প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করতেন নামীর স্বভাব ব্যক্ত করে। সে পদ্ধতি শুধু তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নামকরণ করতেন গাছপালার, ফুলেরও। এবং বলাবাহুল্য সর্বক্ষেত্রেই তাঁর নামকরণ আদর্শরূপেই বিবেচিত হয়েছিল। কোনো মানব শিশুর নামকরণের সঙ্গে, সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণের কিছু পার্থক্য আছে। শিশুর নাম শ্রুতিমধুর এবং সহজ আহ্বান যোগ্য হলেই চলে, কিন্তু সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণের মধ্যে নিহিত থাকে নামকৃত উপাদানটির মর্মকথা বা উদ্দেশ্য বা কোন বিশেষ বক্তব্য। আবার কখনো বা গল্প বা উপন্যাসের পটভূমিই হয়ে থাকে শিল্পসামগ্রীর নামকরণ। আমাদের আলোচ্য ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের নামকরণ প্রসঙ্গেও এই একই কথা বলা চলে।

আলোচ্য গল্পের পটভূমিতে রয়েছে একটি পরিত্যক্ত পাষাণ প্রাসাদ। সেই প্রাসাদ গল্পের নায়ক তথা তুলার মাসুল কালেক্টরের বাসস্থান। সেই শূন্য পরিত্যক্ত প্রাসাদে কোনো ভৃত্যই তার সঙ্গে রাত্রি বাস করতে রাজি ছিল না। কিন্তু উৎসাহী ও কৌতূহলী তরুণ কালেক্টর সমস্ত ভীতিবিহ্বলতা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সেখানেই রাত্রি যাপনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল।

সেই পরিত্যক্ত প্রাসাদে প্রতি রাত্রে সে শুনতে পেত কখনো দরবারী মহলের গীত ঝংকার, কখনো কখনো ইরাণী তরুণীর ক্রন্দনধ্বনি। একরাত্রে স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে সে দেখল তাকে হাতের ইশারায় একজন ডাকছে। তাকে অনুসরণ করে যেতে যেতে একটি ঘরের বাইরে পর্দার আড়াল থেকে সে দেখতে পেল কোনো এক সুন্দরীর সুন্দর চরণ গোলাপি মখমল আসনের ওপর অলসভাবে স্থাপিত অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু সে ঘরে প্রবেশ করার আগেই প্রহরীর ঘুম ভেঙে গেল। খোলা তলোয়ার তার কোলের ওপর ঝন্ধান করে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নায়ক শুনতে পেল মেহের আলি নামক তারই এক ভৃত্য প্রাত্যহিক অভ্যাস বশে চিৎকার করে চলেছে ‘তফাৎ যাও’, ‘তফাৎ যাও’।

পরদিন সকালে এই ঘটনাকে সে রাত্রের স্বপ্ন মনে করেই কাটিয়ে দিল। কিন্তু সন্ধ্যা হতে না হতেই তাকে ওই পাষাণ প্রাসাদ টানতে লাগলো। এইভাবে প্রতি রাত্রে সে শুনতে লাগল অনেক কলগুঞ্জন, তার কপোলের ওপর ভেসে আসতো সুগন্ধ নিঃশ্বাস। প্রায় প্রতি রাত্রেই সে শুনতে পেত তার খাটের নিচে, মেঝের নিচে, এই বৃহৎ প্রাসাদের পাষাণভিত্তির তলা থেকে কে যেন কেঁদে কেঁদে তাকে বলছে ‘তুমি আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও’।

এরপর এক ঝড়ঝঞ্ঝা পূর্ণ অমাবস্যার রাত্রে সে স্পষ্ট অনুভব করল, একজন রমণী পালঙ্কের তলায় গালিচার উপর উপুড় হয়ে পড়ে দুই দৃঢ়বদ্ধমুঠিতে নিজের আলুলায়িত কেশজাল টেনে ছিঁড়ছে, তার গৌরবর্ণ কপাল দিয়ে রক্ত ফেটে পড়ছে, কখনো সে হা হা করে হাসছে কখনো সে কাঁদছে, দু হাতে বুকের কাঁচুলি ছিঁড়ে অনাবৃত করে নিজের বুকে আঘাত করছে। সে রাত্রে ঝড় যেন আর থামছে না। এই রকম অস্থির অবস্থায় মেহের আলির চিৎকারে সে সম্বিত ফিরে পেল।

আলোচ্য গল্পের মধ্যে নায়ক প্রতি রাত্রে যা অনুভব করেছে যা বাদশাহী আমলের তরুণীদের নিষ্ফল কামনা বাসনার চিত্তদাহ। এই দাহ রয়ে গেছে পাষাণ প্রাসাদের প্রতিটি পাষাণের অন্তরে। কবি কল্পনাশক্তি দিয়ে অনুভব করেছেন, এই প্রাসাদের প্রতিটি পাষাণ যেন সেই সমস্ত লাস্যময়ী তরুণীর পদস্পর্শের জন্যে তৃত্স্নার্ত হয়ে আছে। বরীচের তুলার মাসুল কালেক্টার যেমন নিত্যদিন অদেখা তরুণীদের জন্যে উৎকণ্ঠিত, তৃয়ার্ত—দ্বিতীয় শা মামুদের নির্মিত প্রাসাদটির প্রতিটি পাষাণও সেই রকম প্রেম বুভুক্ষু। করিম খাঁয়ের কথায়—“এক সময় ওই প্রাসাদে অনেক অতৃপ্ত বাসনা, অনেক উন্মত্ত সম্ভোগের শিখা আলোড়িত হইত—সেই সকল চিত্তদাহে, সেই সকল নিষ্ফল কামনার অভিশাপে এই প্রাসাদের প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ড ক্ষুধার্ত তৃয়ার্ত হইয়া আছে।”—বস্তুত করিম খাঁর এই উক্তির ওপর ভিত্তি করেই গল্পের নামকরণ করা হয়েছে।

এখানে আরো একটা কথা এই বলা যায় যে, অফিসের কালেক্টার বা অন্যান্য কর্মীরা কর্মসঞ্চালনের কারণে এই প্রাসাদে এলেও তারা প্রাসাদের মতোই পাষাণ। তারা বিগত দিনের লাস্যময়ীদের করুণ বেদনা শুনতে, অনুভব করতে চায় না। এমন কি তাদের সান্নিধ্য এতটুকুও আকাঙ্ক্ষা করে না বলেই সন্ধ্যার পর কেউ আর প্রাসাদে থাকতে সম্মত হয় না। মাসুল আদায়কারী তাদের মতো পাষাণদেরই প্রতিভূ। কেন না, কর্তব্যের কারণে সে প্রাসাদের পাষাণের মতোই নীরব কঠোর। পাষাণবৎ সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না। সেই পাষাণের মধ্যেও যে রোমান্টিকতার ক্ষুধা ছিল, তাই ব্যস্ত হয়েছে নির্জন প্রাসাদে রাত্রিবাসের ফলে। ফলে সব দিক থেকে বিচার করে আলোচ্য গল্পের নামকরণ যথাযথ হয়েছে বলেই মতদান করা যায়।