বেশিরভাগ লিপিবিজ্ঞানীই বলেন যে, আরামীয় (Aramaic) লিপি থেকেই খরােষ্ঠী লিপির জন্ম। প্রাচীনকালে ভারত-সিরিয়া-আরব-মেসােপটেমিয়া জুড়ে যে বাণিজ্যিক যােগসূত্র গড়ে উঠেছিল—অধিকাংশ ঐতিহাসিকই তা স্বীকার করেন। এইসব বাণিজ্যিক আদানপ্রদানে আরামীয় লিপিই ব্যবহৃত হত। ভারতীয় বণিকদেরও এই লিপি জানতে হত। এই সূত্রেই ভারতবর্ষে সম্ভবত খরােষ্ঠী লিপি উদ্ভূত হয়েছে। পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য মনে করেন যে, লিপিটি ‘খর’ অর্থাৎ ‘গাধার ওষ্ঠ’ (গাধার ঠোট)-এর মতাে দেখতে বলেই, এর এইরূপ নামকরণ হয়েছে। তবে ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ এই লিপি ভারতবর্ষ থেকে চলে যায় মধ্য এশিয়া এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। আনুমানিক পঞ্চম শতাব্দীতে এই লিপি লুপ্ত হয়। 

মধ্য এশিয়া এবং ভারত উপমহাদেশের মুদ্রা, কাঠের ফলক, চামড়া এবং শিলালিপিতে এই লিপির নিদর্শন পাওয়া যায়। সম্রাট অশােকের অনুশাসনগুলির (শিলালিপি) মধ্যে মানসােহরা এবং শাহবাজগঢ়ি অনুশাসনগুলি খরােষ্ঠী লিপিতে লেখা। তা ছাড়া, পারস্যের সম্রাট প্রথম দারায়ুস-এর লিপিতেও খরােষ্ঠীর ব্যবহার আছে। তবে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে এসে খরােষ্ঠীকে সরিয়ে ব্রাত্মী লিপিই সারা ভারতে প্রাধান্য বিস্তার করে। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, খরােষ্ঠী লিপি থেকে উদ্ভূত পারসাে-আরবিক লিপিতেই হিন্দুস্থানি ভাষা প্রথম লিখিত হয়েছিল, যা ভারতবর্ষে উর্দু ভাষা নামে পরিচিত।

প্রত্ন-বাংলা লিপি থেকে আধুনিক মুদ্রণ-যুগের বাংলা লিপির ক্রমবিবর্তন

বাংলা লিপির ক্রম-বিকাশের নিদর্শনগুলি পর্যায়ক্রমে আলােচনা করা হল-

  • প্রত্ন বাংলা লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় নারায়ণ পালের তাম্রশাসনে (নবম শতাব্দী)। এই লিপি পাললিপি নামে পরিচিত।

  • বিজয় সেনের একাদশ শতাব্দীর দেবপাড়া (মতান্তরে দেওলপাড়া) লিপিতে যেসব বর্ণ-এর পরিচয় পাওয়া যায়, তার সঙ্গে বর্তমান বাংলা লিপির এ, খ, এ, ত, ম, র, ল, য ইত্যাদি বর্ণের সাদৃশ্য রয়েছে।

  • লক্ষ্মণসেনের ‘তর্পণদীঘি লিপি’ (দ্বাদশ শতাব্দী)-তে চ, ছ, ঝ, ট, ণ, হ প্রভৃতি বর্ণগুলি ছাড়া অন্যান্য বর্ণগুলির সুগঠিত রূপ পাওয়া যায়।

  • শিলালিপি-প্রত্নলিপির বাইরে বাংলা গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে ব্যবহৃত বাংলা লিপির প্রাচীনতম নিদর্শন হল আনুমানিক দ্বাদশ-ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে অনুলিখিত চর্যাগীতির পাণ্ডুলিপি। এই লিপিটি মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করেন।

  • বাংলা লিপির সর্বপ্রথম সামগ্রিক রূপ পাওয়া যায় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হ্যালহেড সাহেবের ‘A Grammar of the Bengali Language’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থেই বাংলা টাইপ প্রথম ব্যবহৃত হয়। সমকালীন বাংলা লিপিকে সামনে রেখে চার্লস উইকিত্স (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী) এই গ্রন্থের জন্য বাংলার লিপির একটা আদর্শ নকশা তৈরি করে দেন এবং সেই অনুযায়ী পঞ্চানন কর্মকার ও মনােহর কর্মকার নামে দুজন কারিগর বাংলা লিপির ছাদ তৈরি করেন।

ব্রাহ্মী লিপি থেকে কীভাবে বিভিন্ন আধুনিক ভারতীয় এবং বহির্ভারতীয় লিপি উদ্ভূত হয়েছে, তা আলােচনা করাে।

লিপিবিশারদদের মধ্যে ব্রাম্মী লিপির উৎস সম্বন্ধে নানা মতভেদ থাকলেও এই লিপি যে প্রাচীন ও আদি-মধ্য যুগে অসেমেটিক ভাষা (যেমন—বৈদিক, সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত ইত্যাদি) প্রকাশে ব্যবহৃত হয়েছিল—সে বিষয়ে সবাই একমত। ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্রাহ্মীর দুটি আঞ্চলিক রূপ গড়ে ওঠে-উত্তর ভারতীয় রূপ এবং দক্ষিণ ভারতীয় ও বহির্ভারতীয় রূপ। দ্বিতীয় রূপ থেকেই পল্লব লিপি (৫০০ খ্রিস্টাব্দ) তৈরি হয়, যা গ্রন্থি, মালয়ালম্, তামিল, তেলুগু কন্নড়, সিংহলি লিপি এবং ব্রহ্মদেশ কম্বােজ শ্যামদেশীয় লিপির জন্ম হয়েছে।

