রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের মধ্য একটি বিখ্যাত গল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’। এই গল্পটি বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প রূপে বিবেচিত। গল্পের মধ্যে কবির কল্পনার বিস্ফার দেখে মুগ্ধ হতে হয়। আলোচ্য গল্পের অবাস্তব রমণীয়তা পাঠক চিত্তকে অনায়াসে গ্রাস করে নিয়েছে। কোনো কোনো সমালোচক এই গল্পটিকে অতিপ্রাকৃত গল্প বলে অভিহিত করে থাকলেও আমরা তাঁদের মতে সহমত পোষণ করতে পারছি না। কেন সহমত পোষণ করতে পারছি না সে বিষয়ে কিছু আলোচনা আবশ্যক।

অতিপ্রাকৃত গল্প বলতে সাধারণভাবে যা বোঝা যায় তা হল, গল্পের মধ্যে একটা গা ছম্ছমানি ভাব থাকবে। ভয় ভয় ভাবে পিছন ফিরে তাকানোর প্রলোভন সামলানো যাবে না। বাস্তবের মাটিতে এসেও পাঠকের মনে সেই ভয় ভাব কিছুটা ক্রিয়াশীল থাকবে। এই হল অতিপ্রাকৃত রস। এই রস রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো গল্পের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে আমাদের আলোচ্য ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি এই রসের সঞ্চার করে বলে মনে হয় না। এর মধ্যে একটা গা ছম্ছমে আবহ আছে ঠিকই তবে সেই আবহটুকুকে আশ্রয় করে একে অতিপ্রাকৃত গল্প বলা সঙ্গত বলে মনে হয় না।

‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের প্রথমেই যে প্রস্তাবনা লেখক করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, অপরিচিত সহযাত্রী তথা গল্পকথকের কথাকে তিনি প্রথমাবধি ঠিক মতো মেনে নিতে পারছেন না। কেন সেই কথক থেকে থেকে বিজ্ঞান-বেদ-উপনিষদ পার্সির বয়েতের অনাবশ্যক উদ্ধৃতি সহযোগে লেখকদের মনাকর্ষণে প্রয়াসী। গল্পকথক সম্বন্ধে লেখকের মন্তব্য, তার কথাকে প্রথমেই অস্বীকার করার প্রবণতার মধ্যে দিয়ে তিনি প্রথমেই আজগুবি গল্পের ডালি খোলার ইঙ্গিত যেন দিয়ে দিয়েছেন। তাই গল্পটির প্রারম্ভেই লেখককৃত কৌতূক গল্পের অতিপ্রাকৃত রসাংশকে অনেকাংশে লঘু করে দিয়েছে।

তা ছাড়া কবির বর্ণনা মাধুর্যে এখানকার দৃশ্য সকল পাঠকের মনকে এমন এক কল্পনার স্বর্গে নিয়ে যায় যে, সেখানে গিয়ে পাঠকের বাস্তব চেতনা লুপ্ত হয়। কিন্তু তাতে গা ছমছমানি ভাবের চেয়ে রোমান্টিক ভাবে পাঠক মথিত হয় সমধিক। ভয়ের চেয়ে তখন ইরাণী তরুণীর প্রতি নায়কের মতো পাঠকেরও আগ্রহ হয়ে ওঠে প্রবল। এখানে লেখকের সঙ্গে পাঠক নিজেও যেন একাত্ম হয়ে অতীন্দ্রিয় সত্তা লাভ করে। ফলে ভয়ের চেয়ে রোমান্টিকতায় অবগাহন-আনন্দে সে বিভোর হয়ে যেতে থাকে। ফলে অতিপ্রাকৃত গল্প পাঠের সময় পাঠকের যে সতর্কতা ক্রিয়াশীল থাকে, গল্পের নায়কের আচরণের প্রতি পাঠক মনের যে নিষেধাজ্ঞার ভাবোন্মেষ ঘটে থাকে এখানে সেই ভাবোন্মেষ কণামাত্র ঘটে না। বর নায়কের মতো পাঠকও পুনর্বার অদেখা ইরাণী তরুণীর জন্যে কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

আলোচ্য গল্পের মধ্যে অতিপ্রাকৃত রস সঞ্চারের জন্যে মেহের আলিকে দিয়ে মাঝে মাঝেই ‘তফাৎ যাও’, ‘সব ঝুট হ্যায়’ ইত্যাদি বলিয়েছেন লেখক। কিন্তু মেহের আলির চিৎকার কানে যেতেই পাঠক প্রথমে চমকে উঠলেও পরক্ষণেই নায়কের স্বপ্নদর্শনের ব্যাপারটি বুঝতে পেরে কল্পলোক থেকে বাস্তব ভূমিতে নেমে আসে।

তাই সবদিক থেকে বিচার করে এ কথা বলা যেতে পারে যে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের মধ্যে যে একটা মোহময় পরিবেশ আছে। কিন্তু সেই মোহময়তার মধ্যে অতিপ্রাকৃত রসের সন্ধান পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে সে রস যে টুকু বা আছে তাকে ভিত্তি করে সমগ্র গল্পটিকে অতিপ্রাকৃত রসের গল্প বলে চিহ্নিত করা সমীচীন নয়।