জন্য তিনি রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। এ ছাড়া গৃহনির্মাণ, সেতু, খাল, দর্গ ইত্যাদি নির করে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
উপসংহারঃ আপন মহিমায় মহিমান্বিত খলিফা হযরত ওমর (রা) ছিলেন ইসলামের তথা গােটা বিশ্বের আকাশে এক দীপ্তিমান নক্ষত্র। তিনি স্বীয় আভা বিকিরণ করে ইসলামী জগৎকে ধন্য করেছেন। তার শাসননীতি যুগ যুগান্তর ধবে যে কোনাে রাষ্ট্রবিদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন- The death of Omar was real calamity of Islam.
Leave a comment