অন্যদিকে,ব্রাহ্মী লিপির উত্তর ভারতীয় রূপই হল কুষাণ লিপি (২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। গুপ্তযুগে অর্থাৎ চতুর্থ শতাব্দীতে কুষাণ লিপি বিবর্তিত হয় এবং সেই পরিবর্তিত লিপির নাম হয় গুপ্ত লিপি। এই গুপ্ত লিপি থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে ‘সিদ্ধমাতৃকা’ লিপির জন্ম হয়। এই সিদ্ধমাতৃকা লিপি থেকে কুটিল লিপি উদ্ভূত হয় সপ্তম শতকে। এই লিপির লিখনপদ্ধতি জটিল। অর্থাৎ এটি কৌণিক নয়, ঘুরিয়ে লেখা। তা ছাড়া এই লিপিতে যে-কোনাে শব্দের সপ্তম ও নবম ধ্বনির ওপর মাত্রা দেওয়ার রীতি ছিল। এসব কারণেই লিপিটির এইরূপ নামকরণ হয়েছে। এই কুটিল লিপি থেকেই তিব্বতি, কাশ্মীরি ও গুরুমুখি, দেবনাগরী, কায়থী, খােটানি, যবদ্বীগীয়, নেপালি, ওড়িয়া, মৈথিলি এবং বঙ্গলিপি উদ্ভূত হয়েছে।

আধুনিক পৃথিবীর যাবতীয় বর্ণমালা সৃষ্টি হয়েছে কোন আদি বর্ণমালা থেকে? পৃথিবীতে বর্ণমালার উদ্ভব ও বিবর্তন সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

আধুনিক পৃথিবীর যাবতীয় বর্ণমালা সৃষ্টি হয়েছে প্রত্ন সেমীয় বা প্রােটোসেমেটিক বর্ণমালা থেকে। সিরিয়া প্যালেস্টাইনই সেই বর্ণমালার জন্মভূমি।

ধ্বনি ও বর্ণলিপি উদ্ভূত আদি প্রােটোসেমেটিক বর্ণমালা থেকে আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বছর আগেই মধ্যপ্রাচ্যে বেশ কয়েকটি প্রাচীন বর্ণমালার সৃষ্টি হয়। যেমন, সিনাইতে ‘সিনাইটিক লিপি’, ক্রিটে ‘লিনিয়ার-এ’ ও ‘লিনিয়ার-বি’ লিপি, এটুরিয়াতে ‘এটুসকান’ লিপি, সিরিয়ায় ‘ইউগরিট’ ও ‘বিব্লস’ লিপি। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ শেষ হওয়ার সময় মিশর, ব্যাবিলন, আসিরিয়া, হিটাইট, ক্রিট প্রভৃতি সভ্যতার প্রাধান্য কমে গিয়ে ইজরায়েল, ফিনিশিয়া, আরামীয়, সাবীয়, গ্রিক ইত্যাদি সভ্যতা গড়ে ওঠে। ফলে প্রােটোসেমেটিক লিপি বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রােটোসেমেটিক লিপি নর্থ সেমেটিক বা উত্তর সেমীয় এবং সাউথ সেমেটিক বা দক্ষিণ সেমীয়— এই দুই শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ততদিনে আন্তর্দেশীয় বাণিজ্য শুরু হওয়ার ফলে বর্ণমালার ক্ষেত্রে পারস্পরিক প্রভাব শুরু হয়ে যায়।

ফিনিশিয়াতেই প্রথম তৈরি হয়েছিল উত্তর সেমীয় বর্ণমালা। মধ্যপ্রাচ্যের হিসরা সেই নর্থ সেমেটিক বর্ণমালা ভেঙে ফিনিশীয় ও প্রাথমিক হিব্রু বর্ণমালা তৈরি করে। ফিনিশীয়দের বর্ণমালা ভেঙে গ্রিকরা তৈরি করে গ্রিক বর্ণমালা। অন্যদিকে, দক্ষিণ সেমীয় বর্ণমালা থেকে জন্ম নেয় সাবীয়, সাফাহিটীয় এবং থামুডেনীয় বর্ণমালা। এভাবেই ক্রমে ক্রমে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন বর্ণমালা তৈরি হয়।

মানবসভ্যতার প্রথম যুগে কোন্ কোন্ লিপিপদ্ধতি প্রচলিত ছিল? এর মধ্যে একটি বিস্তৃতভাবে আলােচনা করাে।

স্মারক-চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির পরিচয় দাও।

প্রাচীন চিত্রলিপি এবং ভাবলিপি সম্বন্ধে আলােচনা করাে।

প্রাচীন চিত্রপ্রতীকলিপি সম্বন্ধে আলােচনা করাে।

ধ্বনিলিপি বা বর্ণলিপি সম্বন্ধে আলােচনা করাে।

কীলক লিপি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা করাে।

মিশরীয় হিয়েরােগ্নিফিক সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা করাে।

এশিয়ার দুই প্রাচীন লিপি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা করাে।

ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপি বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়গুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

সিন্ধুলিপি ও কীলক লিপি সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

ব্রাহ্মী লিপির উৎস সম্বন্ধে যে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে, তার বিবরণ দাও।